বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থায় নায়ক ব্যবস্থার ভূমিকা প্রসঙ্গে নায়কদের হাতে শক্তি কেন্দ্রীভূত, নায়েবের অবস্থান, স্বাধীনতা ভোগ, নায়েকদের কাজ, জনকল্যাণমূলক কাজ, কৃষিতে নায়কের ভূমিকা, মন্দিরের উপর আধিপত্য, বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়, বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, বণিক সংঘ ও নায়ক-ব্যবস্থা সম্পর্কে জানবো।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থায় নায়ক ব্যবস্থার ভূমিকা
বিষয় | বিজয়নগরের শাসন ও অর্থনীতিতে নায়ক ব্যবস্থার ভূমিকা |
সাম্রাজ্য | বিজয়নগর সাম্রাজ্য |
প্রতিষ্ঠাতা | হরিহর ও বুক্ক |
ক্যাপ্টেন | নায়ক |
ভূমিকা :- বিজয়নগরের শাসনব্যবস্থায় ও অর্থনীতিতে ‘নায়ক-ব্যবস্থার’ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
নায়কদের হাতে শক্তি কেন্দ্রিভুত
শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি ‘নায়ক-নির্ভর’ না হলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিজয়নগরের প্রায় পঁচাত্তর শতাংশ জমির ভূমি-রাজস্ব আদায়ের অধিকারী হওয়ায় নায়কদের হাতে অর্থ ও শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। পর্তুগিজরা ‘নায়কদের’ ‘ক্যাপ্টেন’ বলে অভিহিত করেছে।
নায়কদের অবস্থান
- (১) বিজয়নগরের ‘নায়কদের’ অবস্থান সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। বিজয়নগরের প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় ‘নায়ক’ উপাধিধারী অভিজাত সামরিক শাসকদের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
- (২) প্রতিটি উপপ্রদেশের শাসনভার অভিজাত বংশীয় সামন্ত অথবা রাজপরিবারের ‘নায়ক’ উপাধিধারী শাসনকর্তার হাতে ন্যস্ত থাকত। প্রাদেশিক নায়কগণ স্থানীয় সামরিক, অসামরিক বা বিচার ব্যবস্থাতেও চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
স্বাধীনতা ভোগ
তাঁরা অসম্ভব রকমের স্বাধীনতা ভোগ করতেন। বার্টন স্টাইনের মতে নায়করা ছিলেন স্থানীয় সামরিক নেতা ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে সর্বেসর্বা।
নায়কদের কাজ
নায়করা রাজস্ব আদায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও যুদ্ধ পরিচালনা ও রাজাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করত। এজন্য তাদের রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থায় অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী করেছিল। তাদের কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হত না।
রাজার নির্ভরশীলতা
‘নায়ক’ দুর্গ নির্মাণ করে নিজের নিজের অধিকার সুরক্ষিত রাখতেন এবং রাজাকে তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য করতেন, যেহেতু রাজা তাঁদের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।
জনকল্যাণমূলক কাজ
তাঁরা কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতির উন্নয়নের কাজে কখনোই অমনোযোগী ছিলেন না। দেবমন্দির ও সৌধনির্মাণেও তাঁরা উৎসাহ দিতেন। গ্রামের বৃক্ষ রোপণ ও ধর্মরক্ষার কাজেও আত্মনিয়োগ করতেন।
বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ
- (১) নিকোলো কন্টি, আবদুর রাজ্জাক, পায়েসের বিবরণে বিজয়নগরের যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চিত্র পাওয়া যায় তার মূলে ছিল এই নায়কদের উৎসাহ ও সহযোগিতা।
- (২) সব বিদেশি পর্যটকই বিজয়নগরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তবে সাধারণ মানুষের জীবন অর্থনৈতিক দিক থেকে কেমন ছিল তার পরিচয় অবশ্য এইসব বিবরণে নেই বললেই চলে।
রাজ্জাকের বর্ণনা
পারসিক দূত আবদুর রাজ্জাক বলেছেন ” All the inhabitants of the country, whether high or low, wear jewels and gilt ornaments in their ears and around their necks, arms, wrists and fingers”.
