বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষের প্রকৃতি প্রসঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী শাশ্বত সংগ্রাম, সংঘর্ষের কারণে হিসেবে ধর্ম, স্বার্থের সংঘাত, ক্ষয়ক্ষতী ও জীবন নাশ, রাইচুর অধিকার নিয়ে সংঘর্ষ, চিরন্তন সংগ্রাম, সংঘর্ষের প্রধান কারণ, জমি দখলের লড়াই, সামরিক ও রাজনৈতিক প্রাধান্যের প্রশ্ন সম্পর্কে জানবো।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষের প্রকৃতি
বিষয় | বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্যের সংঘর্ষের প্রকৃতি |
বিজয়নগর সাম্রাজ্য | ১৩৩৬-১৬৪৬ খ্রি |
প্রতিষ্ঠাতা | হরিহর ও বুক্ক |
বাহমনি রাজ্য | ১৩৪৭-১৫২৬ খ্রি |
প্রতিষ্ঠাতা | আলাউদ্দিন বাহমান শাহ |
ভূমিকা :- মহম্মদ বিন তুঘলক-এর রাজত্বের শেষের দিকে তাঁর দূরদৃষ্টির অভাবে দাক্ষিণাত্যে যে সকল স্বতন্ত্র রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল তার মধ্যে বাহমনি রাজ্য অন্যতম। বাহমনি রাজ্যের প্রতিবেশী ও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল দাক্ষিণাত্যের বিজয়নগর সাম্রাজ্য।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের দীর্ঘস্থায়ী শাশ্বত সংগ্ৰাম
প্রাক-মুঘল যুগে বাহমনি ও বিজয়নগর রাজ্যের মধ্যে সংঘর্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা কখনও কখনও বিরতি সত্ত্বেও দীর্ঘস্থায়ী শাশ্বত এক সংগ্রামে পরিণত হয়েছিল।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষের কারণ হিসেবে ধর্ম
- (১) এই সংগ্রামে ধর্ম কতটা দায়ী ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। একদল ঐতিহাসিক বিশেষ করে Sewell তাঁর বিখ্যাত A Forgotten Empire নামক গ্রন্থে এই সংগ্রামে ধর্মকে দায়ী করেছেন।
- (২) কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণের মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকেই এই সংগ্রামের মূল কারণ বলে মনে করেন। কারণ এই যুগে ধর্ম কোনো সংগ্রামেই কখনও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নি। ধর্ম এখানে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে নি। অর্থাৎ এই সংগ্রামে ধর্মীয় প্রকৃতি প্রকৃতপক্ষে ছিল না।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের বিস্তারকাল
দক্ষিণ ভারত-এর রাজনীতিতে বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্য প্রায় দুশো বছরের অধিককাল প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল।
বাহমনি রাজ্যের ইতিহাস ষড়যন্ত্রের ইতিহাস
প্রকৃতপক্ষে বাহমনি রাজ্যের ইতিহাস আত্মকলহ ও ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। এঁদের মোট চোদ্দজন সুলতানের মধ্যে চারজন গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হন, দুজনের অতিরিক্ত মদ্যপানে মৃত্যু হয় ও দুজনকে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করা হয়।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের রক্তপাতের ইতিহাস
বাহমনি ও বিজয়নগ রাজ্যের ইতিহাস যুদ্ধ বিগ্রহ ও ভয়ঙ্কর এক রক্তপাতের ইতিহাস। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই দুই রাজ্যের নরপতিদের পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্প ও সাহিত্যের বিকাশ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগের প্রসার হয়েছিল, আইন ও শৃঙ্খলার স্থিতি হয়েছিল এবং সাধারণ মানুষের কারিগরি ও হস্তশিল্পে, কৃষিতে, অর্থনৈতিক ও শৈল্পিক বিকাশের পথ প্রশস্ত হয়েছিল।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের ব্যতিক্রম হীন দ্বন্দ্ব
