ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন প্রখ্যাত বাঙালি সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী হলেন রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯)। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অগ্রদূতদের একজন এবং বাংলা রেনেসাঁর অন্যতম প্রধান পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। তাঁর রচিত গ্রন্থ এবং প্রবন্ধে তিনি দেশের স্বাধীনতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় পুনর্জাগরণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। ব্রাহ্মসমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি বহু সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারমূলক কার্যক্রমে অবদান রাখেন এবং বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্তের মতো ব্যক্তিত্বদের অনুপ্রেরণা দেন।
সাহিত্যিক রাজনারায়ণ বসু
ঐতিহাসিক চরিত্র | রাজনারায়ণ বসু |
জন্ম | ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮২৬, বীরসিংহ, মেদিনীপুর, ভারত |
প্রধান পরিচিতি | সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী |
প্রধান অবদান | বাংলা রেনেসাঁ, ব্রাহ্ম সমাজ-এর প্রচার, শিক্ষা ও সংস্কার আন্দোলন |
সাহিত্যকর্ম | “ব্রাহ্মধর্ম”, “হিন্দু জাতির উৎপত্তি”, “রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিত” |
সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব | ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কেশবচন্দ্র সেন |
প্রভাবিত ব্যক্তিত্ব | স্বামী বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘোষ |
ধর্মীয় আন্দোলন | ব্রাহ্মসমাজের সক্রিয় সদস্য ও প্রচারক |
দর্শন | জাতীয়তাবাদ, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়ন |
মৃত্যু | ১৮৯৯, কলকাতা, ভারত |
ভূমিকা :- বাঙ্গালীর সমাজ, শিক্ষা, ধর্ম ও স্বদেশ ভাবনার সঙ্গে রাজনারায়ণ বসুর নাম নানাভাবেই যুক্ত। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনচর্যাও ছিল আদর্শ স্থানীয়। তাই সেকালে তিনি ঋষি আখ্যায় ভূষিত হয়েছিলেন। বাংলা রেনেসাঁর অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে তিনি বাংলার আধুনিক শিক্ষা, সাহিত্য, এবং সমাজ সংস্কারের আন্দোলনে অসামান্য অবদান রাখেন। তাঁর চিন্তাধারা ও লেখায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার প্রত্যয় প্রকাশ পেয়েছে এবং তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক প্রাথমিক ধারক হিসেবে আবির্ভূত হন। রাজনারায়ণ বসু বিদ্যাসাগর ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমসাময়িক ছিলেন এবং ব্রাহ্মসমাজের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে বহু সামাজিক সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তাঁর প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মের বহু নেতার ওপর ছিল, বিশেষত স্বামী বিবেকানন্দ এবং অরবিন্দ ঘোষের মতো ব্যক্তিত্বদের ওপর, যারা তাঁর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
রাজনারায়ণ বসুর জন্ম
১৮২৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ সেপ্টেম্বর চব্বিশ পরগনা জেলার বোড়াল গ্রামে বিখ্যাত বসু পরিবারে রাজনারায়ণের জন্ম। তাঁর পিতা নন্দকিশোর বসু ছিলেন রাজা রামমোহন রায়-এর বিশেষ অনুগত এবং কিছুকাল রাজার প্রাইভেট সেক্রেটারির কাজ করেছিলেন।
