মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দাক্ষিণাত্য অভিযান প্রসঙ্গে পিতার নীতির অনুরূপ, নিজাম শাহী বংশ, মালিক অম্বর, আভ্যন্তরীণ শাসনের সুবন্দোবস্ত, গেরিলা বাহিনী গঠন, গোলকুন্ডা ও বিজাপুর দখলের বাসনা, খান-ই-খানানের অভিযান, খুররমের অভিযান ও মালিক অম্বরের কৃতিত্ব সম্পর্কে জানবো।
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দাক্ষিণাত্য অভিযান
বিষয় | জাহাঙ্গীরের দাক্ষিণাত্য অভিযান |
মুঘল বাদশা | জাহাঙ্গীর |
প্রথম অভিযান | ১৬০৮ খ্রি |
দ্বিতীয় অভিযান | ১৬১০ খ্রি |
আহমদনগরের মন্ত্রী | মালিক অম্বর |
খুররম | শাহজাহান |
ভূমিকা :- জাহাঙ্গির দাক্ষিণাত্যে আকবরের সম্প্রসারণ নীতিই গ্রহণ করেন। আকবরের সময় আহম্মদনগরের পতন ঘটলেও, উক্ত রাজ্য সম্পূর্ণরূপে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় নি। জাহাঙ্গিরও সমগ্র ভারতবর্ষকে তার শাসনের অধীনে আনতে চেয়েছিলেন।
পিতার নীতির অনুরূপ
- (১) জাহাঙ্গিরের দাক্ষিণাত্য নীতি তাঁর পিতার দাক্ষিণাত্য নীতিরই অনুরূপ। জাহাঙ্গিরও তাঁর পিতার মতো প্রাচীন ভারতীয় নরপতিদের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন যে, উত্তর ভারত দক্ষিণ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
- (২) তিনিও পিতার মতোই দাক্ষিণাত্যকে প্রথমে আপস নীতির মাধ্যমে নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আপস নীতি ব্যর্থ হলে যুদ্ধের পথ গ্রহণ করেন।
নিজাম শাহী বংশ
১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে আকবরের মৃত্যুর সময় সমগ্র খান্দেশে মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত থাকলেও, আহম্মদনগরের মাত্র একাংশ মুঘলদের অধীনে ছিল। আর এক অংশের মালিক ছিলেন অম্বর নামে জনৈক মন্ত্রীর পরিচালনায় নিজামশাহি বংশের জনৈক রাজপুত্র দ্বিতীয় মুর্তজা নিজাম শাহ।
মালিক অম্বর
আহম্মদনগরের একাংশ মুঘলদের অধীনে থাকায়, মালিক অম্বর খরকিতে রাজধানী স্থাপন করেন। মালিক অম্বর ছিলেন প্রথম জীবনে একজন হাবসি ক্রীতদাস। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন উঁচুমানের সামরিক দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি। মুঘল সাম্রাজ্যের হাত থেকে তিনি তার কর্মস্থল দাক্ষিণাত্যের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেন।
আভ্যন্তরীণ শাসনের সুবন্দোবস্ত
তিনি জানতেন, কোনো রাজ্যকে শক্তিশালী করতে হলে, প্রথমত, তার অভ্যন্তরীণ শাসনের সুবন্দোবস্ত করা প্রয়োজন। তার জন্য মালিক অম্বর নিজরাজ্যের ভূমি-রাজস্ব ও কর-সংক্রান্ত বহু সংস্কারসাধন করেন।
গেরিলা বাহিনী গঠন
কেবলমাত্র বেতনভুক মুসলমান সৈন্য দ্বারা মুঘল সৈন্যের দুর্ধর্ষ গতি রুদ্ধ করা সম্ভব নয়, এটা উপলব্ধি করে মালিক অম্বর মারাঠাদের নিয়ে গেরিলা বাহিনীও গড়ে তোলেন। এছাড়া তিনি বিজাপুর ও গোলকুন্ডা রাজ্যের সঙ্গে সন্ধি করেন।
বিজাপুর ও গোলকুন্ডা দখলের বাসনা
বাদশাহি সৈনাদল বহু চেষ্টা করেও মালিক অম্বরকে পরাজিত করতে সক্ষম হয় নি। কারণ, জাহাঙ্গিরের বিজাপুর ও গোলকুন্ডা দখলের বাসনা ছিল।
খান-ই-খানান-এর অভিযান
১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গির খান-ই-খানান-এর নেতৃত্বে ১২,০০০ সৈন্যের এক বাহিনী দাক্ষিণাত্য অভিযানে প্রেরণ করেন। খান-ই-খানান এই অভিযানে মুঘলদের কিছুটা সুবিধা করতে সমর্থ হন। কারণ মালিক অম্বরের চূড়ান্ত বিরোধিতার সম্মুখীন হন তিনি।
খান-ই-জাহান ও টোডরমলের অভিযান
১৬১০ খ্রিস্টাব্দে খান-ই-জাহানকে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু তিনিও সুবিধা করতে না পারায়, ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে খান-ই-জাহান ও মানসিংহ একদিক থেকে এবং আবদুল্লা অপরদিকে থেকে আহম্মদনগর আক্রমণ করেন। কিন্তু আবদুল্লা খানের হঠকারিতায় এই অভিযানও ব্যর্থ হয়।
জাহাঙ্গীরের ব্যস্ততা
ইতিমধ্যে জাহাঙ্গির মেবার অভিযানে ব্যস্ত হয়ে পড়ায়, মালিক অম্বর মুঘলদের অধিকৃত স্থানের ওপর আক্রমণ করেন। জাহাঙ্গির মেবার জয় করার পর যুবরাজ খুররমকে দাক্ষিণাত্য অভিযানে পাঠান।
খুররমের অভিযান
