হুমায়ুনের ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ প্রসঙ্গে বাবরের সাম্রাজ্যের সাংগঠনিক দুর্বলতা, শূন্য রাজকোষ, বাবরের সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা, দুর্বল উত্তরাধিকার, হুমায়ূনের চারিত্রিক দুর্বলতা, অযথা সময় নষ্ট দুর্বল চিত্তের মানুষ, হুমায়ুনের ভ্রাতাদের ভূমিকা, হুমায়ুনের নীতিগত ত্রুটি, দুর্বল গুপ্তচর ব্যবস্থা ও হুমায়ুনের বাস্তব জ্ঞানের অভাব সম্পর্কে জানবো।
হুমায়ুনের ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ
ঐতিহাসিক ঘটনা | হুমায়ুনের ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ |
রাজা | হুমায়ুন |
রাজত্ব | ১৫৩০-৪০ এবং ১৫৫৫-৫৬ খ্রি |
পূর্বসূরি | বাবর |
উত্তরসূরি | আকবর |
ভূমিকা :- হুমায়ুন তার পিতার কাছ থেকে এক বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য পেলেও শীঘ্রই তা হারিয়ে ফেলেন। যদিও শেষ জীবনে এই সাম্রাজ্যের কিছু অংশ তিনি পুনরুদ্ধার করেন কিন্তু তা ছিল সেই বৃহৎ সাম্রাজ্যের ভগ্নাংশ মাত্র।
বাবরের সাম্রাজ্যের সাংগঠনিক দুর্বলতা
- (১) হুমায়ুনের এই ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, তাঁর পিতা বাবর যে সাম্রাজ্য ও শাসনব্যবস্থা রেখে যান তা এত দুর্বল, কাঠামোহীন ও ভঙ্গুর ছিল যে হুমায়ুনের পক্ষে তা রক্ষা করা সম্ভব হয় নি।
- (২) বাবর তাঁর সাম্রাজ্যের ওপর কোনো কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্থাপন করেন নি। স্থানীয় জাগীরদাররা নিজ ইচ্ছামত রাজ্য শাসন করত। এজন্য বলা হয় যে, বাবরের সাম্রাজ্য ছিল কতকগুলি স্বয়ং-শাসিত জাগীরের সমষ্টিমাত্র।
হুমায়ুনের নিকট বাবরের শূন্য রাজকোষ
বাবর রাজকোষ শূন্য রেখে যান এবং কোন সুষ্ঠু রাজস্ব ব্যবস্থা স্থাপন করেন নি। এর জন্য তাঁর উত্তরাধিকারী হুমায়ুন ঘোরতর সঙ্কটে পড়েন। অর্থাভাবে তিনি কোনো ভাল সেনাদল গড়ে তুলতে পারেন নি।
বাবরের সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা
বাবরের সেনাদল ছিল তুর্কী, ইরানী, হিন্দুস্থানী, মোঙ্গল জাতি নিয়ে তৈরি। এতে কোনো একতা ও জাতীয়তা ছিল না। বাবরের প্রতি এই সেনাদলের ব্যক্তিগত আনুগত্য ছিল। কিন্তু হুমায়ুনের প্রতি তাদের বিশেষ আনুগত্য ছিল না।
হুমায়ুনের নিকট দুর্বল উত্তরাধিকার
বাবর আফগান শক্তিকে পুরোপুরি দমন করেন নি। এজন্য তাঁর মৃত্যুর পর গুজরাটে বাহাদুর শাহ ও বিহারে শেরশাহ-এর অভ্যুত্থান ঘটে। এই দুর্বল উত্তরাধিকার নিয়ে হুমায়ুনের পক্ষে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভ করা সম্ভব ছিল না।
হুমায়ুনের চারিত্রিক দুর্বলতা
- (১) হুমায়ুনের চারিত্রিক দুর্বলতা ও নীতিগত ত্রুটির জন্য তাঁকে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়। যদি আকবরের মত লোক বাবরের উত্তরাধিকারী হতেন তবে বাবরের অসম্পূর্ণ কাজকে সমাপ্ত করে তিনি আপন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন।
- (২) কিন্তু লেনপুলের মতে হুমায়ুনের চরিত্রে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, জেদ ও অধ্যবসায়ের অভাব ছিল। তাছাড়া হুমায়ুন অহিফেনে আসক্ত হওয়ায় তার স্বাভাবিক উদ্যম ও কর্মশক্তি কমে যায়।
হুমায়ুনের অযথা সময় নষ্ট
তিনি কোনো বিষয়ে আংশিক সফলতার পর আমোদ-প্রমোদে অযথা সময় নষ্ট করতেন। গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ পরাস্ত হয়ে পালিয়ে গেলে তিনি মাণ্ডুতে কালক্ষেপ করেন। শের শাহ গৌড় থেকে চলে গেলে হুমায়ূন ৮- মাস গৌড়ে অযথা কালক্ষেপ করেন।
দুর্বল চিত্তের মানুষ হুমায়ুন