সাহিত্যিক রাজনারায়ণ বসুর আদি নিবাস
আদি নিবাস কলকাতায় হলেও রাজনারায়ণের প্রপিতামহ শুকদেব বসু দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বোড়াল গ্রামে গৃহ নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছিলেন। ইংরেজরা গোবিন্দপুরে কেল্লা নির্মাণের কাজ শুরু করলে বসু পরিবারকে বোড়ালে উঠে যেতে হয়েছিল। অবশ্য কলকাতার বাসস্থানের বদলে ইংরেজরা তাঁদের বাহির সিমলাতে বসবাসের জমি দিয়েছিল।
রাজনারায়ণ বসুর সংস্কারমুক্ত পরিবেশ
উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল, রামমোহন রায় ছিলেন তার অগ্রণী পুরুষ। রাজনারায়ণের পিতা রামমোহনের সংস্পর্শে এসে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং ধর্ম বিষয়ে উদার ভাব লাভ করেছিলেন। তাঁদের বোড়ালের বাড়িতে রাজা প্রায়ই বেড়াতে আসতেন। ফলে সমগ্র পরিবারটিই সংস্কারমুক্ত আধুনিক প্রগতিবাদী চিন্তার দ্বারা পরিপুষ্ট হয়েছিল।
সাহিত্যিক রাজনারায়ণ বসুর প্রাথমিক শিক্ষা
এই পারিবারিক পরিবেশের মধ্যেই রাজনারায়ণের প্রাথমিক শিক্ষা লাভ সম্পন্ন হয়েছিল। বাল্য বয়সেই তিনি সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি ও সাধারণ বাংলা শব্দের ইংরাজি প্রতিশব্দ কণ্ঠস্থ করেন।
রাজনারায়ণ বসুর স্কুল জীবন
- (১) পিতার সঙ্গে তিনি কলকাতায় আসেন সাত বছর বয়সে এবং স্থানীয় এক পাঠশালায় ভর্তি হন। পরে বউবাজার অঞ্চলের একটি স্কুলে পড়াশুনা করেন। তৎকালের স্কুল সোসাইটি ইংরাজি শিক্ষাদানের জন্য হেয়ার সাহেবের তত্ত্বাবধানে যে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল, পরবর্তী সময়ে হেয়ার সাহেবের নামেই সেই স্কুলের নাম হেয়ার স্কুল হয়েছিল।
- (২) কিছুদিন স্কুলে পড়াশুনা করে রাজনারায়ণ এই হেয়ার স্কুলে এসে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি শিক্ষকরূপে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর পিতা বাবু দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনি ছিলেন ইংরাজি সাহিত্যের শিক্ষক। রাজনারায়ণ বাল্যবয়স থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল অসাধারণ। এ কারণে স্কুলের পাঠ্য বইয়ের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ের বই তাঁর পাঠসহচর হয়ে উঠেছিল।
- (৩) এইভাবেই একসময় তাঁর হাতে পড়ে Chevalier Ramsay রচিত Travels of Cyrus নামক গ্রন্থটি। এই গ্রন্থ অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে তিনি পাঠ করেছিলেন এবং পরিণামে প্রচলিত হিন্দু ধর্মের প্রতি তিনি আস্থা হারিয়েছিলেন। ছাত্র হিসেবে রাজনারায়ণ বরাবরই ছিলেন মেধাবী। তাই সহপাঠী ছাত্র ও শিক্ষক সকলেরই হয়ে উঠেছিলেন প্রিয়পাত্র।
সাহিত্যিক রাজনারায়ণ বসুর কলেজ জীবন
(১) স্কুলের পড়া শেষ করে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভর্তি হলেন হিন্দু কলেজে। এই কলেজেরই পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ নাম হয়েছে। এখানে তিনি সহপাঠী হিসেবে যেসব প্রতিভাশালী তরুণদের পেয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বদেশের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। মধুসূদন দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, প্যারীচরণ সরকার, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর- এরা সকলেই ছিলেন রাজনারায়ণের সহপাঠী।
(২) কলেজের অধ্যাপকরাও সকলেই ছিলেন কৃতী। ফলে এই পরিবেশে স্বভাবতই তাঁর জ্ঞানস্পৃহা আরও বৃদ্ধি পেল। তৎকালের হিন্দু কলেজ ছিল নব্য বাংলাব প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার পোষক। প্রচলিত রীতিনীতি ভঙ্গ করে স্বেচ্ছাচারী হওয়াটাই প্রগতিশীলতার পরকাষ্ঠা বলে মনে করত এখানকার ছাত্ররা। এই ছাত্রসমাজই আখ্যায়িত হয়েছে ইয়ং বেঙ্গল নামে। আর এই ইয়ং বেঙ্গলের প্রাণপুরুষ ছিলেন বাংলার নবজাগরণ-এর অগ্রদূত হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও।
(৩) মুক্ত চিন্তা ও যুক্তিবাদের নামে ছাত্রদের মধ্যে এই বিকৃত ক্রিয়াকলাপ যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কুফল ডেকে আনত তা না বললেও চলে। রাজনারায়ণও সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেন। কু-অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠে নিষিদ্ধ খাদ্য ভোজন ও মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন। মদ্যপানে এতটাই আসক্তি তাঁর বেড়ে গেল যে অল্পদিনের মধ্যেই ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। টানা ছয় মাস তাঁকে শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল। ফলে কলেজের পড়া আর এগুলো না।
রাজনারায়ণ বসুর বিবাহ
কলেজে পড়ার সময়েই রাজনারায়ণ বিবাহ করেছিলেন। অস্বাস্থ্যের কারণে কলেজ ছাড়ার কিছুদিনের মধ্যেই জলে ডুবে অকালে স্ত্রী প্রসন্নময়ীর মৃত্যু হয়। স্ত্রীর বিয়োগ ব্যথা সামলে উঠবার আগেই এলো আর এক আঘাত। পিতা নন্দকিশোর বসু পরলোকে গমন করলেন।
শিক্ষাবিদ রাজনারায়ণ বসুর ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা
পরপর শোকের আঘাতে চেতনা ফিরে এলো তাঁর, স্বভাবের উশৃঙ্খলতা দূর হল। ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। সেই বিশ্বাসও ফিরে পেলেন। তাঁর পিতা ছিলেন রামমোহন রায়ের শিষ্য। তিনিও ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করলেন।
রাজনারায়ণ বসুর দ্বিতীয় বিবাহ ও পরিবার
পরের বছরেই, একুশ বছর বয়সে, রাজনারায়ণ দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করলেন। তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী নিস্তারিণী দেবী ছিলেন হিন্দু পরিবারের কন্যা। কিন্তু স্বামী অনুগতা পত্নী বিবাহের পর স্বামীর ধর্মকেই গ্রহণ করলেন এবং তাঁরা হয়েছিলেন সুখী ও আদর্শ দম্পতি। রাজনারায়ণ তিন পুত্র ও পাঁচ কন্যার জনক হয়েছিলেন। সন্তানদের সকলকেই তিনি উপযুক্ত শিক্ষায় মানুষ করে তুলেছিলেন। কন্যাপক্ষে তিনি যে দৌহিত্র-দোহিত্রী লাভ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে আছেন মনোমোহন, শ্রী অরবিন্দ ও বিপ্লবী বারীন ঘোষ প্রমুখ স্বনামখ্যাত ইতিহাস-পুরুষগণ। এঁদের সকলেই তাঁর স্নেহের ছায়ায় লালিত-পালিত হয়েছিলেন।
উপনিষদ অনুবাদে রাজনারায়ণ বসু
দীক্ষা গ্রহণের পর তত্ত্ববোধিনী সভায় যোগ দিয়ে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজনারায়ণ উপনিষদের ইংরাজী অনুবাদের কাজ করেছিলেন।
শিক্ষক রাজনারায়ণ বসু
১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি সংস্কৃত কলেজে ইংরাজী শিক্ষকের কাজে নিযুক্ত হন। কিন্তু এই কাজ তিনি বেশিদিন করেন নি। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে সংস্কৃত কলেজের কাজ ছেড়ে মেদিনীপুর সরকারি জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। পরিচালন ব্যবস্থার ত্রুটির জন্য এই স্কুলটির তখন বিপর্যন্ত অবস্থা। দুইজন শ্বেতাঙ্গর পরিচালনায় চলছিল স্কুলটি। প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করে রাজনারায়ণ স্কুলের সর্বাঙ্গীন উন্নতির প্রতি মনোনিবেশ করলেন। প্রচলিত অনেক ব্যবস্থারই পরিবর্তন ঘটালেন তিনি।
