লোককথা

লোককথা প্রসঙ্গে সংজ্ঞা, লোককথার কাহিনীর উদ্ভব, ভারতের লোককথার নিদর্শন, ইউরোপে লোককথার কাহিনী সংগ্ৰহ, লোককথার বৈশিষ্ট্য, উদাহরণ, ইতিহাসে গুরুত্ব ও তার সমালোচনা সম্পর্কে জানবো।

ঐতিহ্যবাহী লৌকিক সাহিত্য লোককথা প্রসঙ্গে লোককথা কী, লোককথার অর্থ, লোককথার সংজ্ঞা, লোককথার উদ্ভব, লোককথার বৈশিষ্ট্য, লোককথার উদাহরণ ও ইতিহাসে লোককথার গুরুত্ব সম্পর্কে জানব।

লোককথা

ঐতিহাসিক বিষয়লোককথা
ঠাকুমার ঝুলিদক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার
বুড়ো আংলাঅবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ইউরোপের লোককথাটম থাম্ব ও দৈত্যের কাহিনী
বাংলার লোককথাবেহুলা লখিন্দরের কাহিনী
আলিবাবা ও চল্লিশ চোরআরব্য রজনী
লোককথা

ভূমিকা :- লোককথা হল এক ধরনের কাল্পনিক গল্পকথা এবং এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী লৌকিক সাহিত্য যার সাহায্যে প্রাকৃতিক বা আধ্যাত্মিক কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা বা উপলব্ধির চেষ্টা করা হয়। এই কাহিনিগুলি কোনো অতীত বা ঐতিহাসিক ঘটনার অনুকরণে সৃষ্টি হতে পারে।

লোককথার সংজ্ঞা

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লোককথার সংজ্ঞা দেওয়া যায়। যেমন –

(ক) জীবন ও কল্পনার সংমিশ্রণ

কার্ল টমলিনসন ও ক্যারল লিঞ্চ-ব্রাউন-এর মতে, মানুষের জীবন ও কল্পনার সংমিশ্রণে যেসব গল্পগাথা গড়ে উঠেছে তাই হল লোককথা। এসব গল্পগাথা যুগের পর যুগ ধরে বংশপরম্পরায় প্রচলিত হয়ে আসছে। এসব কল্প-কাহিনিগুলি সেই সমাজ বা সভ্যতার ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য, যা প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক জগতকে বোঝার ও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।

(খ) প্রাকৃতিক আইনের অনুপস্থিতি

লোককথা হল এক ধরনের কাল্পনিক গল্পগাথা যা শ্রোতাদের এমন এক জগতে নিয়ে যায় যেখানে প্রাকৃতিক আইন কার্যকরী হয় না। অর্থাৎ প্রাকৃতিক বা সাধারণ নিয়মকানুনগুলি লোককথার গল্পে কার্যকরী হতে দেখা যায় না।

লোককথার কাহিনীর উদ্ভব

এই লোককথার কাহিনিগুলির উদ্ভবকাল সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছুই জানা যায় না। তবে গবেষকগণ অনুমান করেন যে, বিভিন্ন দেশের লোককথার কাহিনিগুলির উৎপত্তি হয়েছে সভ্যতা বিকাশের আদি লগ্নে এবং বিভিন্ন সমাজ বা সংস্কৃতির মৌখিক ঐতিহ্য থেকে। অতীতকাল থেকে মানুষের মুখে মুখে বংশপরম্পরায় এক পূর্বপুরুষ থেকে উত্তরপুরুষের কাছে চলে আসছে।

ভারতে লোককথার নিদর্শন আমাদের দেশ ভারতবর্ষ -এ প্রায় হাজার বছর আগে রচিত নারায়ণ পণ্ডিতের ‘হিতোপদেশ’, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে বিষ্ণুশর্মা রচিত ‘পঞ্চতন্ত্র’ এবং খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রচিত জাতক কাহিনি লোককথার অন্যতম নিদর্শন।

