বিজয়নগর রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা

বিজয়নগর রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে রাজার ক্ষমতা, মন্ত্রী পরিষদ, প্রাদেশিক শাসন, সামন্ত প্রভুদের ক্ষমতা, গ্রামীণ শাসন, ভূমি রাজস্ব, বিচার ব্যবস্থা, সামরিক শাসন ও শাসন ব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে জানবো।

বিজয়নগর রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা

ঐতিহাসিক ঘটনাবিজয়নগরের শাসনব্যবস্থা
সর্বময় ক্ষমতারাজা
রাজার উপাধিমহারাজা
প্রধানমন্ত্রীমহাপ্রধান
প্রদেশের শাসনকর্তানায়ক বা নায়েক
বিজয়নগর রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা

ভূমিকা :- যে কোনো সাম্রাজ্য-এর স্থায়িত্বের জন্য ক্ষাত্রশক্তিই যথেষ্ট নয়। সুবিন্যস্ত ও সুনিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থার ওপর তা বহুলাংশে নির্ভরশীল। বিজয়নগর সাম্রাজ্য-এর ক্ষেত্রে একথা আরও বেশি করে প্রযোজ্য।

বিজয়নগরের শাসন ব্যবস্থায় রাজার ক্ষমতা

  • (১) হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে বিজয়নগরের শাসনব্যবস্থায় রাজাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তাঁর উপাধি ছিল “মহারাজা”। রাজা যোগ্য ও শক্তিশালী হলে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেত।
  • (২) রাজা নিজে প্রশাসন ও যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিচালনার দায়িত্ব বহন করতেন। রাজা ছিলেন বিচার, আইন, দণ্ড সকল কিছুর রক্ষাকর্তা। তিনি স্বৈর ক্ষমতার অধিকারী হলেও স্বৈরাচারী ছিলেন না। রাজসভায় খুব আড়ম্বর ছিল।
  • (৩) ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী তিনি রাজ কর্তব্য পালন করতেন। কৃষ্ণদেব রায় তাঁর “অমুক্ত মাল্যদা” গ্রন্থে বলেছেন যে “মুকুটধারী রাজা সর্বদা ধর্মরক্ষা করে চলবেন”। “রাজার কর্তব্য হল শাসনব্যবস্থায় অভিজ্ঞ লোকদের সাহায্যে জনসাধারণের ওপর মৃদু হারে কর স্থাপন করা এবং শত্রুকে বিনাশ করা।”

বিজয়নগরের শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রী পরিষদ

  • (১) রাজাকে শাসনের কাজে সাহায্যের জন্য একটি মন্ত্রীপরিষদ (Council) থাকত। এই পরিষদে সভাসদরা ছাড়া থাকত প্রধান সামন্ত শ্রেণী ও বণিকদের প্রতিনিধি। যদিও মন্ত্রীর পদে ব্রাহ্মণরা প্রাধান্য পেত, তবুও ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের মন্ত্রী এবং অন্যান্য উচ্চপদে নিয়োগ করা হত।
  • (২) মন্ত্রীপরিষদে মন্ত্রীদের সংখ্যা ছিল ৬ থেকে ৮। মন্ত্রীরা সাধারণত যোগ্যতার ভিত্তিতে নিযুক্ত হতেন। কখনও কখনও তারা বংশানুক্রমিক ভাবে পদ ভোগ করতেন। ‘মহাপ্রধান’ বা প্রধান মন্ত্রী বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করতেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের মহাপ্রধান নিয়ন্ত্রণ করতেন।
  • (৩) মহাপ্রধান ছাড়া কোষাধ্যক্ষ, রাজকোষের রক্ষী, বাণিজ্যের অধ্যক্ষ, রক্ষী বাহিনীর নায়ক প্রভৃতি কেন্দ্রীয় কর্মচারী ছিল। ভাটেরা রাজার গুণগান করে গাথা রচনা করত, লিপিকার শিলালিপি খোদাই করত, তাম্বুল করঙ্কবাহিক পান-সুপারি বয়ে নিয়ে যেত রাজার সেবার জন্য।