ছাত্রদের প্রতি রাজনারায়ণ বসুর মানসিকতা
গোড়ার দিকে ছাত্রদের শারীরিক শাস্তিদানের পক্ষপাতি ছিলেন রাজনারায়ণ। পরে তিনি উপলব্ধি করেন শারীরিক পীড়নের ফলাফল শুভ ও স্থায়ী হয় না। পরিবর্তে ভালবাসা দ্বারা তাদের হৃদয় জয় করতে পারলে তার ফল হয় অধিক ফলপ্রসূ। তারপর থেকে সেইভাবেই ছাত্রদের পরিচালিত করতেন। ছাত্রদের মানসিক উন্নতি ও জ্ঞানস্পৃহা বৃদ্ধির জন্য তিনি স্কুলে বিতর্কসভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়া নতুন করে একটি পাঠাগারও স্থাপন করেছিলেন। তাঁর এই পরিবর্তিত ব্যবস্থায় ছাত্রদের প্রভূত উন্নতি হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তাঁরা যশস্বী ও কৃতী হয়ে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দীর্ঘ আঠারো বছর মেদিনীপুর স্কুলে শিক্ষকতা করে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
মেদিনীপুরে ব্রাহ্মধর্মের প্রসারে রাজনারায়ণ বসুর অবদান
- (১) পশ্চিমবঙ্গ-এর মেদিনীপুরে ব্রাহ্মধর্মের প্রসার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাজনারায়ণের প্রভৃত অবদান ছিল। এখানেই তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা স্বর্ণলতার ব্রাহ্মমতে বিবাহ দেন। এই উপলক্ষে কেশবচন্দ্র সেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী সহ বহু বিশিষ্ট ব্রাহ্ম মেদিনীপুরে উপস্থিত হয়েছিলেন।
- (২) ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে ব্রাহ্ম নেতৃবৃন্দ কলকাতায় যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন রাজনারায়ণ। তাঁর নেতৃত্বে মেদিনীপুরেও সংস্কার আন্দোলনের ঢেউ পৌঁছে গিয়েছিল। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরেও তিনি তাঁর প্রিয় কর্মক্ষেত্র মেদিনীপুরেই থেকে গিয়েছিলেন এবং ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
- (৩) সেখানে তিনি শ্রমিক-কৃষকদের শিক্ষার জন্য একটি নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্য একটি বালিকা বিদ্যালয়ও স্থাপন করেছিলেন তিনি। রাজনারায়ণ ছিলেন বিধবা বিবাহের অন্যতমন পৃষ্ঠপোষক। তিনি নিজের পরিবারেই জেঠতুতো ভাই দুর্গাচরণ বসু এবং সহোদর মদনমোহন বসুকে বিধবা কন্যা বিবাহ করান।
- (৪) এই কাজের জন্য সমাজের অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন তাঁকে হতে হয়েছিল। মেদিনীপুর ও বোড়াল গ্রামের অনেক লোকই তাঁর বিরোধী হয়ে উঠেছিল। এমনকি মায়ের তিরস্কারও তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু সকল অভিযোগ-অনুযোগ তিনি নীরবে সহ্য করেছেন। নিজের সিদ্ধান্ত থেকে কখনো বিচ্যুত হননি।
দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলায় রাজনারায়ণ বসুর অবদান
- (১) রাজনারায়ণ ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তিনি মনে করতেন দেশীয় ভাষা চর্চার দ্বারাই দেশের মানুষের ও দেশীয় সাহিত্যের উন্নতি সম্ভব। দেশবাসীর মনে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভার আয়োজন করেন। রাজনারায়ণের পরিকল্পনায় উদ্দীপিত হয়ে নবগোপালন মিত্র ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু মেলার পত্তন করেন। এই মেলার উদ্দেশ্যে ছিল দেশের শিক্ষিত মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলা।
