প্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যে রোমের উত্তরণ

খ্রিস্টপূর্ব যুগে প্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যে রোমের উত্তরণ প্রসঙ্গে টিবেরিয়াস গ্র্যাচ্চাসের ভূমিকা, মারিয়াস ও সুল্লার মধ্যে গৃহযুদ্ধ, দাসবিদ্রোহ, রোমে ত্রয়ীর শাসন, পম্পেই-সিজার দ্বন্দ্ব, সিজারের সামরিক একনায়কতন্ত্র, সিজার-বিরোধী ষড়যন্ত্র ও হত্যা, দ্বিতীয় ত্রয়ীর শাসন ও মার্ক অ্যান্টনি-অক্টাভিয়ান সংঘাত সম্পর্কে জানব।

রোম-প্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যে উত্তরণ

ঐতিহাসিক ঘটনা বা গল্পপ্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যে রোমের উত্তরণ
দাসবিদ্রোহে বিধ্বস্তইতালি
রোমান সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তারখ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতক
সিজারের হত্যাখ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দ
দাস ও গ্ল্যাডিয়েটরস্পার্টাকাস
প্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যে রোমের উত্তরণ

ভূমিকা :- প্রজাতন্ত্রের শেষ পর্যায়ে রোমে দাসবিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। যার ফলে একদিকে বারবার দাসবিদ্রোহে ইতালি বিধ্বস্ত হয় এবং অপরদিকে রাষ্ট্রের ক্ষমতালাভের জন্য গৃহযুদ্ধ প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার স্থায়িত্বের মূলে কুঠারাঘাত হানে। প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ক্রমশ ভেঙে পড়ে। প্রজাতন্ত্রের পর রোম-এ প্রথমদিকে একনায়কতন্ত্র ও পরে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতকে রোমান সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। পশ্চিম ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলি রোমান শাসনের আওতায় আসে। ক্রমে পশ্চিমে ব্রিটেন (ইংল্যান্ড) থেকে পূর্বে এশিয়া মাইনর ও সিরিয়া পর্যন্ত ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রোমান আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

টিবেরিয়াস গ্র্যাচ্চাসের ভূমিকা

টিবেরিয়াস গ্র্যাচ্চাস খ্রিস্টপূর্ব ১৩৩ অব্দে ট্রিবিউন নির্বাচিত হয়ে রোম রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তিনি কৃষি আইন প্রণয়ন ও ভূমিসংস্কারের জন্য নানা পদক্ষেপ নেন। সেনেট তাঁর প্রস্তাদে বিরোধিতা করলেও, ইতালির বেশিরভাগ ট্রাইব তাঁকে সমর্থন করে। যদিও প্রতিহিংসার কারণে শেষপর্যন্ত তাঁকে হতা করা হয়, তবে তিনি সাধারণ মানুষকে তাদের অধিকার আদায়ের পথ নির্দেশ দিয়ে যান।

মারিয়াস ও সুল্লার মধ্যে গৃহযুদ্ধ

রোমান প্রজাতন্ত্রের অন্তিম লগ্নে মারিয়াস এবং সুল্লার মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমত দখলের লড়াই তীব্র রূপ নেয়। এই দ্বন্দ্ব চলে খ্রিস্টপূর্ব ৮৩ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৮২ অব্দ পর্যন্ত। অবশেষে নির্ণায়ক যুদ্ধে সুল্লা জয়ী হলে তাঁর নেতৃত্বে একটি সামরিক একনায়কতন্ত্র (খ্রি.পু. ৮১-৭৯ অব্দ) গড়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব ৮১ অব্দ নাগাদ সুল্লা আনাতোলিয়ার পনটাস অঞ্চলের শাসক ষষ্ঠ মিথরিডেটিসকে পরাজিত করেন। ফলে পশ্চিম এশিয়ায় রোমান আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং রোমানদের কাছে সুল্লার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এরপর সুল্লা তাঁর বিরোধীদের দমন করেন। তিনি সেনেটের ক্ষমতা বাড়িয়ে ট্রিবিউনদের ক্ষমতা হ্রাস করেন। তাঁর মৃত্যুর পর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লক্ষে। সমরনায়করা পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হন।

