বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে ভগিনী নিবেদিতার অভিমত, বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমি, স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া, স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের কর্মসূচি, সাহিত্য ও পত্রিকার ভূমিকা, স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের বিস্তার, স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা, বঙ্গভঙ্গের প্রত্যাহার, স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন সম্পর্কে জানবো।
বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন প্রসঙ্গে স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন, জেলায় জেলায় সমিতি গঠন, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে মুসলিম মানসিকতা, স্বয়ংসম্পূর্ণ আন্দোলন, স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের বিকাশ, লর্ড কার্জনের বাংলা ভাগ করার সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় স্বদেশী আন্দোলন, স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের পটভূমি, স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের বিস্তার, স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে জানব।
বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন
ঐতিহাসিক ঘটনা | বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন |
সূচনাকাল | ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ |
কারণ | বঙ্গভঙ্গ |
উদ্দেশ্য | বঙ্গভঙ্গ রদ |
রাখি বন্ধন প্রস্তাব | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
ভূমিকা :- ভারত-এ ব্রিটিশ শাসনের এক কলঙ্কজনক ঘটনা ছিল বঙ্গবিভাগের সিদ্ধান্ত। লর্ড কার্জনের নেতৃত্বে ইংরেজ সরকারের এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সারা দেশে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
নিবেদিতার অভিমত
ভগিনী নিবেদিতার মতে, স্বদেশী ও বয়কট হল একই জিনিসের দুটি প্রয়োজনীয় দিক। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি বিকশিত হতে পারে না (“Swadeshi and Boycott are the two necessary aspects of one and the same thing. One cannot flourish and strive without the help of the other”)।
স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের পটভূমি
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত সরকারি ভাবে ঘোষিত হলে দেশের সর্বস্তরের মানুষ ও পত্রপত্রিকা গুলি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া
- (১) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বেঙ্গলী পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তকে এক গুরুতর জাতীয় বিপর্যয় বলে মন্তব্য করেন।
- (২) ‘হিতবাদী’ পত্রিকা মন্তব্য করে যে, “ বিগত ১৫০ বছরের মধ্যে বাঙ্গালী জাতি এরকম দুর্দিনের সম্মুখীন হয়নি।”
- (৩) লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি নিউজ পত্রিকা বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তকে অদূরদর্শী রাজনৈতিক চিন্তার ফসল বলে অভিহিত করে।
- (৪) জাতীয় কংগ্রেস বোম্বাই অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনাকে বাঙালীর জাতিসত্তাকে খণ্ডিত করার অপপ্রয়াস বলে অভিহিত করে।
স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের কর্মসূচি
- (১) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হবে বলে সরকার ঘোষণা করে। সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলা।
- (২) রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব অনুসারে ওই দিনটি রাখি বন্ধন দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে শুরু হয় বিরাট শোভাযাত্রা।
- (৩) অরন্ধন পালিত হয় ঘরে ঘরে। বন্ধ থাকে সমস্ত হাটবাজার, দোকানপাট। বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশী দ্রব্য গ্রহণ এই দুটি ছিল স্বদেশী আন্দোলনের প্রধান কর্মসূচি।
- (৪) সঞ্জীবনী পত্রিকার সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্র দেশবাসীকে বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণের আহ্বান জানালে তা সমস্ত স্তরের মানুষের মধ্যে সাড়া জাগায় ৷
- (৫) বস্তুত বয়কট ও স্বদেশি একই ভাবধারার দুটি প্রকাশ। বয়কট ছিল নেতিবাচক এবং স্বদেশি ছিল ইতিবাচক দিক।