- (২) সেইকালে ইংরাজি শিক্ষিত বাক্তিদের মধ্যে দেশীয় ভাষার প্রতি অবজ্ঞা এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে বাংলা বলতে তাঁরা লজ্জা বোধ করতেন। ইংরাজি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিই ছিল তাঁদের যত আকর্ষণ ও পক্ষপাতিত্ব। রাজনারায়ণের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভার সভ্যগণ এক নিয়ম প্রবর্তন করেছিলেন।
- (৩) নিয়মটি হল তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে আলাপে ও চিঠিপত্রাদিতে কখনও কোনো ইংরাজি শব্দ ব্যবহার করবেন না। যদি কেহ ভুল বশতঃ ও কথা বলার সময় বাংলার সঙ্গে ইংরাজি শব্দ ব্যবহার করে ফেলতেন তাঁকে প্রতিটি ইংরাজি বাক্য বা শব্দের জন্য এক পয়সা করে জরিমানা দিতে হত। রাজনারায়ণ প্রতিষ্ঠিত সভার তত্ত্বাবধানে পরে স্থাপিত হয়েছিল ন্যাশনাল স্কুল। সেখানে রসায়ন, সার্ভে, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং সঙ্গীতের সঙ্গে ব্যায়াম, অশ্বারোহন ও বন্দুক চালনা শেখানো হত।
রাজনারায়ণ বসু প্রতিষ্ঠিত সুরাপান নিবারণী সভা
সুরাপান নিবারণী সভা নামে আরও একটি উল্লেখযোগ্য সভা রাজনারায়ণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি নিজেই যৌবনে সুরা পানে আসক্ত হয়েছিলেন এবং তার পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। হৃদয়ে ধর্মভাব সঞ্চারিত হওয়ার ফলে তিনি সমস্ত প্রকার কু-অভ্যাস পরিত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই তাঁর প্রতিষ্ঠিত সভার মাধ্যমে জনসাধারণকে কুফল সম্পর্কে অবহিত করে মদ্যপান থেকে বিরত করার জন্য তিনি সচেষ্ট হন। এই সভার প্রচারের ফলে মেদিনীপুরের অনেক লোক চিরতরে মদ্যপান ত্যাগ করেছিল।
শিক্ষাবিদ রাজনারায়ণ বসুর কর্মক্ষমতা হ্রাস
সমাজের কাজে অবিরত অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে রাজনারায়ণের স্বাস্থ্য ক্রমেই ভেঙ্গে পড়ছিল। দৃষ্টিশক্তিও আসছিল ক্ষীণ হয়ে। কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় কিছুদিন বিশ্রামের জন্য তিনি বোড়ালে যাওয়ার মনস্থ করলেন। কিন্তু বিধবা বিবাহ ইত্যাদি বিষয়ে জড়িত থাকার ফলে শেষ পর্যন্ত তাঁর আর সেখানে যাওয়া হয়ে উঠল না। তিনি প্রথমে গেলেন ভাগলপুরে জ্যেষ্ঠ জামাতা কৃষ্ণধনের বাড়িতে। পরে সেখান থেকে কিছুদিন এলাহাবাদ, লখনউ ও কানপুরে বসবাস করেন।
ভারত সভার সদস্য রাজনারায়ণ বসু
কানপুরে থাকাকলীনই রাজনারায়ণ সরকারি কাজে ইস্তফা দিয়েছিলেন। কলকাতায় ফিরে এসে তিনি প্রসিদ্ধ রামনাথ কবিরাজের চিকিৎসাধীন থেকে রোগপীড়ার উপশম লাভ করেন। এই কালে তিনি দশবছর কলকাতায় অবস্থান করেন। ইতিমধ্যে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বা ভারত সভা স্থাপিত হলে তিনি তার সভ্য হন। গুপ্ত রাজনৈতিক সমিতি সঞ্জীবনী সভারও তিনি সভাপতি হয়েছিলেন। এই সভাই ছিল বাঙলার বিপ্লবী সংগঠনের অগ্রদূত।
রাজনারায়ণ বসু সম্পর্কে পত্রিকায় মন্তব্য
শিক্ষাবিদ রাজনারায়ণ যখন যেখানে গেছেন, নানা উপলক্ষে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা বিষয়ে বক্তৃতা করে জনসাধরণের হৃদয় জয় করেছেন, তাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি বহু পত্রপত্রিকায় হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা নিরূপণ করে প্রবন্ধাদি প্রকাশ করে সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তৎকালীন জাতীয়তাবাদী সোমপ্রকাশ পত্রিকা লিখেছিল, ‘হিন্দু সমাজ ডুবিতেছিল, রাজনারায়ণবাবু তাহা রক্ষা করিলেন।’
দেওঘরে রাজনারায়ণ বসু
