গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমলে বাংলা

গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমলে বাংলা প্রসঙ্গে বাংলায় দ্বৈত শাসন, দুই জন শাসক নিয়োগের কারণ, তুঘ্রিলের রাজ্য বিস্তার, ইসলামীয় সংস্কৃতির প্রসার, তুঘ্রিলের উড়িষ্যা অভিযান, বলবনের অসুস্থতা, তুঘ্রিলের স্বাধীনতা ঘোষণা, নৈতিক সমর্থন, আমিন খানের পরাজয়, বলবনের বাংলা অভিযান ও বাংলার স্বাধীন সুলতানির স্বীকৃতি সম্পর্কে জানবো।

গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমলে বাংলা

বিষয়বলবনের আমলে বাংলা
শাসনকর্তাআমিন খান ও তুঘ্রিল খাঁ
উড়িষ্যা অভিযানতুঘ্রিল খাঁ
বলবনের অভিযান১২৮০ খ্রি
গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমলে বাংলা

ভূমিকা :- সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন দিল্লীর সিংহাসনে বসার পর বাংলা শাসনের জন্য আমিন খানকে শাসনকর্তা ও মুঘিসুদ্দিন তুঘ্রিল খানকে সহকারী শাসনকর্তা নিয়োগ করেন (১২৭১ খ্রি)।

বলবনের আমলে বাংলায় দ্বৈতশাসন

মুঘিসুদ্দিন তুঘ্রিল সোনারগাঁও বা পূর্ববঙ্গের দায়িত্ব নেন। বাংলাদেশ-এ দুইজন শাসনকর্তা নিয়োগের মধ্যে বলবনের কূট-বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়।

বাংলায় দুই জন শাসক নিয়োগের কারণ

পূর্বে বাংলায় একজন শাসনকর্তা থাকায়, তিনি দিল্লী থেকে বাংলার দূরত্বের সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন। এজন্য বলবন দুইজন শাসনকর্তা নিয়োগ করেন, যাতে একে অপরের উচ্চাকাঙ্খা দমন করতে পারে এবং পরস্পরের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ হয়ে যায়।

গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমলে বাংলায় তুঘ্রিলের রাজ্য বিস্তার

তুঘ্রিল খাঁ বাংলায় নিযুক্ত হয়ে বাংলায় রাজ্য বিস্তারের কাজে হাত দেন। তিনি সোনারগাঁওয়ের নিকটে কিল্লা-ই-তুঘরাল নামে এক দুর্গ নির্মাণ করেন। ঢাকা, ফরিদপুর ও ত্রিপুরায় তিনি মুসলিম শাসন দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেন। সম্ভবত তিনি বরিশালের হিন্দু রাজাকেও পরাস্ত করেন।

বলবনের আমলে বাংলায় ইসলামীয় সংস্কৃতির প্রসার

তুঘ্রিল খান ছিলেন অসম সাহসী এবং সুলতানের বিশেষ প্রিয় লোক। তিনি মুসলিম দরবেশ ও সন্তদের খানকা ও দরগা স্থাপনের অনুমতি দিয়ে ইসলামীয় সংস্কৃতি প্রসার ঘটান।

বাংলার সুলতান তুঘ্রিলের উড়িষ্যা অভিযান

বাংলার বাইরে জাজনগর বা উড়িষ্যায় তিনি অভিযান চালান। পশ্চিমবাংলা বা রাঢ়ভূমির দক্ষিণ ভাগ যথা, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলা এই সময় উড়িষ্যার গঙ্গবংশীয় রাজারা অধিকার করেছিলেন। তুঘ্রিল খাঁ উড়িষ্যা অভিযান করে এবং লুন্ঠন চালিয়ে এই সকল স্থান মুক্ত করার চেষ্টা করেন।

গিয়াসউদ্দিন বলবনের অসুস্থতা

বরণীর মতে জাজনগর অভিযানের পর তুঘ্রিল দিল্লীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পূর্ব ভারত-এ এক স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প নেন। এই সময় বলবন মোঙ্গল যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিলেন। এই যুদ্ধের পর সুলতান এত অসুস্থ হন যে, তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হয়।

বাংলায় তুঘ্রিলের স্বাধীনতা ঘোষণা

বলবনের মৃত্যু সংবাদের সুযোগে তুঘ্রিল খান মুঘিসুদ্দিন উপাধি নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আইন মত জাজনগর অভিযানের লুঠের জিনিসের ১/৫ অংশ তিনি দিল্লীতে পাঠাতে অস্বীকার করেন।

গিয়াসউদ্দিন বলবনের বিরুদ্ধে নৈতিক সমর্থন

বলবনের কঠোর শাসনে সকলেই কাঁপত। সুতরাং বলবনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় তুঘ্রিল বাংলার প্রজা, বহু অমাত্যদের নৈতিক সমর্থন পান।