ইউরোপে লোককথার কাহিনী সংগ্ৰহ

উনিশ শতকে ইউরোপ-এর বিভিন্ন লোককথার কাহিনিগুলি সংগ্রহ করে গবেষকগণ লিখিত বইয়ের আকারে প্রকাশ করতে শুরু করেন। ডেনমার্কের হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন, জার্মানির জ্যাকব ও উইলহেম গ্রিম ভাতৃদ্বয় প্রমুখ লোককথার অন্যতম জনপ্রিয় গল্পকার ছিলেন।

লোককথার বৈশিষ্ট্য

লোককথার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –

(১) শিশুদের জন্য রসদ

কিংবদন্তি, পুরাণ প্রভৃতির কাহিনিগুলিতে শিশু-কিশোর, যুবক, বয়স্ক প্রভৃতি সকলের জন্য রসদ থাকে। কিন্তু লোককথায় সাধারণত শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য রসদ থাকে।

(২) অজ্ঞাত পরিচয় লেখক

সাধারণভাবে লোককথার প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা বা রচয়িতাদের পরিচয় সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে আসল লোককথাগুলি পরিমার্জন করে যাঁরা এগুলি আবার প্রকাশ করেন তাঁদের কিছু কিছু নাম বা পরিচয় সম্পর্কে জানা যায়।

(৩) অলিখিত কাহিনি

লোককথার কাহিনিগুলি সাধারণত অলিখিত হয়। অবশ্য বর্তমানকালে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার লোককথাগুলি সংগ্রহ করে বিভিন্ন গবেষক লিখিত বইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করছেন।

(৪) ধর্মীয় বিষয়ের গুরুত্বহীনতা

লোককথার কাহিনিতে ধর্মীয় বিষয়বস্তুর বিশেষ গুরুত্ব লক্ষ্য করা যায় না। এসব কাহিনিতে স্বর্গীয় বা ঐশ্বরিক ঘটনার বর্ণনার বিশেষ গুরুত্ব নেই।

(৫) মানুষের আলোচনা

লোককথার বর্ণনায় মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন সাধারণ ঘটনাবলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ দুঃখের বিষয়গুলি লোককথার গল্পে বিশেষ গুরুত্ব পায়।

(৬) অতিপ্রাকৃতিক বিষয়

লোককথার কাহিনির মধ্যে মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃতিক চরিত্র, যেমন – ডাইনি, দৈত্য, পরি, ড্রাগন প্রভৃতি থাকে। তা ছাড়া এসব কাহিনিতে বিভিন্ন পশুপাখি, ম্যাজিকের ঘটনা প্রভৃতি থাকে।

(৭) ব্যক্তিত্ব আরোপ

লোককথার গল্পগুলিতে বিভিন্ন পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের মধ্যে মানুষের মতো ব্যক্তিত্ব আরোপিত হতে দেখা যায়। তারা মানুষের মতো কথা বলে এবং নিজেদের চিন্তার প্রকাশ ঘটায়।

(৮) অনির্দিষ্ট স্থান কাল পাত্র

লোককথার গল্পের স্থান-কাল-পাত্রের কোনো সুনির্দিষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় না। “একদা এক দেশে এক রাজা বাস করত” – এই ধরনের অনির্দিষ্ট স্থান-কাল-পাত্র দিয়ে লোককথার গল্পগুলি শুরু হয়।

(৯) প্রসার

সুদারল্যান্ড ও আলবাধনট মনে করেন যে, দূরদেশে যাত্রা করা নাবিক, সন্ন্যাসী, চারণকবি, যোদ্ধা, যুদ্ধে শত্রুপক্ষকে পরাজিত ও বন্দি করে নিয়ে যাওয়া শত্রুপক্ষের যোদ্ধা, ক্রীতদাস, নারী প্রমুখের মাধ্যমে কোনো সমাজের লোককথার কাহিনিগুলি দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