রোমে দাসবিদ্রোহ

কুইনটাস সারটোরিয়াসের নেতৃত্বে স্পেন-এর বিদ্রোহ, ষষ্ঠ মিথরিডেটিসের পশ্চিম এশিয়ায় পুনরুত্থান এবং ইতালিতে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে সংঘটিত দাসবিদ্রোহ (খ্রি.পৃ. ৭৩-৭১ অব্দ) রোমে রাজনৈতিক ও সামরিক সংকট তৈরি করেছিল। প্রথমে দাস ও পরে গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবে নিযুক্ত স্পার্টাকাস বহু সংখ্যক দাস নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তোলেন। এই বাহিনীর আক্রমণ রোমান অভিজাতদের আতঙ্ক বাড়িয়ে তোলে। এই বিদ্রোহ দমনের জন্য রোমান রাষ্ট্র মার্কাস লিসিনিয়াস ক্রাসাস-কে সেনাপতি নিযুক্ত করে। যদিও ক্লাসাসের বাহিনী স্পার্টাকাসের দাসবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৭১ অব্দ নাগাদ স্পার্টাকাস দুজন রোমান সেনাপতিকে হত্যা করেন। বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত স্পার্টাকাস প্রাণ হারান। এরপর বাকি দাসদের হত্যা করে পম্পেই-এর বাহিনী। এই দাস অভ্যুত্থান রোমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রথম প্রশ্ন তুলেছিল।

রোমে ত্রয়ীর শাসন

সুল্লার পতনের পর রোমে তিনজন সামরিক নেতার আবির্ভাব হয়। এঁরা হলেন লিসিনিয়াস মার্কাস ক্রাসাস, পম্পেই এবং জুলিয়াস সিজার। এঁদের নেতৃত্বে ত্রয়ীর শাসন (Rule of Triumvirate) প্রতিষ্ঠিত হয়। ত্রয়ীর শাসন বা ট্রায়ামভিরেট ছিল একটি প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান। এতে তিনজনের সমান কর্তৃত্ব ছিল। এই শাসন চলেছিল খ্রি.পূ. ৬০-৫৩ অব্দ পর্যন্ত। এই শাসন রোমের সাংবিধানিক কাঠামোকে দুর্বল করে দিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩ অব্দে ক্লাসাস মারা যান। এরপর পম্পেই ও সিজারের মধ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য তীব্র রাজনৈতিক ও সামরিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পশ্চিম এশিয়ায় সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন দখল করে পম্পেই সামরিক নেতা হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। অন্যদিকে জুলিয়াস সিজার রাইন নদীর পশ্চিমে অবস্থিত বর্তমান জার্মানি ও বেলজিয়াম অঞ্চল এবং পো নদীর তীরবর্তী উপত্যকায় অবস্থিত গল রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

(ক) পম্পেই-সিজার দ্বন্দ্ব

পম্পেই-সিজার দ্বন্দ্বে রোমের সেনেট পম্পেইকে সমর্থন করে এবং তাঁকে কনসাল ঘোষণা করে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯ অব্দে সিজার তাঁর সামরিক বাহিনী নিয়ে রোমের দিকে অগ্রসর হন। রোমান সেনেট পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য পম্পেইকে রোমান সেনাপতি নিযুক্ত করেন। পম্পেই পরিস্থিতি সামাল না দিতে পেরে বলকান উপদ্বীপে চলে যান। এ সময় রোমের কিছু দাসমালিক ও সাধারণ মানুষ সিজারকে সমর্থন করে। ফলে তিনি অনায়াসে রোম ও সমগ্র ইতালি জয় করেন। ইতিমধ্যে পম্পেই বলকান উপদ্বীপে সৈন্য সমাবেশ করলে সিজারের বাহিনী তাঁকে আক্রমণ করে পর্যুদস্ত করে। পম্পেই পালানোর চেষ্টা করেও, শেষপর্যন্ত সিজারের বাহিনীর হাতে নিহত হন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮ অব্দে সিজারের জয়লাভ সম্পূর্ণ হয়। রোমে তিনি বার্তা পাঠান-আমি এলাম, দেখলাম, জয় করলাম (Veni, Vidi, Vici)। সিজার ও পম্পেই-এর মধ্যে এই বিরোধ আসলে ছিল রোমের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সংকটের বহিঃপ্রকাশ, যা ইতিহাসে ‘রোমের গৃহযুদ্ধ’ (Civil War of Rome) নামে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে এইচ জি ওয়েলস বলেছেন, গৃহযুদ্ধের সময় সিজারের কার্যকলাপ প্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যে উত্তরণ ঘটায়।