ভারতের বিজয়নগর রাজ্যের প্রাদেশিক শাসন

  • (১) বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনের জন্য প্রাদেশিক শাসকদের পদে ২/৩ বছর অন্তর নতুন করে লোক নিয়োগ করা হত। চোল যুগের গ্রামীণ স্বায়ত্ব শাসনের ঐতিহ্য অনেকাংশে বিজয়নগর রাজ্যে বিদ্যমান ছিল। এজন্য সাম্রাজ্যকে শাসনের সুবিধার জন্য কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করা হয়। প্রদেশগুলির বিভিন্ন নাম ছিল। যথা, মণ্ডল, চারদী প্রভৃতি।
  • (২) প্রদেশগুলিকে বিভিন্ন জেলা বা নাড়ু, সিমা, কোট্টামে ভাগ করা হত। পায়েজের মতে, বিজয়নগরে প্রায় ২০০ প্রদেশ ছিল। এই মন্তব্যকে অতিশয়োক্তি মনে করা হয়। কৃষ্ণ শাস্ত্রীর মতে, বিজয়নগর ৬টি প্রধান প্রদেশে বিভক্ত ছিল।
  • (৩) প্রদেশের শাসনকর্তাদের বলা হত “নায়ক” বা “নায়েক। গোড়ার দিকে রাজবংশের লোকেরাই প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদে বসতেন। পরের দিকে সামন্ত ও অভিজাত পরিবারের লোকেরাই এই পদগুলি পেত।
  • (৪) নায়েকরা রাষ্ট্রীয় তালুক বা নাড়ুগুলি থেকে এবং সামন্ত প্রভু বা ‘অমরনায়ক’-দের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে রাজকোষে জমা দিত। এই আদায়ী রাজস্বের কিছু অংশ তারা ভাগ পেত। সামন্ত ভূস্বামীদের নাম ছিল অমরনায়ক।
  • (৫) নায়েক বা প্রাদেশিক শাসকরা দেশরক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনহিতকর কাজও করত। আসলে প্রাদেশিক শাসনকর্তারা নিজ নিজ অঞ্চলে ছিল মুকুটহীন রাজা। তারা কতদিন নিজ পদে থাকতে পারবে তার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না।
  • (৬) নায়েকদের নিজস্ব দরবার ও সেনাদল ছিল। তারা নিজ নামে ক্ষুদ্র মানের মুদ্রা ছাপাত এবং প্রাদেশিক কর্মচারীদের নিয়োগ করত। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তাদের তিনটি প্রধান দায়িত্ব পালন করতে হত – দরকারের সময় রাজাকে সৈন্যদল সরবরাহ করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা, নিয়মিত রাজস্ব প্রদান করা, এবং রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন।
  • (৭) এই তিন দায়িত্ব পালন করলে রাজা সন্তুষ্ট থাকতেন। জানা গেছে যে, বিজয়নগর রাজ্য থেকে মোট ১২,০০০,০০০ মুদ্রা রাজস্ব আদায় হত। এর অর্থাংশ প্রাদেশিক শাসনকর্তারা নিত।

বিজয়নগরের শাসন ব্যবস্থায় সামন্ত প্রভুদের ক্ষমতা

  • (১) বিজয়নগরের শাসনব্যবস্থায় সামন্ত ভূস্বামী বা অমরনায়কদের বিশেষ স্থান ছিল। অমরনায়করা রাজাকে যুদ্ধের সময় নির্দিষ্ট সংখ্যক সেনা যোগাত। তার বিনিময়ে তারা জাগীর ভোগ করত। এই সকল অমরনায়ক বা সামন্তরা যে রাজস্ব আদায় করত তার থেকে সেনার খরচা কেটে নিয়ে বাকি রাজস্ব সরকারে জমা দিত।
  • (২) সাধারণত আদায়ী রাজস্বের ১/৩ অংশ তারা জমা দিত। সামন্ত প্রভুরা মন্দিরগুলিরও বিভিন্ন অধিকার ভোগ করত। মন্দিরের জমি ক্ষুদ্র সামন্তদের মধ্যে বন্দোবস্ত দেওয়া হত।
  • (৩)  সামন্ত ভূস্বামীদের প্রভাব ও ক্ষমতা এত বেড়ে যায় যে, শহর, সমুদ্র বন্দর ও বাজারগুলির প্রশাসনও তারা অধিকার করে। এই সকল স্থানেও তারা কর ও শুল্ক আদায় করত। এর ফলে সামন্ত প্রভুরা অসাধারণ ধনশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু সাধারণ লোকের অবস্থা তত ভাল ছিল না।
  • (৪) এই সামন্ত প্রভুদের যে জাগীর দেওয়া হত তার নাম ছিল ‘অমরম’। এই সামন্ত প্রভুদের দক্ষিণী নাম ছিল ‘পলিয়ার’ বা পলিগার। তারা সুযোগ পেলেই কেন্দ্রীয় সরকারকে অমান্য করত।