পায়েসের বর্ণনা
পর্তুগিজ পর্যটক পায়েসও লিখেছেন ধান, চাল, গম, বার্লি, মশলা প্রভৃতির প্রাচুর্য তাকে মুগ্ধ করেছিল। মূল্যও অত্যন্ত সস্তা ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। রাজপথসমূহ ও বাজার খাদ্য-শস্যবাহী গোরুর গাড়িতে পরিপূর্ণ ছিল।
বারবোসার বিবরণ
বারবোসা ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরের বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন বিজয়নগর এক জনসমৃদ্ধ শহর এবং বিজয়নগর হিরে, মুক্ত, সিল্ক, কর্পূর, মৃগনাভি, চন্দনকাঠ প্রভৃতি পণ্যদ্রব্যের শ্রেষ্ঠ ব্যবসাকেন্দ্র ছিল।
কৃষিতে নায়কদের ভূমিকা
- (১) আঞ্চলিক ‘নায়করা’ কৃষিতে যথেষ্ট নজর দিতেন। তুঙ্গভদ্রা নদীতে বাঁধ দিয়ে একদিকে যেমন দেবরায় বিজয়নগর শহরে জল সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিলেন, আবার এই বাঁধের জলকে সেচের কাজে লাগিয়ে কৃষির সমুন্নতি ঘটানো হয়েছিল।
- (২) এই কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে ‘নায়ক’ ও ‘অমর নায়কদের’ ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এরা রাজাকে সৈন্য জোগাত এবং তার বিনিময়ে জায়গির ভোগ করত। ‘অমরা’ অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলির সকল অঞ্চলের জমি বিজয়নগরের রাজারা ‘অমর নায়কদের’ অর্পণ করেছিলেন।
স্টাইনের মত
- (১) স্টাইনের মতে ‘অমর নায়করা’ বিজয়নগরের অর্থনীতির সবথেকে একটা বড়ো অংশ দখল করেছিলেন এবং তাঁরাই রাজার একমাত্র অর্থ সংগ্রহের কাজ করত। সামরিক ও আর্থিক ক্ষমতার অধিকারী এইসব নায়কদের কর্তৃত্ব অস্বীকার করা রাজার পক্ষেও সম্ভব ছিল না।
- (২) একটি তথ্য থেকে জানা যায় যে তাঁরা আদায়ী রাজস্বের অংশ জমা দিত। তার উপর অধিকাংশই উপরি পাওনা হিসেবে আদায় করত।
মন্দিরের উপর আধিপত্য
মন্দিরগুলির উপরেও নায়কদের বা সামন্তদের আধিপত্য বিস্তৃত হওয়ায় সমাজজীবনেও তারা অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হয়। এমনকি শহর, বন্দর ও বাজারগুলিও তারা নিয়ন্ত্রণ করত। এমনকি এই সকল স্থানে তারা খাজনা ও শুল্ক আদায় করত।
নায়কদের স্বাধীনতা ঘোষণা
সামন্তপ্রভুরা বা নায়করা প্রভূত ধনশালী হয়ে ওঠে। এরাই পরে ‘পলিগার’ নামে অভিহিত হয়। এর ফলে রাজা দুর্বল হলে এরা রাজাকেও অমান্য করত। ক্রমে নায়করা খুবই ক্ষমতাশালী ও স্বাধীনতাকামী হয়ে ওঠে। রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের পর রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে নায়কদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হয়।
কৃষক বিদ্রোহ
- (১) রাজা দুর্বল হলেই নায়কদের প্রাধান্য প্রকটিত হত। কারণ রাজা নায়কদের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করতেন। এখানে ব্রাহ্মণদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
- (২) নায়ক ও ব্রাহ্মণদের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। তারা কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত করও আদায় করত। যার ফলে এখানে দুএকবার কৃষক বিদ্রোহও ঘটেছে।
সামন্ততন্ত্রের উৎস
- (১) এই নায়ক নির্ভর কৃষি অর্থনীতিতে অনেকেই সামন্ততন্ত্রের উৎস সন্ধান করেছেন। বিজয়নগরের নায়ক-নির্ভর কৃষি অর্থনীতিতে নায়কদের ব্যাপক প্রাধান্য ঘটলেও এই ব্যবস্থাকে কখনই ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের সমপর্যায়ভূত বলে গণ্য করা যায় না।
- (২) এই ব্যবস্থা জাপানের সামন্ততন্ত্রের অনেকটা নিকটবর্তী ছিল। অবশ্য জাপানে ‘দাইমিওরা’ সামরিক নেতা হলেও তাদের মধ্যে অনেকগুলি অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাজন ছিল। তবে বিজয়নগরের সামন্তরা বা নায়করা প্রত্যক্ষভাবে সমস্ত জমি নিয়ন্ত্রণ করত। এখানে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী ছিল না।
