ফ্রান্সের জাতীয় মহাসভা বা ন্যাশনাল কনভেনশন গঠন, তিনটি বিপ্লবী প্রতিনিধি সভা, সংবিধান রচনার দায়িত্ব, জাতীয় মহাসভার নির্বাচন, সদস্য, বিভিন্ন দল, জাতীয় মহাসভার কার্যাবলী, রাজার বিচার, রাজার মৃত্যুদণ্ড, গিলোটিন যন্ত্র, মৃত্যুকালে রাজার উক্তি, হ্যাজেনের মন্তব্য, রাজার মৃত্যুদণ্ডের প্রতিক্রিয়া, কনভেনশন অবরোধ ও জিরণ্ডিনদের পতন সম্পর্কে জানবো।
ফরাসি জাতীয় মহাসভা বা ন্যাশনাল কনভেনশন প্রসঙ্গে ফরাসি অ্যাসেম্বলি, আইন প্রণয়নকারী সংস্থা, জাতীয় মহাসভার নির্বাচন, জাতীয় মহাসভার সদস্য, জাতীয় মহাসভা বা ন্যাশনাল কনভেনশন এর বিভিন্ন দল, জাতীয় মহাসভার কার্যাবলি, রাজার বিচার, রাজার মৃত্যুদণ্ড, রাজার মৃত্যুদণ্ডের প্রতিক্রিয়া, কনভেনশন অবরোধ সম্পর্কে জানব।
জাতীয় মহাসভা বা ন্যাশনাল কনভেনশন (১৭৯২-১৭৯৫ খ্রিঃ)
বিষয় | জাতীয় মহাসভা |
গঠিত | ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দ |
সময়কাল | ১৭৯২-১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দ |
রাজা | ষোড়শ লুই |
রাজার মৃত্যুদণ্ড | ২১ জানুয়ারি, ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ |
গিলোটিন যন্ত্র | ডাক্তার গিলোটিন |
সূচনা:- রাজার ক্ষমতাচ্যুতির ফলে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান বাতিল হয়ে যায়। আগে সম্পত্তির ভিত্তিতে ফরাসি নাগরিকদের ভোটাধিকার দেওয়া হত এবং এর ফলে একমাত্র বুর্জোয়াদেরই ভোটাধিকার ছিল। ‘দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লবের ফলে ২৫ বছর বয়স্ক পুরুষ মাত্রই ভোটাধিকার লাভ করে।
জাতীয় মহাসভা গঠন
গণভোটের মাধ্যমে যে নতুন আইনসভা গঠিত হয় (১৭৯২ খ্রিঃ) তার নাম ‘জাতীয় মহাসভা’ বা ‘ন্যাশনাল কনভেনশন’ (National Convention)। বিপ্লব শুরু হওয়ার পর এটি হল ফ্রান্স-এর তৃতীয় বিপ্লবী প্রতিনিধি সভা।
তিনটি বিপ্লবী প্রতিনিধি সভা
ফরাসি বিপ্লব -এর সময় তিনটি বিপ্লবী প্রতিনিধি সভা গঠিত হয়। প্রথমটি হল ‘সংবিধান সভা‘ (১৭৮৯-১৭৯১ খ্রিঃ), দ্বিতীয়টি হল ‘আইনসভা’ (১৭৯১-১৭৯২ খ্রিঃ) এবং তৃতীয়টি হল এই ‘জাতীয় মহাসভা’ (১৭৯২-১৭৯৫ খ্রিঃ)।
জাতীয় মহাসভার উপর সংবিধান রচনার দায়িত্ব
নতুন এই সভার উপর ফ্রান্সের নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব অর্পিত হয়।
জাতীয় মহাসভার নির্বাচন
- (১) দেশের অভ্যন্তরে তখন চরম অরাজকতা চলছে এবং সীমান্তে বিদেশি আক্রমণ অব্যাহত-জাতীয় জীবনের এরকম এক সংকটময় পরিস্থিতিতে ফ্রান্সে জাতীয় মহাসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
- (২) ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান সভার নির্বাচনের তুলনায় এই নির্বাচন ব্যবস্থা অনেক উদার ও প্রগতিশীল হলেও সব স্তরের মানুষ এতে অবাধ ভোটাধিকার পায় নি। শ্রমজীবী এবং গৃহভৃত্যরা ভোটাধিকার পায় নি।
- (৩) এছাড়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে বহু মানুষ নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন নি। কোবান-এর মতে, মাত্র দশ শতাংশ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।
ন্যাশনাল কনভেনশন বা জাতীয় মহাসভার সদস্য
- (১) ন্যাশনাল কনভেনশনের ৭৫০ জন সদস্যের অধিকাংশ ছিলেন নবাগত। ৯৬ জন ছিলেন পূর্বতন সংবিধান সভার এবং ১৯০ জন ছিলেন আইনসভার সদস্য।
- (২) এঁদের অধিকাংশই ছিলেন পূর্বতন রাজকর্মচারী, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, বণিক, শিক্ষক ও চিকিৎসক। শ্রমিক প্রতিনিধি ছিলেন মাত্র দু’জন।
- (৩) কৃষকদের কোনও প্রতিনিধি ছিল না। মূলত এটি ছিল একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিদের সমাবেশ।
জাতীয় মহাসভার বিভিন্ন দল
এখানে তিনটি দলের অস্তিত্ব ছিল। যথা –
(১) জিরণ্ডিন দল
জিরণ্ডিন -রা ছিল নম্র বামপন্থী। তারা সভাকক্ষের ডানদিকে বসত। ন্যাশনাল কনভেনশনে তারা দক্ষিণপন্থী বলে পরিচিত ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল ফ্রান্সের সর্বত্র অরাজকতা দমন, একটি স্থায়ী সরকার গঠন এবং সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ড -এর নায়কদের শাস্তি বিধান করা। এই দল মূলত বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করত।
(২) জেকোবিন দল
জেকোবিন-রা সভাকক্ষের বাম দিকে বসত। তাদের আসনগুলি ছিল উঁচু জায়গায়। এজন্য তাদের বলা হত ‘মাউন্টেন’ (Mountain)। এরা ছিল খুব উগ্র। মূলত মধ্যবিত্তদের নিয়ে গঠিত হলেও এই দলে সাধারণ মানুষের সংখ্যা ছিল প্রচুর।
(৩) স্বাধীন বা নিরপেক্ষ দল
জিরণ্ডিন ও জেকোবিনদের মধ্যবর্তী স্থানে বসত স্বাধীন বা নিরপেক্ষ দল। এদের বলা হত ‘মাস’ (Marsh) বা ‘প্লেন’ (Plain)।
জাতীয় মহাসভার কার্যাবলী
১৭৯২ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল কনভেনশনের অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে গৃহীত বা ঘোষিত বিষয়গুলি হল –
- (১) অধিবেশনের দিনই সর্বসম্মতভাবে ফ্রান্সে রাজতন্ত্র বিলোপ করে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়। ২১ সেপ্টেম্বর নব-প্রবর্তিত প্রজাতান্ত্রিক অব্দের প্রথম দিন বলে গণ্য হল।
- (২) প্রচলিত রোমান বর্ষপঞ্জির পরিবর্তে বিপ্লবী বর্ষপঞ্জী গৃহীত হয় এবং রোমান ও টিউটন দেবদেবীর নামানুসারে বিপ্লবী মাসের নামকরণ করা হয়।
- (৩) ওজন ও পরিমাণ পদ্ধতির সংস্কার করে ‘মেট্রিক পদ্ধতির (Metric system) প্রচলন হয়।
- (৪) রাষ্ট্রীয় সংহতিকে সুদৃঢ় করার জন্য একমাত্র ফরাসি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা বলে ঘোষণা করা হয়।
- (৫) দেশত্যাগী অভিজাত বা এমিগ্রিদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
- (৬) বাজেয়াপ্ত করা সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ বাতিল করা হয়।
- (৭) শস্য ও পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেওয়া হয়।
- (৮) শিক্ষার প্রসার, রাষ্ট্রীয় আইনের সংকলন এবং জাতীয় গ্রন্থাগার ও মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়।
- (৯) পিতার সম্পত্তিতে সকল সন্তানের সমান অধিকার এবং মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত হয়।
- (১০) কৃষক, দোকানদার ও ছোটো কারখানার কর হ্রাস করা হয়।
রাজার বিচার
- (১) রাজার বিচারকে কেন্দ্র করে জিরণ্ডিন ও জেকোবিন দলের বিরোধ চরমে ওঠে। উগ্রপন্থী জেকোবিন দল রাজার মৃত্যুদণ্ড দাবি করে। রোবসপিয়র বলেন যে, “রাষ্ট্রকে বাঁচাতে গেলে রাজাকে মরতে হবে” (“The king must die that the state may live.”)।
- (২) তাদের যুক্তি ছিল যে, ইতিপূর্বে দেশদ্রোহিতার অপরাধে রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করা হয়েছে। সুতরাং আর কোনও বিচারের প্রয়োজন নেই। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখলে তিনি আবার বিপ্লব-বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে সিংহাসন দখলের চেষ্টা করবেন।
- (৩) অপরদিকে, জিরণ্ডিরা মৃত্যুদণ্ড বাদে অন্য যে কোনও শাস্তির পক্ষপাতী ছিল। তারা মনে করত যে, রাজার শাস্তিদানের বিষয়টি গণভোটে স্থির হওয়া উচিত। বাস্তবে কিন্তু তা হয় নি।
রাজার মৃত্যুদণ্ড