বাহমনি সুলতানদের পতন ও তালিকোটার যুদ্ধের পরে বিজয়নগরের ধ্বংস পর্যন্ত উভয় রাজ্যের দ্বন্দ্ব ও বিরোধ সত্ত্বেও এই পরিস্থিতির বিশেষ কোনো ব্যতিক্রম ঘটে নি।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের স্বার্থের সংঘাত
বাহমনি সুলতানদের ও বিজয়নগরের রাজাদের স্বার্থের সংঘাত হয়েছিল প্রধানত তিনটি পৃথক পৃথক এলাকায়। এই তিনটি এলাকা হল কৃষ্ণা ও গোদাবরী নদীর বদ্বীপ এলাকা, তুঙ্গভদ্রার দোয়াব এবং মহারাষ্ট্র।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষের কারণ কৃষ্ণা ও গোদাবরী নদীর বদ্বীপ
কৃষ্ণা-গোদাবরীর বদ্বীপ এলাকা ছিল অত্যন্ত উর্বর। এই অঞ্চলের বন্দরগুলি বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের পক্ষে সহায়ক ছিল এবং স্বভাবতই তুঙ্গভদ্রা দোয়াব অঞ্চলের দখলদারি লড়াইয়ের সঙ্গে কৃষ্ণা-গোদাবরী এলাকার নিয়ন্ত্রণের জন্য সংগ্রামে অনেক সময় লিপ্ত হত।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষের কারণ তুঙ্গভদ্রার দোয়াব
তুঙ্গভদ্রা দোয়াবের অর্থনৈতিক গুরুত্বের জন্য এই অঞ্চল বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্যের মধ্যে সংঘর্ষের বড়ো কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং উভয় রাজ্যই এই অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তারের জন্য তৎপর ছিল।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষের কারণ কোঙ্কন
কোঙ্কনকে কেন্দ্র করে মারাঠাওয়াড়া অঞ্চলে বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্যের মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুচনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষে গোয়া বন্দরের গুরুত্ব
পশ্চিমঘাট ও আরব সাগরের মধ্যে অবস্থিত গোয়া বন্দর। এই বন্দর আমদানি ও রপ্তানির জন্য বিখ্যাত ছিল। বিশেষত ইরাক ও ইরান থেকে অশ্ব আমদানির প্রধান কেন্দ্র ছিল গোয়া বন্দর। তাই এর গুরুত্ব এই সময় অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষে ক্ষয়ক্ষতি ও জীবননাশ
বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্যের মধ্যে এইসব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে সংঘর্ষ প্রায় লেগেই থাকত। ধর্ম প্রায় এখানে গৌণ ছিল। যতদিন এই দুটি রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল ততদিন এই বিরোধও লেগেই ছিল। এইসব সংঘর্ষের ফলে উভয় রাজ্যে প্রচুর সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও জীবননাশ হয়েছিল।
বাহমনি সুলতানের মুদগল দুর্গ দখল
১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বুক্কর তুঙ্গভদ্রা অঞ্চলে মুদগল দুর্গ দখলের সময় একজন ব্যতীত দুর্গের ভিতর সকলের প্রাণনাশ হয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বাহমনি সুলতান প্রথম মহম্মদ শাহ মুদগল দুর্গটি পুনরায় দখল করার সময় হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের মধ্যে শান্তি স্থাপন
- (১) এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অবশ্য তাঁরা সাতমাস শান্তি স্থাপনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। শান্তিস্থাপনের শর্ত হিসাবে স্থির হয় যে যুদ্ধ-পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনা হবে এবং তুঙ্গভদ্রা দোয়াবকে উভয়ে সমানভাবে ভোগ করবে। এই যুদ্ধের পর একটি বিষয় স্থির হয় যে যুদ্ধের সময় বেসামরিক লোকজনদের প্রাণহানি করা যাবে না।
- (২) যদিও পরবর্তীকালে এই নীতি লঙ্ঘিত হয় কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে যুদ্ধের সময় মানবিকতার নীতি পালনের প্রচেষ্টা দাক্ষিণাত্যে সচেতনভাবে সম্ভবত প্রথম শুরু হয়েছিল। তাই বলা যায় যে বাহমনি ও বিজয়নগর রাজ্যের সংঘর্ষ-এর মধ্যে ধর্মনৈতিক উপাদান সম্ভবত তেমন ছিল না।
বাহমনি সুলতানের বরঙ্গল রাজ্য আক্রমণ
- (১) আলাউদ্দিন বাহমন শাহের উত্তরাধিকারী সুলতান মহম্মদ শাহ বরঙ্গল রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সুলতান মহম্মদ শাহ বরঙ্গল আর আক্রমণ করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে শান্তি স্থাপন করেন।
- (২) বরঙ্গলের এই শান্তি প্রায় ৫০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। ফলে বিজয়নগরের পক্ষে তুঙ্গভদ্রা এলাকা সম্পূর্ণ নিজের দখলে আনার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এইভাবে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকার সময় কোনো পক্ষই বিশেষ লাভবান হয় নি।
বাহমনি সুলতান মুজাহিদ শাহের ব্যর্থ অভিযান
প্রথম মহম্মদের পর তাঁর পুত্র মুজাহিদ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তিনি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিজয়নগরের বিরুদ্ধে শত্রুতা ও সংঘর্ষের নীতি অনুসরণ করেন। কিন্তু বিজয়নগরের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল।
দায়ুদের সময় বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের দ্বন্দ্ব
- (১) সুলতান মুজাহিদের সম্পর্কিত ভ্রাতা দায়ুদ তাঁকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। তাঁর রাজত্বকালে দুটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একটি হল তিনি পারসিক তুর্কিদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখালে বাহমনি রাজ্যে দক্ষিণী ও বিদেশিদের মধ্যে এক দ্বন্দ্বের সূচনা হয়।
- (২) এই দ্বন্দ্বেও ধর্মের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল না। কারণ পারসিক, তুর্কি ও দক্ষিণীরা উভয়ই ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এই দ্বন্দ্ব এক চিরন্তন শাশ্বত দ্বন্দ্বে পরিণত হয় এবং পরবর্তীকালে এই দ্বন্দ্ব বাহমনি রাজ্যের সর্বনাশের কারণ হয়।
- (৩) তাছাড়া তিনিও পিতার মতো তিন বছর বিজয়নগরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কিন্তু দায়ুদ কিছুকাল পর আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান এবং অভিজাতরা আলাউদ্দিন বাহমন শাহের পৌত্র দ্বিতীয় মহম্মদ শাহকে সিংহাসনে বসান।
রায়চুর অধিকার নিয়ে বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষ
- (১) সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদ শাহ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। মহম্মদ শাহের রাজত্বকালেই বিজয়নগর ও তেলেঙ্গানা রাজ্যের সঙ্গে বাহমনি রাজ্যের এক চিরন্তন সংঘর্ষের সূচনা হয়। কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রা নদীর মধ্যবর্তী রায়চুর দুর্গের অধিকার নিয়ে উভয় রাজ্যের মধ্যে এক দীর্ঘকালীন স্থায়ী সংঘর্ষ চলে।
- (২) প্রকৃতপক্ষে মহম্মদ শাহের রাজত্বকালে বিজয়নগর রাজ্যের সঙ্গে বাহমনি রাজ্যের যে সংঘাত শুরু হয় তা সাময়িক বিরতি ছাড়া বিজয়নগর রাজ্যের সমগ্র অস্তিত্বকাল পর্যন্ত চলেছিল। তিনি তেলেঙ্গানা ও বিজয়নগর রাজ্যের শাসকদের শুধু পরাজিত করেন নি, তাদের বিরাট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করেছিলেন।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের চিরন্তন সংগ্ৰাম
যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে চালুক্য ও পল্লবদের মধ্যে, রাষ্ট্রকুট ও চোলদের মধ্যে অথবা চালুক্য-চোলদের মধ্যে চিরন্তন সংঘর্ষ চলেছিল, সেই একই কারণে এই নব গঠিত বিজয়নগর রাজ্যের সঙ্গে বাহমনি রাজ্যের চিরন্তন সংগ্রাম শুরু হয়।