বিজয়নগরের গ্ৰামীণ শাসন ব্যবস্থা

গ্রামগুলিতে পঞ্চায়েত বা গ্রামসভাগুলি শাসন করত। তবে ব্রাহ্মণেরা অনেক সময় গ্রামসভাগুলিতে প্রাধান্য ভোগ করত। গ্রামের আবাদী জমি গ্ৰামবাসীদের মধ্যে ভাগ করা হত। পতিত জমি ছিল গ্রামের যৌথ সম্পত্তি। তামিলনাডুতে জলসেচযুক্ত জমি বেশী ছিল। তলার বা গ্রামরক্ষী, বেগার বা শ্রমিকদের দলপতি গ্রামে নিযুক্ত হত। গ্রাম প্রধানের উপাধি ছিল আইয়ার (Ayayar)।

বিজয়নগরের শাসন ব্যবস্থায় ভূমি রাজস্ব

  • (১) বিজয়নগরের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার ভূমি রাজস্ব ছিল। জমির উৎপাদন অনুসারে রাজস্ব স্থির করা হত। অমরনায়করা জমিতে ইচ্ছামত কর ধার্য করত। এমন কি জমিতে রায়তের অধিকার তারা স্বীকার করত না।
  • (২) রাজকীয় খাস জমিতেও করের হার বেশী ছিল। ভূমিকর ছাড়া গোচারণ কর, বিবাহ কর প্রভৃতি তাদের দিতে হত। এজন্য ১৩৭৯, ১৫০৬, ১৫৫১ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরে বিরাট কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। বৈদেশিক পর্যটকরা সম্ভবত বিজয়নগরের গ্ৰামাঞ্চলে যাননি। এজন্য গ্রামের অবস্থা সম্পর্কে তাদের সঠিক ধারণা ছিল না।
  • (৩) কৃষকরা ঠিক কি পরিমাণ ভূমিকর দিত তা জানা না গেলেও, একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, একই জমিতে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন প্রকার ফসল ফললে, সকল প্রকার ফসলের ভাগ তাদের দিতে হত। এছাড়া বিবাহ কর, সামরিক কর, বিক্রয় করও তারা দিত।

বিজয়নগরের বিচার ব্যবস্থা

রাজা ছিলেন রাজ্যের সর্বোচ্চ বিচারক। তবে তিনি বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া বিচারের কাজে অংশ নিতেন না। বিচার ব্যবস্থার জন্য বিজয়নগরে বিচারক ও প্রশাসনিক কর্মচারীদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ব্রাহ্মণেরা দণ্ড ও আইনের বিধান দিতেন। অপরাধীকে জরিমানা কারাদণ্ড, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা ও মৃত্যুদণ্ডের দ্বারা শাস্তি দেওয়া হত। অপরাধীর অঙ্গচ্ছেদ বা হাতির পায়ের তলায় ফেলে বধ করাও হত।

বিজয়নগরের সামরিক শাসন

সেনাদলের প্রধানের উপাধি ছিল দণ্ডনায়ক বা ধন্নায়ক। রাজার সামন্ত সেনা ছাড়া নিজস্ব সেনাদল ছিল। এই সেনাদলে হিন্দু-মুসলিম সকল শ্রেণীর লোক নিয়োগ করা হত। সেনাদলকে শক্তিশালী করার জন্য পর্তুগীজদের সাহায্যে আরবদেশ থেকে ভাল ঘোড়া আনা হত এবং তুর্কী তীরন্দাজ নিয়োগ করা হত।

বিজয়নগরের শাসন ব্যবস্থার ত্রুটি

  • (১) বিজয়নগরের শাসনব্যবস্থার প্রধান দুর্বলতা ছিল প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সামন্ত ভূস্বামীদের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা। সিংহাসনে দুর্বল রাজা বসলেই এরা বিচ্ছিন্নতাবাদের ধ্বজা তুলে ধরত।
  • (২) বিজয়নগরের রাজারা শিল্পবাণিজ্যের উন্নতির জন্য ধারাবাহিক চেষ্টা না করে কেবলমাত্র ভূমি-রাজস্ব ও কৃষি সম্পদের ওপর নির্ভর করায় রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে।

উপসংহার :- স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের সফলতা রাজার বাক্তিগত যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে। কৃষ্ণদেব রায়ের পর যোগ্য রাজার অভাবে বিজয়নগরের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

(FAQ) বিজয়নগর রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বিজয়নগর রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন কে?

রাজা।

২. বিজয়নগর রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কি নামে পরিচিত?

মহাপ্রধান।

৩. বিজয়নগর রাজ্যের প্রাদেশিক শাসনকর্তা কি নামে পরিচিত ছিল?

নায়ক বা নায়েক।

৪. বিজয়নগর রাজ্যের সেনাদলের প্রধান উপাধি কি ছিল?

দণ্ডনায়ক।

Leave a Comment