সাহিত্য ও পত্র পত্রিকার ভূমিকা
স্বদেশি আন্দোলনে প্রেরণা জোগাতে রচিত হয় বহু স্বদেশি – আদর্শ ভিত্তিক কবিতা, গান ও নাটক। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
- (১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, হে ভগবান”।
- (২) রজনীকান্ত সেনের “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই”, মুকুন্দ দাসের “ফেলে দে রেশমী চুড়ি বঙ্গনারী কভু হাতে আর পরো না” ইত্যাদি।
- (৩) দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচনা করেন ‘মেবার পতন’, ‘দুর্গাদাস’, ‘প্ৰতাপ সিংহ’ প্রভৃতি দেশাত্মবোধক নাটক।
- (৪) পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, যেমন- বেঙ্গলী পত্রিকা, কেশরী পত্রিকা, দ্য হিন্দু, মারাঠা, অমৃতবাজার পত্রিকা, সঞ্জীবনী, ‘সন্ধ্যা’ প্রভৃতি কঠোর ভাষায় ইংরেজের এই অন্যায় কাজের প্রতিবাদ জানায়।
স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের বিস্তার
- (১) অল্পদিনের মধ্যেই স্বদেশি আন্দোলন সর্বাত্মক ও ব্যাপক আকার ধারণ করে। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বদেশি কাপড়ের কল, ব্যাংক, গেঞ্জি মোজা, বিভিন্ন প্রসাধনী দ্রব্যের কারখানা ইত্যাদি।
- (২) আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল কেমিক্যাল, ডা. নীলরতন সরকার প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় সাবান কারখানা, জামসেদজি টাটা প্রতিষ্ঠা করেন টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি।
- (৩) দলে দলে স্বেচ্ছাসেবকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বদেশি দ্রব্য বিক্রি করতে থাকেন।সেই সঙ্গে চলতে থাকে বিদেশি দ্রব্যের দোকানের সামনে লাগাতার পিকেটিং। পুড়িয়ে দেওয়া হয় বহু বিদেশি জিনিসপত্র।
- (৪) বাঙালি ছাত্র-শিক্ষক বর্জন করে ইংরেজি বিদ্যালয়।উকিল, মুহুরি ইংরেজের কোর্টকাছারি ত্যাগ করে। এমনকি ধোপা, নাপিত, রাঁধুনি ইত্যাদি শ্রেণির কর্মীরাও বর্জন করে তাদের ইংরেজ মালিকদের।
স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা
এই স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনে প্রধান শক্তি ছিল ছাত্র সমাজ। ছাত্রদের আন্দোলন থেকে দূরে রাখার উদ্দেশ্যে সরকার কার্লাইল সার্কুলার জারি করে আন্দোলনে যোগদানকারী ছাত্র ও তাদের বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা গঠন করে অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি।
বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার
সরকারি দমন নীতির প্রবল চাপে আন্দোলনের গতি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে। তবে পূর্ব বাংলার ঢাকা ও বরিশাল জেলায় অশ্বিনী কুমার দত্তের নেতৃত্বে এই আন্দোলন গণমুখী ও দুর্বার হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ১৯১১খ্রিস্টাব্দে সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লিতে এসে বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হন।
স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের গুরুত্ব
জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারায় এই আন্দোলন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –
- (১) এই আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনের মর্যাদা পেয়েছিল।
- (২) নরমপন্থী আদর্শের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে এই আন্দোলন এক নতুন পথ ধরে অগ্রসর হয়েছিল।
- (৩) আন্দোলনে সমাজের সকল স্তরের মানুষ সমর্থন জানানোয় আন্দোলন গণমুখী হয়ে উঠেছিল।
মূল্যায়ন
স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন ছিল ভারতবাসীর প্রথম জাতীয়তাবাদী গণ আন্দোলন।এই আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশ সমগ্র ভারতবর্ষের সামনে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেও তা একেবারে ত্রুটিমুক্ত ছিল না।
উপসংহার :- অমলেশ ত্রিপাঠী তাঁর ‘Extremist Challenge‘ গ্রন্থে বলেছেন, বিশাল আওয়াজ ও প্রতিধ্বনি করে শুরু হলেও এই আন্দোলন অবশেষে কাতর আওয়াজ করে থেমে যায় (“The increment began with a bang and ended with a whimper”)।
(FAQ) বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
বড়লাট লর্ড কার্জন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৯১১ খ্রিস্টাব্দে।