লোককথার উদাহরণ

বিভিন্ন দেশের সমাজে বিভিন্ন লোককথার গল্পগাথাগুলি হল –

(১) সাত ভাই চম্পা

দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ঠাকুরমার ঝুলি নামক বাংলার লোককথার গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই বইয়ের একটি জনপ্রিয় গল্প হল সাত ভাই চম্পা। এক রাজার তিনজন রানির কাহিনি নিয়ে এই গল্প গড়ে উঠেছে। এই তিনজন রানির কোনো সন্তান ছিল না। পরে ছোটো রানি সাতটি ছেলে ও একটি মেয়ের জন্ম দিলে অন্য রানিরা রাজার অলক্ষ্যে শিশু গুলিকে মাটিতে পুঁতে দেয় এবং রাজাকে জানায় যে রানির গর্ভে সাতটি ব্যাঙ ও একটি ইঁদুর জন্মগ্রহণ করেছে। এই খবরে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজা ছোটো রানিকে প্রাসাদ থেকে বের করে দেন। অনেকদিন পর রাজা প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে অন্য রানিদের প্রাসাদ থেকে বের করে দেন।

(২) আলিবাবা ও চল্লিশ চোর

আরব্য রজনির লোককথায় আছে যে, জনৈক কাশেম তার দাদা আলিবাবার সম্পত্তি দখল করে নিলে আলিবাবা সবকিছু ছেড়ে দিয়ে জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। একদিন তিনি জঙ্গলে দূর থেকে দেখেন যে, চল্লিশ চোর চিচিং ফাঁক বলে ধনরত্ন ভরা একটি গুপ্ত গুহার দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। চোরদের অনুপস্থিতিতে আলিবাবাও চিচিং ফাক বলে গুহায় ঢুকে প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে ঘরে ফিরলেন। এই কাহিনি শুনে তার ভাই কাশেম চিচিং ফাঁক বলে গুহায় ঢুকে ধনরত্ন নিলেও চিচিং ফাঁক কথাটি ভুলে গিয়ে গুহা থেকে আর বেরোতে পারেনি। পরে চোরের দল এসে তাকে হত্যা করে।

(৩) লখিন্দরের জীবনপ্রাপ্তি

গ্রাম বাংলায় প্রচলিত উল্লেখযোগ্য লোককথার গল্প হল বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি। শিবের উপাসক ধনী বণিক চাঁদ সদাগর মর্তে মনসাকে পূজা দিতে অস্বীকার করলে মনসার অভিশাপে লখিন্দর ছাড়া চাঁদের সকল পুত্রের মৃত্যু হয়। লখিন্দরও বাসরঘরে সর্পাঘাতে মারা যান। মনসার কাছে লখিন্দরের প্রাণ ফেরানোর প্রার্থনা করে মৃতদেহ নিয়ে লখিন্দরের স্ত্রী বেহুলা মাসের পর মাস ভেলায় চড়ে বহু পথ পাড়ি দেন। মৃতদেহে পচন ধরে। শেষপর্যন্ত মনসার বরে লখিন্দর প্রাণ ফিরে পায় এবং পুত্রবধুর অনুরোধে চাঁদ সদাগরও মনসার পুজো দিতে রাজি হন এবং মর্তে শুরু হয় মনসা পূজা

(৪) টম থাম্ব ও দৈত্যের কাহিনী

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে টম থাম্ব ও দৈত্যের লোককথাটি প্রচলিত রয়েছে। টম থাম্বের কাহিনি হল রিচার্ড জনসন কর্তৃক প্রকাশিত (১৩০১ খ্রি.) ইংরেজি ভাষায় মুদ্রিত প্রথম লোককথার গল্প। এই গল্পের মূল কাহিনি হল টম থাম্ব তার বাবার বুড়ো আঙুলের চেয়ে ছোটো। ফলে অনায়াসেই গোরু তাকে গিলে ফেলতে পারে। একসময় এক রাক্ষস তাকে গিলে ফেললেও শেষপর্যন্ত বমি করে তাকে সমুদ্রে উগরে দিতে বাধ্য হয়। এরপর সমুদ্রের একটি মাছ টমকে খেয়ে ফেলে। ঘটনাচক্রে সেই মাছটি কিং আর্থারের খাবারের জন্য ধরে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। মাছটি কাটলে টম বেরিয়ে আসে এবং রাজপ্রাসাদে থাকতে থাকতে রাজার অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠে। টম থাম্বের গল্পের অনুকরণে বাংলায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন ‘বুড়ো আংলা’। বুড়ো আঙুলের সমান আংলা হাঁসের পিঠে চড়ে সারা দেশের ওপর দিয়ে উড়ে বেড়ায় এবং দেশের পরিচয় তুলে ধরে।

