বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক অবস্থা

বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক অবস্থা প্রসঙ্গে নারীদের স্থান, ব্রাহ্মণদের স্থান, রাজাদের খাদ্য, গণিকাবৃত্তি, উৎসব, সহনশীল সমাজ, জাতিভেদ প্রথা, দায়িত্ব ও কর্তব্যে সচেতন সম্পর্কে জানবো।

বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক অবস্থা

বিষয়বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক অবস্থা
সাম্রাজ্যবিজয়নগর সাম্রাজ্য
সর্বোচ্চ স্থানব্রাহ্মণ
উচ্চ স্থাননারী
সচেতনতাদায়িত্ব ও কর্তব্য
বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক অবস্থা

ভূমিকা :- বিজয়নগরের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কেও বিদেশিদের বিবরণ থেকে এক প্রাঞ্জল চিত্র পাওয়া যায়। লিপি ও সাহিত্য থেকেও বিজয়নগরের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যায়।

পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যে মহিলাদের স্থান

  • (১) বিজয়নগরের সমাজ সুগঠিত ছিল। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, সমাজে নারীর স্থান ছিল উচ্চে। মহিলারা দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করত। শিক্ষার দ্বার তাদের সামনে উন্মুক্ত ছিল।
  • (২) মহিলাদের অস্ত্রচালনা ও মল্লযুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। ন্যুনিজ-এর মতে, মহিলারা রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার সকল ক্ষেত্রেই চাকরিতে নিযুক্ত হতে পারতেন। তিনি আরও বলেছেন, রাজধানীতে মহিলারা বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত থাকত।
  • (৩) সঙ্গীত-শিক্ষার জন্য মহিলাদের রাজঅন্তঃপুরে নিয়োগ করা হত। বিজয়নগরের রাজা মহিলা মল্লযোদ্ধা, মহিলা জ্যোতিষী ও মহিলা হিসাবরক্ষক নিয়োগ করতেন। মহিলারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন হিসাবের কাজে নিয়োজিত হত।
  • (৪) প্রকৃতপক্ষে, মধ্যযুগের বাতাবরণে বিচার করলে বলা যায়, বিজয়নগরে মহিলাদের অবস্থান সন্তোষজনক ছিল। বাল্যবিবাহ ও পুরুষদের বহুবিবাহ বিজয়নগরে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। সতীদাহ প্রথা বিজয়নগরে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল এবং ব্রাহ্মণদের দ্বারা অনুমোদিত ছিল।

বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যে ব্রাহ্মণদের স্থান

  • (১) সমাজে ব্রাহ্মণদের স্থান সবার উপরে ছিল। সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক জীবনে ব্রাহ্মণদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বাহ্মণরা ছিলেন নিরামিষাশী। গোমাংস ছাড়া সব মাংসই বিজয়নগরের মানুষ খেত। মাছ খাওয়ার রীতি ছিল।
  • (২) বিজয়নগণের সমাজব্যবস্থায় ব্রাহ্মণগণ বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যে কোনো কাজে ব্রাহ্মণদের নিয়োগে কোনো বাধা ছিল না। রাজা কৃষ্ণদেব রায় ব্রাহ্মণ সেনাপতিদের বিশ্বস্ততার ভুয়সী প্রশংসা করেছেন।
  • (৩) ব্রাহ্মণরা সাধারণত বুদ্ধিজীবী বলে গণ্য হতেন এবং ধর্মীয় ও সাহিত্য বিষয়ে চর্চা করে জীবন যাপন করতেন। ব্রাহ্মণরা পঠন-পাঠন ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করতেন বলে সমাজে সম্মানজনক অবস্থান ভোগ করতেন।
  • (৪) ন্যুনিজ ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, তাঁরা ছিলেন “honest men given to merchandise, very acute and of much talent very good at accounts, lean men and well-formed. but little fit for hard work”.

পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজাদের খাদ্য

বিজয়নগরের নরপতিগণও মাছ-মাংস খেতেন। গোমাংস নিষিদ্ধ ছিল। তাদের খাদ্য তালিকা দেখে স্মিথ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, কৃষ্ণদেব রায় ও অচ্যুত রায় ছিলেন গোঁড়া হিন্দু ও বিষ্ণুর উপাসক। অথচ তাঁরাই পশুপক্ষীর মাংস খেতেন, এর সঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল।

পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যে গণিকাবৃত্তি

  • (১) বিজয়নগরের সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রাচুর্যের সঙ্গে সঙ্গে সমাজজীবনে অন্ধকারও নেমে এসেছিল। গণিকাবৃত্তি বিজয়নগরে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। পারসিক দূত আবদুর রাজ্জাক লিখেছেন, গণিকারা নানাভাবে মানুষকে প্রলোভিত করত।
  • (২) অবশ্য প্যারিস ও দিল্লির সঙ্গে বর্তমানে যারা পরিচিত বিজয়নগর সম্পর্কে তাদের কাছে আশ্চর্যের কিছু নেই। গণিকারা যে-কোনো সরকারি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারত এবং উচ্চপদাধিকারীরা তাদের সঙ্গে সঙ্গদান করলে কোনো কলঙ্কের ভয় ছিল না।

বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের উৎসব

পায়েস-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, বিজয়নগরের নরপতিগণ নৃশংসভাবে পশুবলি দিয়ে উৎসব পালন করতেন। পায়েস ‘মহানবমী‘ উৎসব পালনের সময় দেখেছিলেন, একদিনে আড়াইশো মোষ ও সাড়ে চার হাজার ছাগল বলি দেওয়া হয়েছিল।

পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সহনশীল সমাজ

বিজয়নগরের সামাজিক জীবনে অপরকে সহ্য করার সহনশীলতা ছিল। যে-কোনো ধর্মের মানুষ এখানে আসতে পারত এবং যেতে পারত। যে-কোনো উপাসনাকে সমগ্র সাম্রাজ্যে সহ্য করা হত। কেউ কোনো বাধার সম্মুখীন হত না। বিজয়নগরের এই পরধর্মমত সহিষ্ণুতা মধ্যযুগের ইতিহাসে সত্যই এক বিরল দৃষ্টান্ত।

পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যে জাতিভেদ প্রথা

সমাজে জাতিভেদ প্রথা প্রচলিত ছিল। সমাজ বর্ণের দ্বারা বিভক্ত ছিল। এই সমাজব্যবস্থায় ব্রাহ্মণরা ছিলেন সকলের উপরে। জাতিভেদ প্রথা সামাজিক ও আর্থিক ব্যবস্থা হিসাবে রাজশক্তির সমর্থন লাভ করেছিল। বর্ণবিভক্ত এই সমাজে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর খাদ্য, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন প্রভৃতি ব্যাপারে স্বাতন্ত্র্য বজায় ছিল।

পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যে পরস্পর সহযোগিতা

আবার সেচের কাজে বা মন্দিরের পূজার্চনা বা অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় ও স্থানীয় শাসনের ব্যাপারে তাদের পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার কোনো অভাব ছিল না।

পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যে সকলেই দায়িত্ব ও কর্তব্যে সচেতন

প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিল এবং প্রত্যেক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজ নিজ দাবি অপেক্ষা কর্তব্য সম্পর্কেই সচেতন ছিল বেশি।

উপসংহার :- অবশ্য এই পরিস্থিতিতে যে সামাজিক বিরোধ ও সংঘাত ছিল না তা বলা যায় না। তবে এই বিরোধ ও সংঘাত তেমন তীব্রভাবে কখনও দেখা যায়নি।

(FAQ) বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বিজয়নগর সাম্রাজ্যে মহানবমী উৎসব পর্যবেক্ষণ করেন কে?

পর্তুগীজ পর্যটক পায়েস।

২. বিজয়নগরের সমাজে সবার উপরে কারা ছিলেন?

ব্রাহ্মণ।

৩. বিজয়নগরে নিরামিষ ভোজী কারা ছিলেন?

ব্রাহ্মণরা।

৪. বিজয়নগরের রাজাদের খাদ্য কি ছিল?

মাছ, মাংস।

Leave a Comment