কাল্পনিক সমাজতন্ত্র প্রসঙ্গে কল্পনাবিলাসী সমাজতন্ত্র, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, আদি যুগের সমাজতন্ত্রী হিসেবে রবার্ট আওয়েন, হেনরি সেন্ট সাইমন, চার্লস ফুরিয়ার, লুই ব্ল্যাঙ্ক, প্রুধোঁ, অন্যান্য সমাজতন্ত্রী, আদি সমাজতন্ত্রীদের ত্রুটি ও আদি সমাজতন্ত্রীদের প্রভাব সম্পর্কে জানবো।
আদি বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র
ঐতিহাসিক ঘটনা | কাল্পনিক সমাজতন্ত্র |
কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী | রবার্ট আওয়েন, সেন্ট সাইমন, চার্লস ফুরিয়ার |
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী | কার্ল মার্কস, ফ্রেডারিক এঙ্গেলস |
নিউ হারমনি | রবার্ট আওয়েন |
অর্গানাইজেশন অব লেবার | লুই ব্ল্যাঙ্ক |
ভূমিকা:- অষ্টাদশ শতকের শেষ ও উনিশ শতকের সূচনায় সমাজতান্ত্রিক ধারণা স্পষ্ট রূপ নিতে থাকে। সমাজতন্ত্রবাদ -এর প্রথমদিকের চিন্তাবিদরা কল্পনাবিলাসী সমাজতন্ত্রী এবং তাদের মতবাদ কাল্পনিক সমাজতন্ত্র নামে পরিচিত।
কল্পনাবিলাসী সমাজতন্ত্র
এইসব দার্শনিক শোষণের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কথা বললেও, সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য কোনও বাস্তব পথের সন্ধান দিতে পারেন নি। তাই কার্ল মার্কস ও তাঁর অনুগামীরা এইসব চিন্তাবিদকে ইউটোপিয়ান’ বা অবাস্তব বা স্বপ্নবিলাসী সমাজতন্ত্রী বলে আখ্যায়িত করেছেন।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র
কার্ল মার্কস ও তাঁর সহযোগী ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস যে, সমাজতন্ত্রের কথা প্রচার করেন, তা মার্কসবাদ বা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নামে পরিচিত।
আদি যুগের সমাজতন্ত্রীগণ
এই যুগে সমাজতন্ত্রের আদি উদগাতাদের মধ্যে রবার্ট আওয়েন, হেনরি সেন্ট সাইমন, চার্লস ফুরিয়ার, লুই ব্ল্যাঙ্ক, প্রুধোঁ প্রমুখ ছিলেন বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী রবার্ট আওয়েন
রবার্ট আওয়েন ব্রিটিশ সমাজতন্ত্রের জনক নামে পরিচিত। সমাজতন্ত্রবাদের ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল নিম্নরূপ। –
(১) শ্রমিক কল্যাণে দৃষ্টি আকর্ষন
তিনিই সর্বপ্রথম ‘সমাজতন্ত্রবাদ’ কথাটি প্রচলন করেন। নিজে একজন শিল্পপতি হয়েও তিনি শ্রমিক শ্রেণির সর্বাঙ্গীণ উন্নতির সমর্থক ছিলেন। তিনি শ্রমিক কল্যাণের দিকে দৃষ্টিপাত করেন।
(২) আদর্শ কারখানা প্রতিষ্ঠা
১৮০০ খ্রিস্টাব্দে নিউ ল্যানার্ক শহরে একটি আদর্শ কারখানা প্রতিষ্ঠা করে তিনি সকলকে দেখাতে চান যে, মালিকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না করেও শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়। এখানে তিনি শ্রমিকদের জন্য উন্নত পরিবেশ, ভালো বিদ্যালয়, সমবায় বিপণি এবং বৃদ্ধ বয়স বা অসুস্থ অবস্থায় পেনশনের ব্যবস্থা চালু করেন।
(৩) সমবায় বিপণি গঠন
শ্রমিক যাতে নিজেদের মজুরির পয়সায় ন্যায্য মূল্যে খাদ্য ও বস্ত্র পায় এজন্য তিনি বেশ কিছু স্বয়ংশাসিত সমবায় বিপণি গঠন করেন। শ্রমিকরাই এই বিপণিগুলি পরিচালনা করত।