ইতিহাসে লোককথার গুরুত্ব

লোককথার কাহিনিগুলি ইতিহাস নির্ভর না হলেও ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যেমন –

(১) সমাজ সংস্কৃতির পরিচয়

কোনো সমাজে সৃষ্ট লোককথাগুলিতে সেই সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি বিষয়ের যথেষ্ট প্রভাব পড়ে। ফলে অতীতকালে সেই সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ঐতিহ্য কেমন ছিল তার মোটামুটি আভাস সেই সমাজে সৃষ্ট লোককথার কাহিনিগুলি থেকে জানা যায়।

(২) ঐতিহাসিক ধাঁচের আভাস

বিভিন্ন সমাজের ঐতিহাসিক কাহিনির অনুকরণে বিভিন্ন লোককথার প্রচলন ঘটতে দেখা যায়। এরুপ লোককথার কাহিনিগুলি থেকে সেই সমাজের ঐতিহাসিক ধাঁচ সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়, যেমন – মধ্যযুগের বাংলার চাঁদ সদাগরের কাহিনিতে সপ্তডিঙা মধুকর ভাসিয়ে দূরদেশে চাঁদের বাণিজ্য করতে যাওয়ার যে ঘটনা বাংলার লোককথায় পাওয়া যায় তা থেকে এই ঐতিহাসিক সত্যটুকু অবশ্যই উপলব্ধি করা যায় যে, সে যুগে বাংলার বণিকরা দূরদেশে বাণিজ্য করতে যেত।

(৩) আনন্দদান

মনোরম লোককথার গল্পগুলি অতীতকালের মানুষকে যুগের পর যুগ ধরে আনন্দদান করেছে। যে যুগে বিজ্ঞানের বিশেষ উন্নতি ঘটেনি বা শিক্ষার প্রসার ঘটেনি সে যুগে লোককথার গল্পগুলি ছিল মানুষের মনোরঞ্জনের অন্যতম মাধ্যম।

(৪) শিক্ষাদান

লোককথার গল্পগুলি মানুষকে জীবনে চলার পথে যথার্থ শিক্ষা দান করে। এজন্য বিখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন যে, “যদি তোমার সন্তানকে বুদ্ধিমান করে তুলতে চাও তবে তাদের লোককথার গল্প পড়তে দাও। যদি তাদের আরও বুদ্ধিমান করে তুলতে চাও তবে তাদের আরও বেশি লোককথার গল্প পড়তে দাও।”

সমালোচনা

লোককথার গল্পগুলির অধিকাংশই হয় সম্পূর্ণ কাল্পনিক। অধিকাংশ কাল্পনিক লোককথার গল্পেরই কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকে না, যেমন – বেহুলার প্রার্থনায় লখিন্দরের প্রাণ ফিরে পাওয়ার ঘটনাটির কোনো ঐতিহাসিক বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

উপসংহার :- আসলে লোককথার আজব কাহিনির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ইতিহাস ভুল পথে পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ঐতিহাসিক কে সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে।

(FAQ) লোককথা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. লোককথা কি?

লোককথা হল এক ধরনের কাল্পনিক গল্পকথা এবং এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী লৌকিক সাহিত্য যার সাহায্যে প্রাকৃতিক বা আধ্যাত্মিক কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা বা উপলব্ধির চেষ্টা করা হয়।

২. ঠাকুমার ঝুলি কে রচনা করেন?

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার।

৩. ইউরোপের একটি লোককথার উদাহরণ দাও।

টম থাম্ব ও দৈত্যের কাহিনী।

৪. বাংলার একটি জনপ্রিয় লোককথার উদাহরণ দাও।

বেহুলা লখিন্দরের কাহিনী।

Leave a Comment