- (৩) যদিও বিজয়নগরের নায়ক-নির্ভর কৃষি অর্থনীতিকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা বলা যায় না। তবে সমগ্র সাম্রাজ্যেই এই সামরিক নায়কদের যে প্রাধান্য ছিল তা বিদেশিদের দৃষ্টিতেও ধরা পড়েছে।
বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়
বিজয়নগরের রাজস্ব প্রদানকারী সমস্ত গ্রামের অধিকাংশটাই নায়কদের মধ্যে বিলি করা হয়েছিল। তাই তারা বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করত। এই বিপুল রাজস্বের একটি উদ্বৃত্ত অর্থ সম্ভবত শিল্প ও বাণিজ্যের সম্প্রসারণে ব্যবহৃত হত।
বাণিজ্যের সম্প্রসারণ
- (১) বিজয়নগরের নগরায়ণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে তাকালে এই তথ্যই প্রতীয়মান হয় যে স্থায়ী শাসকগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক ড. আয়েঙ্গার মনে করেন পর্তুগিজদের পশ্চিম উপকূলে বসবাস করতে দিয়ে বিজয়নগরের শাসকগণ ভুল করেছিলেন।
- (২) তাঁর মতে বিজয়নগরের নরপতিদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড সুবিধালাভের পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও তাঁরা সেই সুযোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পর্তুগিজদের পশ্চিম উপকূলে বসবাস করতে ড. আয়েঙ্গার ‘The greater question of stability of their empire’ বলে অভিহিত করেছেন।
খাজনা আদায়
- (১) বিজয়নগর সাম্রাজ্যের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমিরাজস্ব। ‘নায়করা’ রাষ্ট্রীয় তালুক বা নাড়ুগুলি থেকে এবং সামন্তপ্রভু বা অমর নায়কদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করত এবং রাজকোষে জমা দিত।
- (২) প্রাদেশিক বা উপপ্রাদেশিক নায়করা ছিলেন নিজ নিজ এলাকায় মুকুটহীন রাজা। তাদের নিজস্ব দরবার ও সেনাদল ছিল। ভূমি রাজস্ব ছিল অত্যধিক। জমির উর্বরতা অনুযায়ী ভূমিরাজস্ব দিতে হত। কিন্তু কৃষকদের অবস্থা কেমন ছিল তা বলা যায় না।
- (৩) ভূমি রাজস্ব থেকে এই বিরাট পরিমাণ অর্থ নায়কদের হাতে সঞ্চিত হওয়ায় সম্ভবত তাদের উৎসাহে নগরায়ণ এবং শিল্পের ও বাণিজ্যের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। বৈদেশিক বিবরণী হতে বিজয়নগরের যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় তার পশ্চাতে ছিল শিল্পে ও বৈদেশিক বাণিজ্যে নায়কদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শহর, বন্দর ও বাজারগুলি নায়কদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তারা এখান থেকে খাজনা ও শুল্ক আদায় করত।
বণিকগোষ্ঠী ও নায়কব্যবস্থা
- (১) স্বভাবতই দেখা যায় বণিকগোষ্ঠী ও নায়ক ব্যবস্থা একই স্বার্থের সূত্রে আবদ্ধ হওয়ায় বাণিজ্য যথেষ্ট উৎসাহিত হয়েছিল। এই নায়কব্যবস্থার উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া বিজয়নগর দক্ষিণ ভারতে বাণিজ্যের ও শিল্পের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হতে পারত না।
- (২) বিজয়নগরের যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও গৌরবের পরিচয় বিভিন্ন বিদেশি পর্যটকদের বিবরণে পাওয়া যায় তা এই বাণিজ্য ও শিক্ষাই সমৃদ্ধ করেছিল। বিজয়নগর অতীতে রোম-ভারত বাণিজ্যেও অংশগ্রহণ করেছিল।
উপসংহার :- বিজয়নগরের এই বাণিজ্যধারা সমগ্র বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে নায়ক ব্যবস্থা বিজয়নগরের রাজতন্ত্র ও বণিকতন্ত্রকে একই স্বার্থের সূত্রে বেঁধে দিয়েছিল।
(FAQ) বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থায় নায়ক ব্যবস্থার ভূমিকা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
হরিহর ও বুক্ক।
১৩৩৬-১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দ।
নায়করা।
নায়করা রাজস্ব আদায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও যুদ্ধ পরিচালনা ও রাজাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করত।