ন্যাশনাল কনভেনশন সামান্য ভোটের ব্যবধানে রাজাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২১শে জানুয়ারি হতভাগ্য রাজা ষোড়শ লুই গিলোটিনে প্রাণ দেন।
গিলোটিন যন্ত্র
গিলোটিন হল এক ধরনের যন্ত্র, যার দ্বারা অতি সহজেই একসঙ্গে বহু মানুষের মুণ্ডচ্ছেদ করা যেত। এর আবিষ্কারক ছিলেন ডাঃ গিলোটিন নামক জনৈক চিকিৎসক।
মৃত্যুকালে রাজার উক্তি
মৃত্যুদণ্ডকালে রাজা বিন্দুমাত্র বিচলিত হন নি। উন্নত শিরে গিলোটিনের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করেন যে, “. . . . . . আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমার রক্ত ফ্রান্সের সুখ নিশ্চিন্ত করুক।”
হ্যাজেনের মন্তব্য
অধ্যাপক হ্যাজেন -এর মতে, “সিংহাসনের তুলনায় ফাঁসির মঞ্চে তিনি ছিলেন বেশি মহান।
রাজার মৃত্যুদণ্ডের প্রতিক্রিয়া
রাজার মৃত্যুদণ্ড সমগ্র ইউরোপকে স্তম্ভিত, সন্ত্রস্ত ও ভীত করে। ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ হলেও রাজার এই নিষ্ঠুর পরিণতির জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। এর প্রতিক্রিয়া গুলি হল –
- (১) ইতিপূর্বে প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল। এবার ইংল্যান্ড, রাশিয়া, স্পেন, হল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, সার্ডিনিয়া, নেপলস্ প্রভৃতি রাষ্ট্র তাদের সঙ্গে যোগ দিল। গঠিত হল প্রথম শক্তিজোট (First Coalition)।
- (২) বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ফ্রান্স পরপর পরাজিত হতে থাকে। পরাজিত জিরণ্ডিন সেনাপতি দ্যুমুরিয়ে অস্ট্রিয়ার পক্ষে যোগ দেন। এর ফল হয় মারাত্মক।
- (৩) এই সময় দেশের অভ্যন্তরে লা-ভেণ্ডি নামক স্থানে রাজভক্ত কৃষকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিদ্রোহ ক্রমে ভদেঁ, লিয়, বোর্দ, মাসেই প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
- (৪) আবার এই সময়েই দেশজোড়া খাদ্যাভাব ও আর্থিক সংকট চরমে ওঠে। জনতা ‘অ্যাসাইনেট’ নামক মুদ্রা নিতে অস্বীকার করে। সরকার নতুন কর আরোপ করে নির্জ আর্থিক সংকট মেটাবার চেষ্টা করলে জনসাধারণ এর বিরোধিতা শুরু করে।
- (৫) সরকার ‘জবরদস্তি ঋণ’ (Forced Loan) আদায়ে সচেষ্ট হলে প্রতিবাদ ওঠে। এই অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য গঠিত হয় গণ-নিরাপত্তা কমিটি (এপ্রিল ১৭৯৩)।
কনভেনশন অবরোধ
সারা দেশ জুড়ে গোলমাল চলছে। জিরণ্ডিন-জোকোবিন বিবাদও চরম আকার নিয়েছে। গৃহযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় জেকোবিনরা ২রা জুন রক্ষীবাহিনীর ৮০ হাজার সেনা নিয়ে টুইলারিস প্রাসাদ অর্থাৎ যেখানে কনভেনশন-এরঅধিবেশন চলছিলতা অবরোধ করে। কনভেনশন এবং ফ্রান্সের সরকার একপ্রকার বন্দি হয়ে সম্পূর্ণভাবে জনতার দয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
জিরণ্ডিনদের পতন
জেকোবিনরা কামানের ভয় দেখিয়ে কনভেনশনকে ২৯ জন জিরণ্ডিন সদস্য ও ২ জন মন্ত্রীকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে (২রা জুন, ১৭৯৩ খ্রিঃ)। এইভাবে জিরণ্ডিনদের পতন ঘটে এবং উগ্রপন্থী জেকোবিনরা ক্ষমতা দখল করে।
উপসংহার:- জিরণ্ডিনদের পতনের মাধ্যমে উচ্চ বুর্জোয়াদের ক্ষমতার বিনাশ হয় এবং সাঁকুলোৎ বা সর্বহারা শ্রেণি ক্ষমতার পাদপ্রদীপে উঠে আসে।
(FAQ) জাতীয় মহাসভা বা ন্যাশনাল কনভেনশন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে।
জিরণ্ডিন, জেকোবিন ওস্বাধীন বা নিরপেক্ষ দল।
২১ জানুয়ারি ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে।
গিলোটিন যন্ত্র।
ডাক্তার জোসেফ গিলোটিন।