প্রেসিডেন্সি কলেজ

প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রসঙ্গে সরকারি কলেজ, নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব, হিন্দু কলেজের নতুন নামকরণ, ছাত্র সংখ্যা, কলকাতা কলেজের অধিভুক্ত প্রথম কলেজ, প্রথম এন্ট্রাস পরীক্ষা, এফ এ পরীক্ষা, বর্তমান অট্টালিকার উদ্বোধন, বিজ্ঞান শিক্ষার সম্প্রসারণ, জীব বিদ্যা বিভাগ, কলেজের বিশিষ্ট শিক্ষক, প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব, ভারতীয় অধ্যক্ষ সম্পর্কে জানবো।

প্রেসিডেন্সি কলেজ

বিষয়প্রেসিডেন্সি কলেজ 
পথ চলা শুরু১৮৫৫ খ্রি:
পূর্ব নামহিন্দু কলেজ
বর্তমান নামপ্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রেসিডেন্সি কলেজ

ভূমিকা :- কলকাতার হিন্দু কলেজ থেকে উদ্ভূত প্রেসিডেন্সি কলেজের ঘটনাবহুল যাত্রা শুরু হয় ১৮৫৫ সালে। কিছু প্রাসঙ্গিক ও বাধ্যতামূলক বিবেচনার কারণে এই কলেজের নতুন নামকরণ হয় প্রেসিডেন্সি কলেজ।

প্রেসিডেন্সি কলেজ সম্পর্কে ধ্যান ধারনার বিস্তার

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে হিন্দু কলেজ তার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতাদের ধ্যান-ধারণা ছাড়িয়ে যায়। কলেজটি সকল শ্রেণীর ছাত্রদের (হিন্দু ও অ-হিন্দু শিক্ষার্থী) চাহিদা অনুযায়ী আইন, অঙ্কন বিদ্যা এবং প্রকৌশল বিষয়ে পাঠ্যক্রমও প্রবর্তন করে।

সরকারি কলেজ

শিক্ষা কাউন্সিল কর্তৃক বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত কোনো কলেজ কলকাতায় না থাকায় জনগণের টাকায় পরিচালিত ক্রমবিকাশমান কলেজটিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রূপে আর রাখা যায় কিনা সরকারকে সেটাও বিবেচনা করতে হয়। বস্তুত ছোট ছোট শহরগুলিতেও সরকারি কলেজ থাকায় রাজধানীতেও একটি সরকারি কলেজ থাকা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।

নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব

সকল সম্প্রদায়ের ছাত্রদের জন্য উন্মুক্ত কলকাতা কলেজ বা মেট্রোপলিটন কলেজ নামে একটি নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু এর জন্য উপযুক্ত শিক্ষকমন্ডলী যোগাড় করা ছাড়াও সরকারের জন্য অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা হয়ে দাঁড়াত।

হিন্দু কলেজের নতুন নামকরণ

  • (১) বিকল্প হিসেবে উপযুক্ত ছিল সকল সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করে হিন্দু কলেজকে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা। সেই অনুযায়ী ১৮৫৪ সালের ১১ জানুয়ারি হিন্দু কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটি শেষবারের মতো এক সভায় মিলিত হয়।
  • (২) কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স এই কলেজের নতুন নামকরণ করে প্রেসিডেন্সি কলেজ। ১৮৫৫ সালের ১৫ জুন এই নতুন কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার পরিকল্পনা স্থগিত

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা নিকটবর্তী হলে শিক্ষা কাউন্সিল মেডিক্যাল কলেজ ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে প্রসারিত করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার পরিকল্পনা স্থগিত রাখে।

প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র সংখ্যা

১৮৫৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিল ১৩২ জন। এর মধ্যে ৯৪ জন ছিল সাধারণ শাখায় ও ৩৮ জন আইন শাখায়। এর মধ্যে ৮২ জনকে বেতন দিতে হত, ৪৩ জন বৃত্তি পেত এবং ৭ জন বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল।