(৪) তিনি মনে করতেন যে, উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে শ্রমিকরা তাদের যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারবে। তিনি মনে করেছিলেন যে, অন্যান্য শিল্পপতিগণও তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে, কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি।
(৫) নিউ হারমনি প্রতিষ্ঠা
হতাশ হয়ে তিনি আমেরিকায় চলে যান এবং ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে সেখানে ইন্ডিয়ানা রাজ্যে ‘নিউ হারমনি’ নামে একটি সমাজতান্ত্রিক ও সমবায় অর্থনীতিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এখানেও ব্যর্থ হয়ে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান। তিনি সমকালীন ট্রেড ইউনিয়ন ও সমবায় আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।
(৬) রচিত গ্ৰন্থ
তাঁর রচিত ‘নিউ ভিউ অব সোসাইটি’ এবং ‘রিপোর্ট টু দ্য কাউন্টি অব ল্যানার্ক’ নামক গ্রন্থ দুটি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে নতুন পথের সন্ধান দেয়। তিনি ছিলেন স্বপ্নবিলাসী, বাস্তববাদী নন। ডেভিড টমসন বলেন যে, “Owen became a dreamer of dreams” ।
কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী সেন্ট সাইমন
হেনরি সেন্ট সাইমন ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রবাদের আদি গুরু হিসেবে পরিচিত। তাঁকে ‘ফরাসি সমাজতন্ত্রের জনক’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। ‘নব খ্রিস্টবাদ’ গ্রন্থে তাঁর মতবাদ বিবৃত হয়েছে।
(১) নব খ্রিস্টবাদ
তিনি মনে করতেন যে, প্রচলিত খ্রিস্টধর্ম সামাজিক অসাম্য ও শোষণ রদ করতে অক্ষম। এই কারণে তিনি ‘নব খ্রিস্টবাদ’-এর কথা বলেন। তাঁর মতে, ধন-বণ্টনের অসাম্যের জন্যই সমাজ ধনী ও দরিদ্র – দুই শ্রেণিতে বিভক্ত হয়েছে। ধনীরা দরিদ্রদের শোষণ করে, তাই সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন বাতিল হওয়া উচিত।
(২) শিক্ষা ও নীতিবোধের বিস্তার
তিনি মনে করতেন যে, শিক্ষা ও নীতিবোধের বিস্তার হলেই শিক্ষিত শ্রেণি দরিদ্রদের উন্নতির জন্য চেষ্টা করবে। তিনি মার্কসের মতো শ্রেণিসংগ্রামের কথা ভাবেন নি। তিনি শ্রমিক-মালিক সহযোগিতা ও সমবায়ের ভিত্তিতে শিল্প-রাষ্ট্র গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন।
(৩) ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ
তিনিই সর্বপ্রথম এই মতবাদ প্রচার করেন যে, প্রত্যেক মানুষ তার ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করবে এবং রাষ্ট্র তার প্রয়োজন মেটাবে।
(৪) সম্পত্তির উত্তরাধিকার লোপ
তিনি সম্পত্তির উত্তরাধিকার লোপের কথা বলেন, নতুবা কিছু মানুষ বিনা পরিশ্রমে পৈত্রিক সম্পত্তি ভোগ করে আরামে জীবন কাটাবে, আর উত্তরাধিকারহীন ব্যক্তিরা বঞ্চিত হবে।
(৫) সামাজিক মালিকানা
তিনি উৎপাদন ব্যবস্থার উপর ব্যক্তি মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতবাদের মূল কথা হল অর্থনৈতিক সাম্যের উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগত স্বার্থশূন্য ও প্রতিযোগিতাহীন একটি সমাজ গঠন করা।
কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী চার্লস ফুরিয়ার
চার্লস ফুরিয়ার ছিলেন সেন্ট সাইমনের মন্ত্রশিষ্য। সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে তার মতবাদ হল নিম্নরূপ। –
(১) কমিউন গঠন
তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজির ঘোরতর বিরোধী ছিলেন এবং এর অবসানের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তিনি এমন এক সমাজের কল্পনা করেন যার ভিত্তি ছিল ‘ফ্যালাঞ্জ’ বা ‘কমিউন’। ১৫০০ থেকে ২০০০ নারী-পুরুষ নিয়ে এক একটি কমিউন গড়ে উঠবে।
(২) সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ
প্রত্যেকে সেখানে নিজ নিজ সামর্থ্য ও রুচি অনুযায়ী কাজ করে খাদ্য-বস্ত্র উৎপাদন করবে এবং নিজেরাই তা ভাগ করে নেবে। এখানে মজুরি, মুনাফা ও প্রতিযোগিতা বলে কিছু থাকবে না।
(৩) সুখি ও সমৃদ্ধশালী মানুষ
রাষ্ট্রীয় দমনমূলক প্রতিষ্ঠান পুলিশ, কারাগার সবই বিলুপ্ত হবে। এখানে সব মানুষই হবে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী। তাঁর মতবাদ ইউরোপ ও আমেরিকায় বেশ জনপ্রিয় হয় এবং তাঁর অনুগামীরা বেশ কয়েকটি ‘ফ্যালাঞ্জ’ গড়ে তোলেন।
কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী লুই ব্ল্যাঙ্ক
ধনতন্ত্রবাদের কঠোর সমালোচক বিশিষ্ট ফরাসি সমাজতন্ত্রী লুই ব্ল্যাঙ্ক যথেষ্ট বাস্তববাদী ছিলেন। তাঁকে কল্পনাবিলাসী সমাজতন্ত্রী ও আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সমাজতন্ত্রের জনক কার্ল মার্কসের মধ্যে যোগসূত্র বলা যেতে পারে।
(১) গ্ৰন্থ রচনা
তাঁর রচিত রিভ্যু দ্যু প্রোগ্রেস’ ও ‘অরগানিজেশন অব লেবার’ গ্রন্থে তাঁর সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ফুটে উঠেছে। ‘অরগানিজেশন অব লেবার’ ছিল তৎকালীন সমাজে একটি বহু আলোচিত গ্রন্থ। সমাজতান্ত্রিক ও শ্রমিকদের কাছে এই গ্রন্থ ছিল বাইবেল-স্বরূপ।
(২) ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ ও পারিশ্রমিক
তিনি শ্রমিকদের কর্মের অধিকারে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, প্রত্যেক শ্রমিক নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করবে এবং নিজ প্রয়োজন মতো পারিশ্রমিক পাবে।
(৩) শ্রমিকদের ভোটাধিকার দাবি
তিনি শ্রমিকদের ভোটাধিকার দাবি করেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শ্রমিকরা ভোটাধিকার পেলে তবেই রাষ্ট্র শ্রমিক কল্যাণমূলক আইন পাস করবে।
(৪) তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিল্প স্থাপনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, ব্যক্তিগত উদ্যোগের অর্থই হল মুনাফা লাভের জন্য দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা, শ্রমিক শোষণ এবং শ্রমিক ছাঁটাই। তিনি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কলকারখানা স্থাপনের পক্ষপাতী ছিলেন।
(৫) বাস্তবসম্মত মতাদর্শ
তাঁর প্রচারিত সমাজতন্ত্রকে ‘রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র’ বলা হয়। বিপ্লব-পরবর্তী ফ্রান্সে সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘জাতীয় কর্মশালা’ প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর চিন্তাধারায় নানা অসঙ্গতি থাকলেও তাঁর মতাদর্শের মধ্যেই সমাজতন্ত্রের পরিণত রূপ লক্ষ করা যায় এবং তা ছিল অনেক বাস্তবসম্মত।
কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী প্রুধোঁ