বলবনের আমলে আমিন খানের পরাজয়

বিদ্রোহ করার পর তুঘ্রিল লখনৈতির যুদ্ধে আমিন খানকে পরাস্ত করেন। বলবন এই বিদ্রোহ দমনের জন্য প্রথমে তাঁর সেনাপতিদের মাধ্যমে দুটি অভিযান পাঠান। কিন্তু দুটি অভিযানকেই তুঘ্রিল ছত্রভঙ্গ করেন।

গিয়াসউদ্দিন বলবনের বাংলা অভিযান

অবশেষে বলবন নিজে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র বুখরা খাঁকে সঙ্গে নিয়ে বাংলা আক্রমণ করেন (১২৮০ খ্রি)। তুঘ্রিল খান লক্ষনাবতী ছেড়ে জাজনগরের দিকে পালাবার চেষ্টা করলে, বলবন তাঁর পিছু নিয়ে তাকে পরাজিত ও নিহত করেন।

রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত

ডঃ মজুমদারের মতে, তখন পশ্চিম বাংলার বর্ধমান, হুগলী, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর প্রভৃতি উড়িষ্যার অধিকারে ছিল। তুঘ্রিল এই অঞ্চলে আশ্রয় নেন। জাজনগর বলতে এই অঞ্চলকেই বরণী মনে করেছেন।

বলবন কর্তৃক কঠোর দণ্ড দান

বলবন তুঘ্রিলের শিবির থেকে প্রচুর ধনরত্ন পান। তিনি তুঘ্রিলের অনুগামীদের শুলে চড়িয়ে প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন।

গিয়াসউদ্দিন বলবনের দিল্লি প্রত্যাবর্তন

বাংলার শাসনভার দ্বিতীয় পুত্র বুখরা খাঁকে দিয়ে বলবন দিল্লী ফিরে যান।

বলবনের আমলে তুঘ্রিলের জনপ্রিয়তা

বাংলায় তুঘ্রিল খাঁর বিশেষ জনপ্রিয়তা ছিল। তিনি দাতা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন এবং বহু মক্তব, মসজিদ, খানকায় অর্থ দান করেন।

বলবনের আমলে বাংলায় বুখার খানের শাসন

তুঘ্রিল খানের মৃত্যুর পর বলবনের প্রতিনিধি হিসেবে বলবনের পুত্র বুখরা খান বাংলা শাসন করেন। বলবনের মৃত্যু হলে বুঘরা খাঁ সুলতান নাসিরুদ্দিন শাহ নাম নিয়ে বাংলায় স্বাধীনভাবে শাসন চালান। এই সময় বুখরা খানের পুত্র কাইকোবাদ দিল্লীর সিংহাসনে বসেন।

বলবনের আমলে বাংলার স্বাধীন সুলতানির স্বীকৃতি

বুখরা খান দিল্লীর সিংহাসন অপেক্ষা বাংলার সিংহাসন পছন্দ করতেন। সুতরাং তিনি বাংলার আরাম ও বিলাসিতায় সময় কাটান। সুলতান কাইকোবাদ বাংলায় তাঁর পিতার স্বাধীন সুলতানিকে স্বীকৃতি দেন।

বলবনের আমলে বাংলার সুলতান রুকনুদ্দিন কাইকাউস

বুখরা খাঁর পর রুকনুদ্দিন কাইকাউস ১২৯১-১২১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন। তার রাজত্বকালে কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা জানা যায় নি।

বলবনের আমলে বাংলায় শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের শাসন

এর পর শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ ১৩০১-১৩২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন।

বাংলায় বলবনী শাসনের গুরুত্ব

বাংলায় বলবনী শাসনের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা যায় যে,

  • (১) বলবনী আমলে পূর্ব বাংলা বা সোনারগাঁও অঞ্চলে মুসলিম অধিকার ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়। পূর্ব বাংলায় ইসলামীয় সংস্কৃতিরও বিশেষ বিস্তার ঘটে। এর ফলে পূর্ব বাংলার বিচ্ছিন্নতা দূর হয়।
  • (২) লখনৌতিকে কেন্দ্র করে বাংলার কেন্দ্রীয় শাসন মজবুত হয়। বলবনের কঠোর শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দিল্লীর বহু মুসলিম অভিজাত এই সময় বাংলায় চলে আসেন। ফলে বাংলায় ইসলামীয় সংস্কৃতির প্রসার ঘটে।

উপসংহার :- মুসলিম দরবেশ বা সন্ত ফকিররা বাংলার গ্রামাঞ্চলে দরগা, খানকা স্থাপন করে ইসলামের প্রচার করেন। বাংলার গৌড় ও লখনৌতিতে সুলতানি স্থাপত্য নির্মিত হয়।

(FAQ) গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমলে বাংলা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বলবন কাকে বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন?

আমিন খান ও মুঘিসুদ্দিন তুঘ্রিল।

২. কিল্লা-ই-তুঘরাল দুর্গ নির্মাণ করেন কে?

মুঘিসুদ্দিন তুঘ্রিল খাঁ।

৩. কোন স্থানকে কেন্দ্র করে বাংলার কেন্দ্রীয় শাসন মজবুত হয়?

লখনৌতি।

৪. বলবন কখন বাংলা অভিযান করেন?

১২৮০ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment