শিল্প ও পুঁজিবাদী মূলধন

শিল্প ও পুঁজিবাদী মূলধন প্রসঙ্গে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব, শিল্প মূলধন পুঁজিপতিদের উদ্ভব, পণ্য বিক্রয়, কাঁচামাল সংগ্রহ, সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা, উপনিবেশ দখলের প্রয়োজনীয়তা, পুঁজি বিনিয়োগ, উপনিবেশের প্রসার, শিল্প ও পুঁজিবাদী মূলধনের সমালোচনা সম্পর্কে জানবো।

শিল্প ও পুঁজিবাদী মূলধন

ঐতিহাসিক বিষয়শিল্প ও পুঁজিবাদী মূলধন
শিল্প বিপ্লবইংল্যান্ড
নতুন অর্থনৈতিক চিন্তাঅ্যাডাম স্মিথ
পুঁজিবাদের বিকাশইউরোপ
সমাজবাদের বিকাশরাশিয়া
শিল্প ও পুঁজিবাদী মূলধন

ভূমিকা :- অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে মার্কেন্টাইল নামে অর্থনৈতিক মতবাদ ইউরোপে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। তবে মার্কেন্টাইলবাদ ইউরোপে পরোক্ষ ধনতন্ত্রবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিকাশে সহায়তা করে। এই সময় ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের নেতৃত্বে নতুন ধারার অর্থনৈতিক চিন্তা ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব

অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে বিশেষ করে ঊনবিংশ শতকে ইউরোপে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হলে এক শ্রেণির বণিকদের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ জমা হয়। এই মূলধন শিল্প ও বাণিজ্যের নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে আরও বাড়তি মুনাফা লাভে সচেষ্ট হয়। এভাবে ইউরোপে এক ধরনের পুঁজিপতি বা মূলধনি শ্রেণির উদ্ভব ঘটে।

শিল্প মূলধন

শিল্প, কৃষি, নির্মাণ, পরিবহণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুনাফা অর্জন করার লক্ষ্য নিয়ে যে পুঁজি বিনিয়োগ করা হয় তা সাধারণভাবে শিল্প মূলধন নামে পরিচিত।

পুঁজিপতিদের উদ্ভব

  • (১) ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের ঘটনা পুঁজিবাদের উদ্ভব ঘটায়। ইংল্যান্ডে ১৭৬০-৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শিল্পবিপ্লবের সূচনা হলেও এর দ্রুত প্রসার শুরু হয় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের পর। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগের শুরুতে ফ্রান্সজার্মানিতে এবং অন্যান্য রাষ্ট্রগুলিতে তারপর শিল্পবিপ্লব ঘটে। ফলে পরবর্তীকালে শিল্পপণ্য বিক্রির বাজার দখল করার উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়।
  • (২) কোনো দেশের শিল্প যাতে অন্য দেশের শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছু না হঠে সেজন্য বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের সরকার ‘শুল্ক সংরক্ষণ নীতি’ চালু করে। এর দ্বারা নিজের দেশের পণ্যের শুল্ক হ্রাস করে বিদেশি পণ্যের শুল্কহার খুবই বৃদ্ধি করা হত।
  • (৩) শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপের দেশগুলিতে বিরাট সম্পদ ও মূলধনের সৃষ্টি হয়। মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে এই সম্পদ কেন্দ্রীভূত হলে তারা পুঁজিপতি শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এভাবে ইউরোপে পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে।
  • (৪) পুঁজিবাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল আরও মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রসার ঘটানো। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের প্রসারে শিল্প ও পুঁজিবাদী মূলধনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

পণ্য বিক্রয়

  • (১) ঊনবিংশ শতকে ইউরোপে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। এর ফলে সেখানে শিল্পোৎপাদন অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। নিজ দেশের চাহিদা মেটানোর পরও বহু পণ্য উদবৃত্ত থেকে যায়। অত্যন্ত কম ব্যয়ে উৎপাদিত এসব উদবৃত্ত শিল্পপণ্য বহুগুণ বেশি দামে বিক্রির জন্য এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারে পাঠানো হয়।
  • (২) এসব অঞ্চলে নিজেদের বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় দেশগুলি সুকৌশলে এখানকার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে সেখানে নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। এভাবে উপনিবেশগুলি ইউরোপীয় শিল্পপণ্যের বিরাট বাজারে পরিণত হয়।

কাঁচামাল সংগ্রহ

  • (১) ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে পুঁজিপতিরা যে বিপুল পরিমাণ মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে তা তারা শিল্পোৎপাদনের কাজে বিনিয়োগ করে। এই শিল্পোৎপাদনের কাজ অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল কারখানাগুলিতে নিয়মিত তুলো, রেশম, রবার, উদ্ভিজ্জ তেল, বিভিন্ন খনিজ পদার্থ প্রভৃতি কাঁচামালের জোগান অব্যাহত রাখা।
  • (২) শিল্পনির্ভর ধনতন্ত্রবাদী ইউরোপের দেশগুলি সেই কাঁচামালের পর্যাপ্ত জোগান দিতে পারে নি। ফলে ধনতান্ত্রিক দেশগুলি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তোলে।

সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল – কাঁচামাল সংগ্রহ, উদবৃত্ত পুঁজি বিনিয়োগ এবং উদবৃত্ত পণ্যসামগ্রী বিক্রয়ের বাজার।