- (১) পিয়ারে জোসেফ প্রুধোঁ সাধারণভাবে “নৈরাজ্যবাদের জনক’ হিসেবে পরিচিত। তিনি ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে একেবারে ভেঙে ফেলতে চাইতেন বলে তাঁকে ‘নৈরাজ্যবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাঁর মতে ‘সম্পত্তি মানেই চুরি’।
- (২) তিনি সেন্ট সাইমন ও চার্লস ফুরিয়ারের চিন্তাধারার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তিনি রাষ্ট্র, গির্জা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজিবাদের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন সমাজ গঠনের তত্ত্ব প্রচার করেন। তাঁর কল্পিত নতুন সমাজে রাষ্ট্র বা গির্জার কোনও ভূমিকা থাকবে না। পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে এই নতুন সমাজ গড়ে উঠবে।
অন্যান্য সমাজতন্ত্রী
এইসব বিশিষ্ট সমাজতন্ত্রী ছাড়াও ফ্রান্স, জার্মানি ও ইংল্যান্ড -এ আরও কয়েকজন সমাজতন্ত্রী চিন্তাবিদের আবির্ভাব হয়। ফরাসি সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ব্রিসো, জ্যাক রেনে হিবার্ট ও বাব্যুফ। জার্মানিতে ছিলেন ফার্দিনান্দ লাসাল, উইলিয়ম লাইবনেখট্ ও আগস্ট বেবেল। লাসাল রাষ্ট্রের সহায়তায় বৃহদায়তন শিল্পে শ্রমিকদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ইংরেজ সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন চার্লস হল, টমাস হজকিন, উইলিয়ম মসন, জন গ্রে প্রমুখ।
আদি সমাজতন্ত্রীদের ত্রুটি
আদি সমাজতন্ত্রীদের মতাদর্শ নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। যেমন –
(১) কল্পনাপ্রবণ
তাঁরা ছিলেন অবাস্তব আদর্শবাদী ও কল্পনাপ্রবণ। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগ ছিল না। আর্থ-সামাজিক পরিবেশ ও মানুষের চরিত্রকে তাঁরা সঠিকভাব বিশ্লেষণ করতে পারেন নি। তারা পুঁজিবাদী সমাজ থেকে সমাজবাদে উত্তরণের পথ নির্দিষ্ট করতে পারেন নি।
(২) ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ববাদ তত্ত্ব অজানা
তাঁরা ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ববাদ তত্ত্ব জানতেন না। শ্রমিককে শোষণ করেই যে মালিক শ্রেণি স্ফীত হয় – এই তত্ত্ব তাঁরা স্বীকার করেন নি। শিল্পে শ্রমিকের স্বার্থই আসল, মালিকের কোনও নায্য দাবি নেই – এই তত্ত্বও তাঁরা জানতেন না। এই কারণেই তাঁরা শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক স্থাপনের কথা বলেছেন – শ্রেণিসংগ্রাম বা রক্তাক্ত বিপ্লবের কথা চিন্তা করতে পারেন নি।
(৩) শিক্ষা বিস্তার ও নৈতিক মূল্যবোধ
তারা মনে করতেন যে, শিক্ষাবিস্তার ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত হলেই মালিকপক্ষ শ্রমিক শোষণ বন্ধ করবে। তাই পুঁজিপতিদের সঙ্গে সংঘর্ষ নয়, সহযোগিতার মাধ্যমেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই কার্ল মার্কস এঁদের ‘অবাস্তব, স্বপ্নবিলাসী সমাজতন্ত্রী’ বলে অভিহিত করেছেন। লেনিন এই সমাজতন্ত্রকে ব্যঙ্গ করে বলেছেন ‘সমবায়ী সমাজবাদী’।
(৪) সমাজের উপরতলা থেকে পরিবর্তন
আদি সমাজতন্ত্রীরা মনে করতেন যে, সমাজের উপরতলা থেকে পরিবর্তন আসবে। তাই তাঁদের আবেদন ছিল মালিকপক্ষ ও রাষ্ট্রের কাছে। তাঁরা শ্রমিক, কৃষক বা সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কোনও চেষ্টা করেন নি। বলা বাহুল্য, তাঁদের এই প্রয়াস ব্যর্থ হয়।