প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন শাখা

আইন শাখার অবস্থান ছিল কিছুটা আলাদা। অধ্যাপকবৃন্দ নিজেরাই এর ছাত্রদের পরীক্ষা নিতেন। দুবছর পর আইন বিভাগের ছাত্র বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের প্রথম দুজন স্নাতকের অন্যতম একজন হওয়ার সম্মান অর্জন করেছিলেন।

কলকাতা কলেজের অধিভুক্ত প্রথম কলেজ

  • (১) ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সেদিক থেকে এই বছরটি ছিল প্রকৃতপক্ষে অতি গুরুত্ববহ। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অধিভুক্ত কলেজগুলির পাঠক্রম নির্ধারণ করতে হত।
  • (২) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রথম কলেজ হল প্রেসিডেন্সি কলেজ। তাই আশা করা হয়েছিল যে প্রেসিডেন্সি কলেজ বি.এ পরীক্ষার জন্য পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুত করার একটি প্রতিষ্ঠান হবে।

প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম এন্ট্রাস পরীক্ষা

১৮৫৭ সালে আয়োজিত প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ২৩ জন পরীক্ষার্থী পাঠানো হয়। ১৮৬৩ সালে প্রথম বারের মতো এই কলেজের ৬ জন ছাত্রকে এম.এ ডিগ্রি দেওয়া হয়।

প্রেসিডেন্সি কলেজে এফ.এ পরীক্ষা

১৮৬২ সালে এফ.এ বা ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষার প্রচলন হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া প্রথম পরীক্ষার্থী ছিলেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্যও হয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজের গিলক্রিস্ট বৃত্তি

ইংল্যান্ড-এ পড়াশোনা করার জন্য ১৮৬৮ সালে প্রবর্তিত মর্যাদাপূর্ণ ‘গিলক্রিস্ট বৃত্তি’ এই কলেজের ছাত্ররা পর পর চার বছর লাভ করেছিল।

প্রেসিডেন্সি কলেজের বর্তমান অট্টালিকার উদ্বোধন

ধীরে ধীরে কলেজটি তার ক্যাম্পাস সম্প্রসারিত করে। ১৮৭৪ সালের ৩১ মার্চ ভাইসরয়ের উপস্থিতিতে লেফটেন্যান্ট গভর্নর আনুষ্ঠানিকভাবে বর্তমান অট্টালিকার উদ্বোধন করেন। নফরচন্দ্র পাল চৌধুরী এই অট্টালিকার চূড়ায় স্থাপনের জন্য একটি ঘড়ি দান করেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজে বৈজ্ঞানিক শিক্ষা সম্প্রসারণ

বৈজ্ঞানিক শিক্ষা সম্প্রসারণের কারণে নতুন ভবনে নতুন কক্ষ নির্মাণ করা হয়। ১৮৭৫ সাল থেকে রসায়ন বিভাগ ব্যবহারিক ক্লাশ চালু করতে সক্ষম হয়। ১৮৮০ সালে হাওড়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ক্লাশগুলি কলেজে নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

প্রেসিডেন্সি কলেজের জীব বিদ্যা বিভাগ

বিজ্ঞান অনুষদকে সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য ১৮৯২ সালে ভূ-বিদ্যার অধ্যাপকের একটি পদ প্রবর্তন করা হয়। আট বছর পর এখানে জীববিদ্যা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

প্রেসিডেন্সি কলেজের বিশিষ্ট শিক্ষক

উনিশ শতকের শেষ দিকে কয়েকজন বিশিষ্ট পন্ডিত প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে এইচ. এম পার্সিভাল, ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে বিপিনবিহারী গুপ্ত, ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জগদীশচন্দ্র বসু, ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে মনমোহন ঘোষ এই কলেজে যোগদান করেন।

প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ

১৮৬৮ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই কলেজের ২৫ জন ছাত্র পান্ডিত্যের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত সর্বোচ্চ সম্মান প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেছিলেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজে বাণিজ্য বিষয়ে পাঠদান

