ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতির প্রতিক্রিয়া

ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতির প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে আধুনিক মত, ধর্ম নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রকৃতি, জাঠ বিদ্রোহ, সৎনামী বিদ্রোহ, বুন্দেলা বিদ্রোহ, শিখ বিদ্রোহ সম্পর্কে জানবো।

ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতির প্রতিক্রিয়া

ঐতিহাসিক ঘটনাঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতির প্রতিক্রিয়া
রাজত্বকাল১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ
জাঠ বিদ্রোহ১৬৬৯ এবং ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দ
সৎনামী বিদ্রোহ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দ
বুন্দেলা বিদ্রোহ১৬৭১ খ্রিস্টাব্দ
ঔরঙ্গজেবের ধর্ম নীতির প্রতিক্রিয়া

ভূমিকা :- ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে জাঠ, সৎনামী, বুন্দেলা, শিখ, রাজপুত ও মারাঠারা বিদ্রোহঘোষণা করে। স্যার যদুনাথ সরকার ও তাঁর অনুগামী ঐতিহাসিকেরা এই বিদ্রোহগুলিকে ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন।

আধুনিক মত

সাম্প্রতিককালে ইরফান হাবিব, সতীশ চন্দ্র, গৌতম ভদ্র প্রমুখ ঐতিহাসিক ও গবেষকরা এগুলিকে কৃষক বিদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের মতে, নিছক ধর্মীয় কারণই নয়—এগুলির পশ্চাতে গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণনিহিত ছিল।

বিদ্রোহের প্রকৃতি

  • (১) স্থানীয় রাজকর্মচারীদের অত্যাচার ও বলপূর্বক রাজস্ব আদায় কৃষকদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করে এবং সেই সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের অনুদার ধর্মীয় নীতি তাদের মধ্যে ঐক্যবোধ এনে দেয়।
  • (২) জাঠ ও সৎনামী বিদ্রোহের পশ্চাতে কৃষি-ভিত্তিক একটি পটভূমি ছিল। উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব নিয়েই রাজপুত বিদ্রোহের সূত্রপাত, মারাঠা বিদ্রোহ ছিল স্থানীয় স্বাধীনতার আন্দোলন।
  • (৩) শিখদের সঙ্গে বিরোধের পশ্চাতে ধর্মীয় কারণ থাকলেও রাজনীতির ভূমিকাও নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর ছিল না।

জাঠ বিদ্রোহ

  • (১) দিল্লি ও মথুরা অঞ্চলে বসবাসকারী জাঠরা ছিল মূলত কৃষিজীবী এবং মোগলদের বিরুদ্ধে পূর্বেও তারা বিদ্রোহ করেছিল। তারা সরকারকে উচ্চহারে কর দিতে আপত্তি জানায়।
  • (২) বাদশাহের আর্থিক সংকট দূর করার জন্য মথুরার ফৌজদার আবদুন নবি জাঠ কৃষকদের কাছ থেকে বলপূর্বক ১৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব আদায় করলে তারা প্রবল ক্ষুব্ধ হয়।
  • (৩) তিনি মথুরা নগরীতে একটি হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মথুরার বিখ্যাত কেশব রায়ের মন্দিরে দারাশিকো একটি পাথরের রেলিং তৈরি করেছিলেন। আবদুন নবি তা ভেঙ্গে দেন।
  • (৪) এই সব কারণে ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে মথুরার ফৌজদার আবদুন নবির বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে স্থানীয় জমিদার গোকলা-র নেতৃত্বে জাঠ বিদ্রোহের সূচনা হয়। দলে দলে বহু কৃষক ও জমিদার এই বিদ্রোহে সামিল হয়।
  • (৫) বিদ্রোহীদের হাতে আবদুন নবি নিহত হয় এবং তারা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ব্যাপক লুঠতরাজ শুরু করে। মোগল বাহিনী কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করে এবং তাদের হাতে গোকলা নিহত হন। জাঠদের ওপর নিষ্ঠুর দমননীতি চালানো হয়।
  • (৬) ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে রাজারাম-এর নেতৃত্বে জাঠরা দ্বিতীয়বার বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং দিল্লি-আগ্রা অঞ্চলে ব্যাপক লুঠতরাজ চালায়। যুদ্ধে রাজারাম নিহত হলে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র চূড়ামন বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। শেষ পর্যন্ত চূড়ামনের নেতৃত্বে জাঠরা ভরতপুরে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়।