স্বাস্থ্যোদ্ধারের উদ্দেশ্যে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে রাজনারায়ণ দেওঘর যান এবং বাড়ি নির্মাণ করে জীবনের অবশিষ্টকাল সেখানেই অতিবাহিত করেন। এখানে এসেও দেশের কল্যাণ চিন্তায় তিনি মগ্ন থাকতেন। নির্জন বাসের ফলে আধ্যাত্মিক বিষয়েও তিনি উচ্চ অবস্থা লাভ করেছিলেন। ঈশ্বরের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস ও ভক্তি সকলেরই শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিল। এই সময় দেওঘরে তিনি ‘দোসরা বৈদ্যনাথ’ নামে আখ্যাত হতেন। সকল সম্প্রদায়ের মানুষেরই শ্রদ্ধা প্রীতি লাভ করেছিলেন তিনি।
সাহিত্যিক রাজনারায়ণ বসুর গ্রন্থ
উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থও প্রণয়ন করেছিলেন রাজনারায়ণ। আত্মচরিত, সেকাল আর একাল, হিন্দু বা প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিবৃত্ত, সায়েন্স অব রিলিজিয়ন, রিলিজিয়ন অব লাভ ইত্যাদি গ্রন্থ ছাড়াও তিনি ইংরাজিতে ব্রাহ্মা ধর্ম ও আদি ব্রাহ্মা সমাজ সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেন।
রাজনারায়ণ বসুর মৃত্যু
বাংলার জাতীয় জাগরণের উদ্গাতা, বঙ্গ সংস্কৃতির পুরোধা পুরুষ ঋষিপ্রতিম রাজনারায়ণ বসু ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে দেওঘরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
উপসংহার :- উপসংহারে বলা যায়, রাজনারায়ণ বসু ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন অগ্রগণ্য বাঙালি সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ এবং সাহসী স্বাধীনতা সংগ্রামী। বাংলা নবজাগরণ বা রেনেসাঁর এই পথিকৃৎ বাংলার শিক্ষা ও সামাজিক অগ্রগতিতে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। ব্রাহ্মসমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণে সক্রিয় ছিলেন এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভাবাদর্শকে ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর জীবন ও কর্ম পরবর্তী প্রজন্মের বহু মহান ব্যক্তিত্বকে অনুপ্রাণিত করেছে, এবং তাঁর চিন্তাধারা ও আদর্শ আজও বাংলার সংস্কৃতিতে এক প্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।
(FAQ) রাজনারায়ণ বসু সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
রাজনারায়ণ বসু ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন বাঙালি সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী, যিনি বাংলা রেনেসাঁর অন্যতম অগ্রদূত ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হিসেবে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নবজাগরণের জন্য বিখ্যাত, পাশাপাশি স্বাধীনতা আন্দোলনের আদর্শের প্রচারক ছিলেন। রাজনারায়ণ বসুর লেখা ও চিন্তাধারা পরবর্তী নেতাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিল।
তিনি “ব্রাহ্মধর্ম”, “হিন্দু জাতির উৎপত্তি”, এবং “রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিত” সহ বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন, যেখানে সামাজিক ও ধর্মীয় ভাবধারার বিবরণ পাওয়া যায়।
রাজনারায়ণ বসুর চিন্তাধারা এবং আদর্শ স্বামী বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘোষসহ পরবর্তী প্রজন্মের নেতাদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হিসেবে তিনি সমাজে শিক্ষার প্রসার, কুসংস্কার দূরীকরণ, নারী শিক্ষা এবং সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন।