বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনীতি

বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনীতি প্রসঙ্গে কৃষির অগ্ৰগতি, বাণিজ্যিক অগ্রগতি, মুদ্রা, জীবনযাত্রার মান, কৃষক ও সাধারণ মানুষের অবস্থা সম্পর্কে জানবো।

বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনীতি

বিষয়বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনীতি
নিকোলো কন্টি১৪২০ খ্রি
আবদুর রাজ্জাক১৪৪২-৪৩ খ্রি
এডওয়ার্ড বারবোসা১৫১৬ খ্রি
মুদ্রাসোনা, রূপা,তামা
বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনীতি

ভূমিকা :- বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় সম্পর্কে বেশ কয়েকজন বিদেশি পর্যটক বিজয়নগর পরিভ্রমণকালে তাদের বিবরণে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বিদেশি পর্যটকদের এই মনোরম বিবরণ বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল।

নিকোলো কন্টির বিবরণ

১৪২০ খ্রিস্টাব্দে ইতালীয় পর্যটক নিকোলো কন্টি বিজয়নগর পরিভ্রমণ করেন। তিনি লিখেছেন, বিজয়নগর শহরটির ষাট মাইল পরিধি ছিল এবং শহরটি পর্বতমালার পাদদেশ পর্যন্ত প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। শহরে অস্ত্রধারণ করার মতো নব্বই হাজার লোক ছিল। বিজয়নগরের রাজা ভারতের অপর যে-কোনো নরপতি অপেক্ষা শক্তিশালী ছিলেন।

আবদুর রাজ্জাকের বিবরণ

পারসিক দূত আবদুর রাজ্জাক ১৪৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরে আসেন। তিনি লিখেছেন, “All the inhabitants of the country, whether high or low, wear jewels and gilt ornaments in their ears and around their necks, arms. wrists and fingers”. উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে বিজয়নগরের সকল অধিবাসীগণ তাদের আঙুলে, কানে, গলায়, বাহুতে রত্নখচিত অলঙ্কার পরিধান করতেন।

পায়েসের বর্ণনা

  • (১) পর্তুগিজ পর্যটক পায়েস একইভাবে বিজয়নগরের ঐশ্বর্য সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তিনি লিখেছেন, বিজয়নগরের নরপতির অগণিত ধনরত্ন, সৈন্য ও হাতি ছিল। বিজয়নগরে পৃথিবীর নানা দেশের নানা জাতির লোক ছিল। তিনি বহির্বাণিজ্যেরও উন্নতির কথা উল্লেখ করেছেন।
  • (২) ধান, চাল, গম, বার্লি, মশলা প্রভৃতির প্রাচুর্য পায়েসকে মুগ্ধ করেছিল। মূল্যও অত্যন্ত সস্তা ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। রাজপথসমূহ ও বাজার খাদ্য শস্যবাহী গোরুর গাড়িতে পরিপূর্ণ ছিল।

বারবোসার বিবরণ

বারবোসা ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, বিজয়নগর এক জনসমৃদ্ধ শহর এবং বিজয়নগর হীরে, মুক্তা, সিল্ক, কর্পূর, মৃগনাভি, চন্দনকাঠ প্রভৃতি পণ্যদ্রব্যের শ্রেষ্ঠ ব্যবসাকেন্দ্র ছিল।

কৃষির অগ্ৰগতি

  • (১) এই বিদেশিদের বিবরণ থেকে একটা বিষয় সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, বিজয়নগরের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সমৃদ্ধি যে অতুলনীয় ছিল সে ব্যাপারে সকলেই একমত। বিজয়নগরের নরপতিগণ সেচ ব্যবস্থার উন্নতিতে উৎসাহ দেওয়ায় কৃষি উন্নতি ঘটে।
  • (২) তুঙ্গভদ্রা নদীতে দেবরায় বাঁধ দিয়ে একদিকে যেমন বিজয়নগর শহরে জল সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিলেন, আবার এই বাঁধের জলকে সেচের কাজে লাগিয়েছিলেন। তুলাজাত দ্রব্য, খাদ্যশস্য, ধাতুশিল্প ও গন্ধদ্রব্যের মূল্য অত্যন্ত সস্তা ছিল, একথা সব বিদেশি পর্যটকই স্বীকার করেছেন।