ফিরোজ শাহের আমলে বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংগ্ৰাম
- (১) দ্বিতীয় মহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর বাহমনি রাজ্যের শাসকবর্গের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধের পর ১৩৯৭ খ্রিস্টাব্দে এক প্রাসাদ বিদ্রোহের দ্বারা তাজউদ্দিন সিংহাসনে বসেন। তাজউদ্দিন ফিরোজ শাহ উপাধি গ্রহণ করেন।
- (২) ফিরোজ শাহও বিজয়নগরের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। তিনি বিজয়নগরের বিরুদ্ধে দুটি অভিযান করেন এবং দুটি অভিযানেই সফল হন। ফিরিস্তার বিবরণ থেকে জানা যায় যে বিজয়নগরের রাজা দেবরায় তাঁকে কন্যা সম্প্রদান করতে বাধ্য হন।
- (৩) ১৪২০ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরের বিরুদ্ধে তাঁর তৃতীয় অভিযান ব্যর্থ হয়। যে রায়চুর-দোয়াবকে কেন্দ্র করে উভয় রাজ্যের সঙ্গে সংঘর্ষের সূচনা হয়, তা বিজয়নগরের অধিকারে থেকে যায়। ফিরোজ তাঁর ভাই-এর অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করেন। গুলবর্গায় ফিরোজই ছিলেন বাহমনি রাজ্যের শেষ সুলতান।
আহম্মদ শাহের আমলে বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষ
১৪২২ খ্রিস্টাব্দে আহম্মদ শাহ বাহমনি রাজ্যের সুলতান হন। তিনি তাঁর ভ্রাতা ফিরোজের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিজয়নগর রাজ্য আক্রমণ করেন। তিনি দেবরায়কে পরাজিত করে প্রচুর ক্ষতিপূরণ আদায় করেন। ফিরিস্তার বিবরণ থেকে জানা যায় যে দেবরায় তাঁর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেছিলেন। তিনি বরঙ্গল জয় করেছিলেন।
দ্বিতীয় আলাউদ্দিনের আমলে বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষ
- (১) ১৪৩৬ খ্রিস্টাব্দে আহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় আলাউদ্দিন সিংহাসনে আরোহণ করেই বিজয়নগরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। তিনিও দেবরায়কে পরাজিত করেন। তাঁরই রাজত্বকালে মামুদ গাওয়ান নামে বাহমনি রাজ্যের এক চরম হিতৈষীর আবির্ভাব ঘটে।
- (২) পরবর্তীকালে মামুদ গাওয়ানই বাহমনি রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হন। তিনিও বিজয়নগর ও উড়িষ্যার সাথে যুদ্ধ সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করেন এবং বাহমনি রাজ্যের সীমানা উড়িষ্যার দক্ষিণ থেকে গোয়া পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। প্রকৃতপক্ষে মামুদ গাওয়ানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাহমনি রাজ্যের দুশো বছরের শাসনকালের অবসান ঘটে।
দক্ষিণের বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের ধর্মভিত্তিক সংগ্ৰাম নয়
- (১) বাহমনি রাজ্যের সঙ্গে বিজয়নগর রাজ্যের এই চিরন্তন ও শাশ্বত সংগ্রামের মধ্যে অনেক ঐতিহাসিক ধর্মকে দায়ী করেছেন। তাঁদের এই নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামকে কলঙ্ক ও হিন্দু বিদ্বেষের চরম নিদর্শন হিসাবেই অনেকে দেখাবার চেষ্টা করেছেন।
- (২) একথা সত্য, বাহমনি ও বিজয়নগর রাজ্য নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, কিন্তু দক্ষিণ ভারতের এই সংগ্রাম ধর্মভিত্তিক ছিল না।
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষের প্রধান কারণ
- (১) এই সংগ্রামের প্রধান কারণগুলি ছিল রাজনৈতিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক। কারণ আমাদের একটা বিষয় বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে ভারতবর্ষে মুসলমান শাসকদের মধ্যে আলাউদ্দিন বাহমন শাহই প্রথম জিজিয়া কর তুলে নিয়েছিলেন।