১৯০৩ সালে এই কলেজে বাণিজ্য বিষয়ে পাঠদান যুক্ত হয়।

প্রেসিডেন্সি কলেজে বেকার গবেষণাগার

১৯১৩ সালের ২০ জানুয়ারি লেফটেন্যান্ট গভর্নর এডওয়ার্ড বেকারের নামানুসারে ‘বেকার গবেষণাগার’ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। এরপর পদার্থবিদ্যা, শরীরবৃত্ত, উদ্ভিদবিদ্যা এবং ভূ-বিদ্যা বিভাগ নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়। বেকার গবেষণাগারের সর্ববৃহৎ কক্ষগুলির মধ্যে একটিতে বিজ্ঞান গ্রন্থাগারকে (অধ্যাপক সি.ডব্লিউ পিকের নাম অনুসারে পিক গ্রন্থাগার) স্থান দেওয়া হয়।

প্রেসিডেন্সি কলেজের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব

১৯১৪ সালে সংঘটিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ একটি অতিরিক্ত ছাত্রাবাস নির্মাণ এবং সমতুল্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির কাজকে ব্যাহত করে। তবে শিক্ষাদান ও উচ্চশিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে কলেজটি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মাইলফলক অতিক্রম করে।

প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ জে.আর ব্যারো

  • (১) অসহযোগ আন্দোলন ও আইন অমান্য আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলিতে জে.আর ব্যারো কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয়তাবাদী আবেগে উচ্ছ্বসিত ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
  • (২) তিনি কলেজের শৃঙ্খলা ও শিক্ষার সর্বোচ্চ মান বজায় রেখেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কখনও কোনো সন্দেহ ছিল না এবং তিনি শিক্ষক ও ছাত্রদের গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযথ স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজের ভারতীয় অধ্যক্ষ

বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক থেকে ভারতীয় অধ্যক্ষবৃন্দ কলেজের প্রধান ছিলেন। অবশ্য ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত শিক্ষা বিভাগ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের দায়িত্বে বহাল রেখেছিলেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজের দুটি পরিষদ

১৯৩০ সালের ত্রিশের দশকে ‘রবীন্দ্র পরিষদ’ এবং ‘বঙ্কিম-শরৎ পরিষদ’ গঠনের ফলে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড প্রেরণালাভ করে এবং এই সংগঠন দুটি তাদের কর্মকান্ডে প্রমথ চৌধুরী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত, শান্ত সেন, নির্মলকুমারী মহলানবীশ, ইন্দিরা দেবী, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, রানী ছন্দা, সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। পরিষদের কয়েকটি সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সভাপতিত্ব করেছিলেন।

পঞ্চাশের মন্বন্তরে প্রেসিডেন্সি কলেজের ত্রাণকার্য

১৯৪৩ সালে বাংলার মহাদুর্ভিক্ষ বা পঞ্চাশের মন্বন্তর-এর সময় অম্লানকুসুম দত্তের নেতৃত্বে বহু ছাত্র উদ্দীপ্ত হয়ে হিন্দু হোস্টেল থেকে ত্রাণকাজ পরিচালনা করে।

প্রেসিডেন্সি কলেজের উপর স্বাধীনতা ও দেশবিভাগের প্রভাব

স্বাধীনতা ও দেশ-বিভাগের আগের সাম্প্রদায়িক বিবাদের অন্ধকার দিনগুলিতে কলেজ তার অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি বজায় রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু দেশ-বিভাগের অব্যবহিত পর  কুদরত-ই-খুদার মতো পন্ডিত ও শিক্ষকবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তান-এ চলে যান।

উপসংহার :- এই কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দীর্ঘকাল অতিবাহিত করে। ১৯৭২ সালে এই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার দাবি উত্থাপন করা হয়। ২০১১ সালে এই কলেজটি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।

(FAQ) প্রেসিডেন্সি কলেজ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. প্রেসিডেন্সি কলেজের পথ চলা শুরু হয় কখন?

১৮৫৫ সালে।

২. প্রেসিডেন্সি কলেজের পূর্ব নাম কি ছিল?

হিন্দু কলেজ।

৩. প্রেসিডেন্সি কলেজ কখন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়?

২০১১ সালে।

Leave a Comment