- (১) ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ খুররম-এর হাতে মালিক অম্বর পরাজিত হন এবং ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে উভয়ের মধ্যে এক সন্ধি স্থাপিত হয়। এই সন্ধির ফলে মালিক অম্বর বালাঘাট অঞ্চল ও আহম্মদনগর দুর্গ মুঘলদের ছেড়ে দেন এবং বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা কর দিতে প্রতিশ্রুত হন।
- (২) এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে জাহাঙ্গির উৎফুল্ল হয়ে খুররমকে ‘শাহজাহান’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং দরবারে তাঁর রাজনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।
পুনরায় খুররমের অভিযান
মালিক অম্বর তিন বছর পর ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দের সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করেন এবং মারাঠা সৈন্যদলের সাহায্যে মুঘলদের বিতাড়িত করার উদ্দেশ্যে আহম্মদনগর দুর্গ আক্রমণ করেন। জাহাঙ্গির দাক্ষিণাত্যে পুনরায় খুররমকে পাঠান। খুররম দৌলতাবাদ অবরোধ করেন এবং কির্কী অধিকার করেন।
মুঘলদের সাথে সন্ধি
মালিক অম্বর খুররমের হাতে পরাজিত হন এবং ১৬২১ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় তিনি মুঘলদের সঙ্গে এক নতুন সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধির ফলে মুঘলদের প্রাপ্য স্থানগুলি ফিরিয়ে দেন এবং ১২ লক্ষ টাকা জরিমানা দেন। বিজাপুর ১৮ লক্ষ টাকা এবং গোলকুন্ডা ২০ লক্ষ টাকা মুঘলদের নজরানা দেয়। এই সন্ধি শাহজাহানের অভাবনীয় মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
খুসরভের মৃত্যু
১৬২১ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যে শাহজাহান তাঁর পিতার অসুস্থতার সংবাদ পান। কিছুদিন পর যুবরাজ খুসরভের মৃত্যু ঘটে। অনেকে মনে করেন, ঘুসরভের মৃত্যুর পিছনে শাহজাহানের হাত ছিল।
দুঃখিত জাহাঙ্গির
জাহাঙ্গির খুসরভের মৃত্যুতে অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছিলেন। কারণ, খুসরভ ছিলেন গুণের দিক থেকে মুঘল রাজপুত্রদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। সভাসদ ও অনেকেই তাঁকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুঘল রাজ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজকুমার খসরুর ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের করুণ কাহিনি খুবই নির্মম।
যুবরাজ খুররমের বিদ্রোহ
এরপর যুবরাজ খুররম পিতার বিরুদ্ধাচরণ করেন। তাঁর বিদ্রোহের প্রতিবাদে সম্রাট জাহাঙ্গির তখন নিযুক্ত করেন সেনাপতি মহাবৎ খান ও যুবরাজ পরভেজকে। খুররম মহাবৎ খানের হাতে পরাজিত হয়ে বঙ্গদেশে পলায়ন করেন।
মালিক অম্বরের কৃতিত্ব
- (১) ১৬২৬ খ্রিস্টাব্দে মালিক অম্বরের মৃত্যু হয়। ক্রীতদাস হলেও মালিক অম্বর বহু গুণের অধিকারী ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বিবেচনাশক্তি ও শাসক হিসেবে তিনি অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
- (২) তাঁর শাসন-দক্ষতায় দাক্ষিণাত্যের পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহ দীর্ঘদিন স্থগিত ছিল এবং তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন শাসনব্যবস্থায় কৃতিত্বের পরিচয় রাখেন।
ঈশ্বরীপ্রসাদের মন্তব্য
তাই ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেছেন, তিনিই মারাঠা জাতিকে প্রথম গেরিলা যুদ্ধের শিক্ষা দেন। প্রকৃতপক্ষে তারই পরাক্রমে জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালে দাক্ষিণাত্যে মুঘল সাম্রাজ্য যথেষ্ট বিস্তারলাভ করতে সমর্থ হয়নি।
নীতির ফলাফল
জাহাঙ্গিরের নীতি দাক্ষিণাত্যে খুব সফল হয়েছিল বলা যায় না। কারণ, তিনি আহম্মদনগরের নিজামশাহি বংশকে বিলুপ্ত করতে পারেন নি। উপরন্ত মালিক অম্বরের সঙ্গে যুদ্ধে তিনি পর্যুদস্ত হয়েছিলেন।
উপসংহার :- মালিক অম্বর সন্ধি-স্বাক্ষর করতে বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও, গোলকুন্ডার সঙ্গে জাহাঙ্গির সম্পর্ক স্থাপন না করে মুঘলদের চরম বাধার সম্মুখীন করেছিলেন।
(FAQ) মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দাক্ষিণাত্য অভিযান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মালিক অম্বর।
১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে।
খুররম।
১৬২৬ খ্রিস্টাব্দে।