সংগ্রামী বিদ্রোহ

  • (১) পাতিয়ালা ও আলোয়ার অঞ্চলে ‘সৎনামী’ নামে একটি হিন্দুভক্ত – সম্প্রদায় বসবাস করত।১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে এই ধর্মীয় সম্প্রদায়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। কৃষিকার্য ও ছোটখাট ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা জীবনধারণ করত।
  • (২) তারা বিভিন্ন বর্ণ বা হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ করত না। ক্ষেতে কর্মরত জনৈক সৎনামী চাষির সঙ্গে মোগল রাজকর্মচারীর বিবাদ ও কর্মচারীটির প্রাণহানিকে কেন্দ্র করে সংনামী বিদ্রোহের সূচনা হয় (১৬৭২ খ্রিঃ)।
  • (৩) এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন গরীবদাস হাডা নামে জনৈক ব্যক্তি। তাঁর নেতৃত্বে অচিরেই এই বিদ্রোহ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। বিদ্রোহ চলাকালে তারা কর আদায় করত এবং নিজেদের পৃথক থানা প্রতিষ্ঠিত করে।
  • (৪) শেষ পর্যন্ত তারা পরাজিত হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, স্থানীয় বহু হিন্দু রাজপুত জমিদার মোগলদের পক্ষে অস্ত্রধারণ করেছিল।

বুন্দেলা বিদ্রোহ

  • (১) বুন্দেলারা ছিল মধ্য ভারতের এক রাজপুত গোষ্ঠী। ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতির প্রতিবাদে তাঁর রাজত্বকালের সূচনায় বুন্দেলখণ্ডের রাজা চম্পৎ রায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁর বিদ্রোহ সফল হয় নি —যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনিআত্মহত্যা করেন।
  • (২) তাঁর পুত্র ছত্রশাল ১৬৭১ খ্রিস্টাব্দে নির্যাতিত হিন্দুদের সংঘবদ্ধ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও বুন্দেলা বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের স্তরে উন্নীত হয়।
  • (৩) ১৭৩১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্বে পূর্ব মালবে তিনি একটি স্বাধীন হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠিত করেন।

শিখ বিদ্রোহ

  • (১) শিখ সম্প্রদায়ও ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অবতীর্ণ হয়। শিখ গুরু অর্জুনকেপ্রাণদণ্ড দিয়ে জাহাঙ্গীর শিখদের বিরাগভাজন হন।
  • (২) ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে শিখশুরু নির্বাচনে তাঁর হস্তক্ষেপ এবং নবম গুরু তেগবাহাদুরের প্রাণদণ্ড ( ১৬৭৫ খ্রিঃ) শিখদের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভের সঞ্চার করে।
  • (৩) দশম গুরু গোবিন্দ সিংহ শিখদের নিয়ে শক্তিশালী ‘খালসা’ বাহিনী গঠন করে মোগলদের বিরুদ্ধে এক দুর্জয় প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলেন। ঔরঙ্গজেবের পক্ষে তাঁকে দমন করা সম্ভব হয় নি।
  • (৪) অনেক গবেষকের মতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণেই ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে শিখদের বিরোধ বাধে। তেগবাহাদুর ও গুরু গোবিন্দ শিখপন্থের জন্য প্রজাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতেন, তাঁরা গুরুদ্বার ও সামরিক বাহিনী গঠন করেন।
  • (৫) মোগল সম্রাটের পক্ষে এগুলি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এই কারণেই শিখদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাধে।

উপসংহার :- মোগল সম্রাট আকবর উদার ধর্ম নীতি গ্রহণ করে সমস্ত ধর্মের মানুষের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। কিন্তু সম্রাট ঔরঙ্গজেব অনুদার ধর্ম নীতি গ্রহণ করে অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে বিরোধিতার সম্মুখীন হন।

(FAQ) ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতির প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ঔরঙ্গজেবের ধর্ম নীতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে কি কি বিদ্রোহ হয়েছিল?

জাঠ বিদ্রোহ, সৎনামী বিদ্রোহ, বুন্দেলা বিদ্রোহ ও শিখ বিদ্রোহ।

২. জাঠ বিদ্রোহের নেতা কারা ছিলেন?

গোকলা, রাজারাম ও চূড়ামন।

৩. বুন্দেলা বিদ্রোহের নেতা কে ছিলেন?

চম্পৎরায় ও ছত্রসাল বুন্দেলা।

৪. সৎনামী বিদ্রোহের নেতা কে ছিলেন?

গরিবদাস হাডা।

৫. ঔরঙ্গজেব কোন শিখ গুরুর প্রাণদণ্ড দেন?

নবম গুরু তেগ বাহাদুর।

Leave a Comment