বাণিজ্য

  • (১) কৃষিকার্যে বিজয়নগর সমুন্নতি লাভ করলেও অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিজয়নগর যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল। বিজয়নগর সাম্রাজ্যে বহু বন্দর ছিল এবং ইউরোপের সঙ্গে ও মালয়, বার্মা, চীন, আরব, পারস্য, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।
  • (২) পশ্চিম উপকূলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল কালিকট। আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, বিজয়নগরের কালিকটের মতো তিনশো বন্দর ছিল। এই বন্দর থেকে কাপড়, চাল, লোহা, চিনি এবং মশলা বিদেশে রপ্তানি করা হত।
  • (৩) বিজয়নগরে বিদেশ থেকে আমদানি করা হত ঘোড়া, হাতি, তামা, কয়লা, পারদ, চীনের সিল্ক প্রভৃতি পণ্যদ্রব্য। বিজয়নগরের নিজস্ব সমুদ্রপোত ছিল এবং সমুদ্রপোতগুলির নির্মাণ-কৌশলও তাদের অজানা ছিল না।

মুদ্রা

বিজয়নগরে সোনা ও তামার মুদ্রা প্রচলিত ছিল। রূপার মুদ্রাও প্রচলিত ছিল দেখা যায়। জিনিসপত্রের মূল্য অত্যন্ত সস্তা ছিল।

জীবনযাত্রার মান

বিদেশিদের বিবরণ থেকে জানা যায়, দেশের উচ্চবর্গের মানুষের জীবনযাত্রার মান ছিল অত্যন্ত উচ্চ। তবে বিদেশিদের বিবরণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান কেমন ছিল, তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় নি।

কৃষক ও সাধারণ মানুষের অবস্থা

  • (১) কৃষকদের অবস্থা কেমন ছিল, তার পরিচয়ও এই বিবরণ থেকে জানা যায় নি। যেহেতু বিদেশি পর্যটকগণ শহরের মধ্যেই তাঁদের পরিভ্রমণ সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন, সেহেতু তাঁরা গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা স্বচক্ষে দেখবার সুযোগ পান নি। অথবা গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা তাঁদের দৃষ্টিতে এড়িয়ে গেছে।
  • (২) যতদুর সম্ভব মনে হয়, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ ছিল। তারা করভার ও প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের দুর্ব্যবহারে অত্যন্ত দুরবস্থায় জীবনযাপন করত। জমির মালিককে বেগার শ্রম দিতে হত। তাছাড়া, সম্পদ কর, বিক্রয় কর, গোচারণ কর, সামরিক কর, বিবাহ কর প্রভৃতি দিতে হত।
  • (৩) তবে কৃষ্ণদেব রায় বিবাহ কর তুলে দিয়েছিলেন। বিজয়নগরের অর্থনীতি নিয়ে বিদেশিরা যে বিবরণই দিন সাধারণের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না।

আধুনিক ঐতিহাসিকদের মত

  • (১) আধুনিক ঐতিহাসিক Dr CV Vaidya তার Downfall of Hindu India গ্রন্থে বলেছেন, বিজয়নগরের অর্থনীতি মোটেই দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। কারণ সাম্রাজ্যের ভূমি রাজস্বের একটি বড়ো অংশ প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সমরনায়করা ভোগ করত।
  • (২) বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য সকল রাজা সমান উৎসাহ দেখাতেন না। রাজা কৃষ্ণদেব রায় বাণিজ্যে উৎসাহী হলেও অন্য রাজারা তা ছিলেন না। তাছাড়া পর্তুগিজদের পশ্চিম উপকূলে বিভিন্ন বাণিজ্যের সুযোগ দিয়ে বিজয়নগরের রাজারা ভুল করেন।
  • (৩) যুদ্ধের জন্য ইরানি ঘোড়া খরিদের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। তুলনামূলকভাবে আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাণের জন্য তারা মনোযোগী হন নি।

উপসংহার:- বৈদেশিক বিবরণ থেকে বিজয়নগরের একটা সচ্ছল অর্থনৈতিক চিত্র পাওয়া যায়। পর্তুগিজ পর্যটক পায়েস -এর বিবরণীতে জানা যায় যে, বিজয়নগরে সবরকম খাদ্যশস্য সস্তায় বিক্রি হত। এডওয়ার্ড বারবোসা বলেছেন বিজয়নগর ছিল হীরে, রুবি, সিল্ক, কর্পূর, সিন্দুর, চন্দনকাঠের বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র।

(FAQ) বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বিজয়নগর সাম্রাজ্যে কিসের মুদ্রা চালু ছিল?

সোনা, রূপা ও তামা।

২. নিকোলো কন্টি কবে বিজয়নগরে আসেন?

১৪২০ খ্রিস্টাব্দে।

৩. বিজয়নগর সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর কোনটি?

কালিকট।

৪. বিজয়নগরের কোন রাজা তুঙ্গভদ্রা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করান?

দেবরায়।

Leave a Comment