- (২) চাকরির ক্ষেত্রে তাঁরা হিন্দুদের নিয়োগ রুদ্ধ করে দেন নি। সরকারি রাজস্ব বিভাগে হিন্দুদেরই প্রাধান্য ছিল। তাঁরা দৌলতাবাদে একটি মানমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে ইউরোপ-এর নরপতিরাও বিরুদ্ধ ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী সন্ন্যাসীদের পুড়িয়ে মেরেছিলেন।
দক্ষিণের বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের মধ্যে জমি দখলের লড়াই
প্রকৃতপক্ষে তখন ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব বলতে আজকে আমরা যা বুঝি তা সেযুগে ছিল না। দ্বন্দ্ব ছিল, লড়াই ছিল, তবে সে লড়াই ছিল জমি দখলের লড়াই। হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের নয়। তাই এই যুগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিচয় পাওয়া যায় না।
বাহমনি রাজ্যের প্রশংসা
সেই যুগের কোনো সংগ্রামেই ধর্ম কখনোই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজ করে নি। এই কারণেই মনে হয় ঐতিহাসিক মিডোজ টেলার বাহমনি রাজ্যের শাসকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ ঐতিহাসিক মিডোজ টেলারের মন্তব্য অতিরঞ্জিত বলে অভিহিত করেছেন।
সতীশচন্দ্রের মন্তব্য
মধ্যযুগের মানদণ্ডে তাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রশংসার দাবি রাখে। তাই সতীশ চন্দ্র বলেছেন, “বাহমনি রাজ্যে যে সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে ওঠে পরবর্তীকালে বাহমনি রাজ্য থেকে উদ্ভুত রাজ্যসমূহেও তা অনুসৃত হয় এবং মধ্যযুগে মুঘল সংস্কৃতি গঠনেও তা প্রভাব বিস্তার করে।”
বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের মধ্যে সামরিক ও রাজনৈতিক প্রাধান্যের প্রশ্ন
- (১) সামরিক ও রাজনৈতিক প্রাধান্যের প্রশ্ন ও ব্যবসা এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময় বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্যের সংঘর্ষ উপস্থিত হয়েছিল। দক্ষিণ তুঙ্গভদ্রা ও কৃষ্ণার দোয়াবকে কেন্দ্র করে বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্যের মধ্যে সংঘর্ষ উপস্থিত হয়েছিল।
- (২) এই সংঘর্ষ ধর্মীয় উন্মাদনা অপেক্ষা বাস্তব রাজনীতির দ্বারা অধিক প্রভাবিত হয়েছিল। বিজয়নগরও ধর্মের পুনরুদ্ধারের কেন্দ্র বা ধর্মের হয়ে লড়াই করার জন্য সক্রিয় রাজনীতি করে নি। বরং উড়িষ্যা ও অন্যান্য হিন্দু রাজ্যের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত ছিল।
- (৩) বাহমনি রাজ্যের সুলতানরাও ধর্মের ধ্বজাধারী ছিলেন না। মন্দিরগুলি প্রচুর অর্থ ও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে এক একটি স্থানীয় এলাকায় ক্ষমতার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
- (৪) প্রকৃতপক্ষে বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্যের সুলতানরা ও তাদের উত্তরাধিকারীরা রাজ্য শাসন ও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ধর্ম অপেক্ষা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
উপসংহার :- বারবোসা বলেছেন যে বিজয়নগরে “every man come and go and live according to his need without suffering any annoyance and without any enquiry whether he is a Christian, Jew, Moor or Heathen.”
(FAQ) বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষের প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৩৩৬-১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দ।
১৩৪৭-১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ।
কৃষ্ণদেব রায়।
আলাউদ্দিন বাহমান শাহ।