(খ) সিজারের সামরিক একনায়কতন্ত্র

জুলিয়াস সিজারের সাফল্যের ফলে প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে রোমে সামরিক একনায়কতন্ত্র (খ্রি.পূ. ৪৭ অব্দ) প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর এই শাসন মাত্র তিন বছর (খ্রি.পূ. ৪৪ অব্দ পর্যন্ত) টিকেছিল। এই সময় পররাষ্ট্রনীতি ও রাজস্ব নির্ধারণের ব্যাপারে রোমান সেনেট সিজারকে পূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ করে। তিনি বহু প্রশাসনিক ও আর্থিক সংস্কার করেন। তিনি সেনেটের ক্ষমতা লোপ করেন। এইসব কাজের ফলে রোমান অভিজাতরা মনে করেন যে, সিজার রোমে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। ফলে সিজার-বিরোধী ষড়যন্ত্র শুরু হয়।

(গ) সিজার-বিরোধী ষড়যন্ত্র ও হত্যা

সিজার-বিরোধী ষড়যন্ত্রের পরিণতি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দের ১৫ মার্চ সিজারের হত্যা। এই হত্যাকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস এবং গায়াস ক্যাসিয়াস লংগিনাস। এঁরা দুজনেই রোমে প্রজাতান্ত্রিক শাসন সুদৃঢ় করার পক্ষপাতী ছিলেন। ব্রুটাস আবার সিজারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সিজার হত্যার মাধ্যমে রোমে সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও ততদিনে রোমান প্রজাতন্ত্রের দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল।

দ্বিতীয় ত্রয়ীর শাসন

সিজারের হত্যাকান্ডের পর তাঁর তিন অনুগামী মার্ক অ্যান্টনি, লেপিডাস এবং অক্টাভিয়ানের নেতৃত্বে খ্রিস্টপূর্ব ৪৩ অব্দে রোমে ‘দ্বিতীয় ত্রয়ীর শাসন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪২ অব্দে ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াসের নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী ত্রয়ীর শাসন দমন করে রোমান প্রজাতন্ত্রকে আরও দুর্বল করে দেয়। এরপর লেপিডাসকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয়।

মার্ক অ্যান্টনি-অক্টাভিয়ান সংঘাত

রোমের পরবর্তী ইতিহাস বলতে মার্ক অ্যান্টনি-অক্টাভিয়ানের সংঘাতের ইতিহাসকে বোঝায়। অ্যান্টনি ছিলেন একজন দক্ষ সামরিক নেতা। তুলনামূলকভাবে অক্টাভিয়ান ছিলেন দুর্বল। তাঁদের উভয়ের মধ্যে সংঘাত ছিল আসলে পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিমের সংঘাত। অ্যান্টনি মিশর-এর টলেমিড রানি ক্লিওপেট্রার সঙ্গে একটি সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি চেয়েছিলেন অক্টাভিয়ানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মিশরের সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে। অন্যদিকে অক্টাভিয়ানের হাতে ছিল প্রভূত জনবল। ক্রমে অ্যান্টনি-অক্টাভিয়ান সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।

উপসংহার :- অগাস্টাস সিজারের রোমের সিংহাসনে আরোহণের মাধ্যমেই রোমান সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। এই সাম্রাজ্যের প্রথম ২০০ বছর আর্থিক সমৃদ্ধি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। একে ‘Pax Romana’ বা রোমান শান্তির যুগ বলা হয়। সাম্রাজ্যের যুগে রোমের ইতিহাসকে দুই পর্বে ভাগ করা যেতে পারে, যথা – ২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল হল প্রথম পর্ব এবং ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল হল দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বে রোমান সাম্রাজ্য ছিল স্থিতিশীল ও অখণ্ড, কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে রোমান সাম্রাজ্য খণ্ডিত হয়ে যায়।

(FAQ) প্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যে রোমের উত্তরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কার সিংহাসনে আরোহণের মাধ্যমেই রোমান সাম্রাজ্যের সূচনা হয়?

অগাস্টাস সিজার।

২. ‘Pax Romana’ বা রোমান শান্তির যুগ বলতে কী বোঝায়?

রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম ২০০ বছর আর্থিক সমৃদ্ধি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। একে ‘Pax Romana’ বা রোমান শান্তির যুগ বলা হয়।

৩. ইতালি কিভাবে বিধ্বস্ত হয়?

দাসবিদ্রোহের ফলে।

৪. রোমান সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে কোন সময়?

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতকে।

৫. প্রথমে দাস ও পরে গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবে নিযুক্ত হন কে?

স্পার্টাকাস।

Leave a Comment