হুমায়ুন ছিলেন দুর্বল চিত্ত। তিনি তাঁর ভ্রাতাদের প্রতি কোমলতা দেখিয়ে পরে অনুতাপ করতে বাধ্য হন। মনুষ্য চরিত্র বিচার করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। বিদ্রোহীদের প্রতি তিনি অযথা ক্ষমা দেখাতেন। এর ফলে ক্ষমাপ্রাপ্ত বিদ্রোহীরা পুনরায় তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করত। কামরান ও মহম্মদ জামান মির্জা তার প্রতি এরূপ আচরণ করেন।
হুমায়ুনের ভ্রাতাদের ভূমিকা
- (১) ডঃ আর. পি. ত্রিপাঠী বলেন যে, হুমায়ুনের ভ্রাতারা গোড়া থেকে তাঁর বিরোধী ছিলেন না। কামরান প্রথম ১০ বছর হুমায়ুনের কোনো বিরোধিতা করেন নি। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি বুঝতে পারেন যে, হুমায়ুনের রাজ্য শাসনের ক্ষমতা নেই, তখনই তিনি তাঁর বিরোধিতা করেন।
- (২) কিন্তু ডঃ ত্রিপাঠীর এই অভিমতের বিরুদ্ধে বলা যায় যে, যদি কামরান ও আসকারি চৌসার যুদ্ধ ও বিলগ্রামের বা কনৌজের যুদ্ধ-এ হুমায়ুনকে সাহায্য করতেন তবে হুমায়ুনের ভাগ্য বিপর্যয় হত না।
হুমায়ুনের নীতিগত ত্রুটি
নীতির দিক থেকে হুমায়ুন বেশ কয়েকটি মারাত্মক ভুল করেন। যেমন –
- (১) তিনি তাঁর সাম্রাজ্য ভ্রাতাদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে নিজেকে দুর্বল করে ফেলেন। উত্তর-পশ্চিমে কান্দাহার, আফগানিস্তান ও পাঞ্জাব তাঁর হাতছাড়া হওয়ায় হুমায়ুন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থান হারান। এই অঞ্চল থেকেই যোদ্ধৃ সেনা আসত।
- (২) হুমায়ুন রণনীতির দিক থেকে বেশ কয়েকটি মারাত্মক ভুল করেন। বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণে রত হলে তিনি নিস্ক্রিয় থেকে তাঁর শক্তি বৃদ্ধি করেন। বাহাদুর শাহ যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে পালিয়ে গেলে তার ক্ষমতাকে চূড়ান্ত ধ্বংস না করে তিনি ফিরে আসেন। শের শাহের শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকলে তিনি গোড়ায় তা অগ্রাহ্য করেন।
রাজস্ব সংগঠনের কাজে হুমায়ুনের ব্যর্থতা
- (১) রাজনৈতিক সমস্যার মোকাবিলা ও যুদ্ধবিগ্রহের কাজে হুমায়ুন এত ব্যস্ত থাকেন যে, তিনি রাজস্ব সংগঠনের কাজে দৃষ্টি দিতে সময় পাননি। এর ফলে তাকে নিদারুণ অর্থ সংকটে ভুগতে হয়।
- (২) চম্পানীর দুর্গ দখলের পর এই দুর্গে প্রচুর ধনরত্ন তাঁর হাতে আসে। কিন্তু তিনি তৎপরতার সঙ্গে এই অর্থ দিল্লীতে স্থানান্তর না করায়, এই অর্থ শেষ পর্যন্ত তাঁর হাতছাড়া হয়।
হুমায়ুনের দুর্বল গুপ্তচর ব্যবস্থা
সম্রাট হুমায়ুনের গুপ্তচর ও সংবাদ আদান-প্রদান বিভাগ ভয়ানক দুর্বল ছিল। এজন্য তিনি তাঁর প্রধান শত্রু শের খাঁর গতিবিধির খবর যথাসময়ে পান নি এবং তাঁর ভ্রাতাদের চক্রান্তের কথা জানতে পারেন নি।
হুমায়ুনের বাস্তব জ্ঞানের অভাব
তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তব জ্ঞানের অভাব দেখান। শের শাহের মত কূটবুদ্ধি, ক্ষিপ্র, চতুর, চিতা বাঘের মত ধূর্ত, সাহসী শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলার জন্য তাঁর যথেষ্ট তৎপরতা ও দূরদৃষ্টি দেখানো উচিত ছিল। হুমায়ুন অনেকটা ভাগ্যবাদী ছিলেন।
উপসংহার :- স্ট্যানলী লেনপুলের মতে “তৈমুর বংশের ভাগ্য বিড়ম্বিত শাসকদের মধ্যে তিনিই ছিলেন যোগ্যতায় শ্রেষ্ঠ। ভাগ্যের উদাসীনতা তাঁকে বিফলতা বরণে বাধ্য করে। তিনি সারাজীবন ধরে বারে বারে বিফলতা বরণ করেন এবং বারে বারে সফলতাও অর্জন করেন” (He tumbled through life and tumbled out of it)।
(FAQ) হুমায়ুনের ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ভাগ্যবান।
শেরশাহ।
১৫৩০-৪০ এবং ১৫৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ।
আকবর।