উপনিবেশ দখলের প্রয়োজনীয়তা

তবে কোনো অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন না করেও ব্যাবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে কাঁচামাল সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু পুঁজি বিনিয়োগ এবং পণ্য বিক্রির বাজার দখলের জন্য অবশ্যই উপনিবেশ দখলের প্রয়োজন ছিল।

পুঁজি বিনিয়োগ

  • (১) পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় পুঁজিপতি মালিকরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। এই মুনাফা অর্জনের কাজটি এককালীন নয়। এটি একটি ধারাবাহিক পুনরুৎপাদনমূলক প্রক্রিয়া। তাই ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পুঁজিপতিরা নিজেদের বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করে অতিরিক্ত মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
  • (২) এর ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল শীঘ্রই ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপনিবেশে পরিণত হয়। উপনিবেশগুলির বিভিন্ন স্থানে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি নিজেদের বাণিজ্য-কুঠি স্থাপন করে সেখানে তাদের বাণিজ্যিক কার্যাবলি পরিচালনা করতে থাকে।
  • (৩) আফ্রিকার বিভিন্ন স্থান থেকে উপনিবেশগুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস আমদানি করে উপনিবেশগুলি থেকে রপ্তানিযোগ্য পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের কাজ সচল রাখা হয়।

উপনিবেশের প্রসার

  • (১) পুঁজিবাদের চূড়ান্ত পরিণতি হল সাম্রাজ্যবাদ। শিল্প ও পুঁজিবাদী অর্থনীতি অনুসারে, উপনিবেশে একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার, শুল্ক সংরক্ষণ নীতির প্রবর্তন প্রভৃতির মাধ্যমে বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলি বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতে পারে।
  • (২) কোম্পানিগুলি বাণিজ্য থেকে যে মুনাফা অর্জন করবে তা সঞ্চয় না করে ঔপনিবেশিক অঞ্চলের প্রসার ও নতুন উপনিবেশ স্থাপনের কাজে ব্যয় করতে পারে। ফলে বিনিয়োগের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হবে, কাঁচামাল সংগ্রহে সুবিধা হবে এবং পণ্য বিক্রির বাজার প্রসারিত হবে। এর ফলে পুঁজিপতি বণিকদের মুনাফা অর্জনও বৃদ্ধি পাবে।
  • (৩) এই লক্ষ্য সামনে রেখেই পুঁজিপতিদের স্বার্থে জার্মান কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম উপনিবেশ দখল ও নৌশক্তি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন। তাই ফরাসি রাজনীতিবিদ গামবেত্তা বলেছেন যে, “কোনো রাষ্ট্রকে বৃহৎ হতে বা থাকতে গেলে তাকে অবশ্যই উপনিবেশের প্রসার ঘটাতে হবে।”

সমালোচনা

শিল্প ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন –

  • (১) শিল্প ও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদ মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে জমা হয়। বাকি মানুষ এই সম্পদশালী মানুষদের শোষণের শিকার হয়।
  • (২) শিল্প ও পুঁজিবাদী অর্থনীতি যে-কোনো উপনিবেশে নির্বিচার শোষণ চালিয়ে শোষণ করা অর্থ-সম্পদ নিজেদের দেশে পাচার করে মাতৃভূমির সমৃদ্ধি ঘটায়। শিল্পোৎপাদনের কাজে নিযুক্ত উপনিবেশের শ্রমিকরাও নানাভাবে শোষিত হয়।
  • (৩) শিল্প ও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত পরিণতি হল সাম্রাজ্যবাদ। এর ফলে আন্তর্জাতিক বিরোধ ও যুদ্ধ বাধে।
  • (৪) পুঁজিবাদী বণিক শ্রেণির উদ্যোগে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অংশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব স্থানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি উপনিবেশের অংশ হিসেবে নয়, বিদেশি শাসক হিসেবেই নিজেদের তুলে ধরে।
  • (৫) সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি উপনিবেশে নিজেদের বণিক ও শিল্পপতিদের সুবিধার্থে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে। উপনিবেশগুলির দেশীয় বণিকরা কোনো সুবিধা না পাওয়ায় তাদের ব্যাবসা প্রতিযোগিতায় পিছু হঠতে থাকে।
  • (৬) পুঁজিপতিদের উদ্যোগে উপনিবেশগুলিতে বিদেশি পণ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটলে উপনিবেশের স্বদেশীয় হস্ত ও কুটির শিল্প ধ্বংস হয়।

উপসংহার :- শিল্প বিপ্লবের ফলে এক শ্রেণীর বণিকদের হাতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ জমা হয়, তা শিল্প ও বাণিজ্যের নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে আরো বাড়তি মুনাফা লাভের চেষ্টা থেকেই উপনিবেশ স্থাপন ও তার প্রসার ঘটতে থাকে।

(FAQ) শিল্প ও পুঁজিবাদী মূলধন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. শিল্প মূলধন কাকে বলে?

শিল্প, কৃষি, নির্মাণ, পরিবহন প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুনাফা অর্জন করার লক্ষ্য নিয়ে যে পুঁজি নিয়োগ করা হয় তা সাধারণভাবে শিল্প মূলধন নামে পরিচিত।

২. শিল্প বিপ্লব প্রথম কোথায় সংঘটিত হয়?

ইংল্যান্ড।

৩. ইউরোপে কার নেতৃত্বে নতুন ধারার অর্থনৈতিক চিন্তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে?

অ্যাডাম স্মিথ।

Leave a Comment