(৫) উৎপাদনের মুনাফা শ্রমিকের প্রাপ্য
মার্কস যে মূল্যতত্ত্ব আলোচনা করেছেন তাতে উৎপাদনের ব্যাপারে মালিকের কোনও ভূমিকা নেই। শ্রমিকের শ্রম দ্বারাই উৎপাদন হয়। সুতরাং মার্কসের মতে উৎপাদনের যে মুনাফা হয়, তা শ্রমিকেরই প্রাপ্য।
(৬) শ্রমিক কল্যাণমূলক আইন
শ্রমিকের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে গেলে রাষ্ট্রকে আইন দ্বারা মুনাফা নিয়ন্ত্রণ ও শ্রমিক কল্যাণমূলক আইন করতে হবে। আদি সমাজতান্ত্রিকরা তা চিন্তা করেন নি। উৎপাদন ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনলে যে শ্রমিকের উপর শোষণ কমবে তা তাঁরা চিন্তা করেন নি।
আদি সমাজতন্ত্রীদের প্রভাব
এই কথা সত্য যে, আদি সমাজতন্ত্রীরা সমাজব্যবস্থায় কোনও পরিবর্তন আনতে পারেন নি। এই আপাত ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাদের প্রভাব ও গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। অধ্যাপক ডেভিড টমসন বলেন যে, সমকালীন শ্রমিক আন্দোলনের উপর তাঁদের গভীর প্রভাব ছিল। যেমন –
(১) মার্কসবাদের বহু উপাদান বর্তমান
মার্কসবাদের বহু উপাদান এঁদের চিন্তাধারার মধ্যে নিহিত ছিল। শিল্পোন্নত সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব, শোষণ, শ্রমিক শ্রেণির দারিদ্র্য প্রভৃতির কথা তাঁরা বলেছিলেন। তাঁরা গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের কথাও বলেন।
(২) সকলকে সচেতন করা
তাঁরাই প্রথম বৃহদায়তন শিল্প ও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি সর্বসমক্ষে তুলে ধরে জনসাধারণকে এ সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন এবং এর ফলে ধনতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাঁরাই প্রথম অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত জাতির উপযোগিতা সম্পর্কে সকলকে সচেতন করে তোলেন।
(৩) স্বাতন্ত্র্যবাদ বাধাপ্রাপ্ত
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে অ্যাডাম স্মিথ ও অন্যান্য চিন্তাবিদদের প্রচারিত ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ’ বা হস্তক্ষেপ না করার নীতির বিরুদ্ধে আদি সমাজতন্ত্রীরা একটি নতুন মতবাদ তুলে ধরেন। এর ফলে স্বাতন্ত্র্যবাদ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
(৪) শ্রমিকদের আন্দোলন
আদি সমাজতন্ত্রীদের প্রভাবে ইংল্যান্ডে ‘চার্টিস্ট আন্দোলন’ (১৮৪৮ খ্রিঃ) শুরু হয় এবং শ্রমিক শ্রেণি ভোটাধিকারের দাবিতে পথে নামে। ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লব ও ফেব্রুয়ারি বিপ্লব -এর উপরেও তাদের গভীর প্রভাব ছিল।
উপসংহার:- রুশ বিপ্লব -এর নায়ক লেনিন বলেন যে, “কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীগণ এমন অনেক কিছু ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, যেগুলির সত্যতা আমরা বর্তমানে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ পেয়েছি।”
(FAQ) কাল্পনিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
রবার্ট আওয়েন, সেন্ট সাইমন, চার্লস ফুরিয়ার, প্রুধোঁ, লুই ব্ল্যাঙ্ক প্রমুখ।
রবার্ট আওয়েন।
লুই ব্ল্যাঙ্ক।
রবার্ট আওয়েন।
রবার্ট আওয়েন।