হিপোক্রেটস

প্রাচীন গ্ৰিসের চিকিৎসক হিপোক্রেটস প্রসঙ্গে তার জন্ম, বংশ পরিচয়, শিক্ষা, গুরুর জ্ঞান আয়ত্ত, সঠিক চিকিৎসা প্রণালী, পরিস্কার জল ও ব্যান্ডেজ ব্যবহারের নির্দেশ, হিপোক্রেটসের রচনা, হিপোক্রেটসের শপথ ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।

প্রাচীন গ্ৰিসের চিকিৎসক হিপোক্রেটস

ঐতিহাসিক চরিত্রহিপোক্রেটস
জন্ম৪৬০ খ্রিস্ট পূর্ব
দেশগ্ৰিস
পরিচিতিচিকিৎসক
মৃত্যু৩৭০ খ্রিস্ট পূর্ব
প্রাচীন গ্ৰিসের চিকিৎসক হিপোক্রেটস

ভূমিকা :- মানব সভ্যতার ইতিহাসে গ্রীকদের দান অতুলনীয়। দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান সর্বক্ষেত্রেই পৃথিবীর মানুষ তাদের কাছে ঋণী। দর্শনে সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল মানুষের চিন্তা মনীষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। এ্যাসকাইলাস, সফোক্লিস, ইউরিপিদিস বিশ্বের নাট্য সাহিত্য ভাণ্ডারকে পূর্ণ করেছেন তাদের অবিস্মরণীয় সব নাটকে। বিজ্ঞানের জগৎকে আলোকিত করেছেন হিপোক্রেটস, ইউক্লিড, আর্কিমিডিস, পিথাগোরাস। মানুষের মনের অন্ধকারের বুকে এঁরা জ্ঞানের আলো জ্বেলেছিলেন। এই সব মহান মানুষের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিপোক্রেটস। তাঁকে বলা হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক।

হিপোক্রেটসের সময় চিকিৎসা বিজ্ঞান

যে সময় তাঁর জন্ম সেই সময় চিকিৎসা বিজ্ঞান ছিল কুহেলিকায় ঢাকা। শুধুই কুসংস্কার আর বিচিত্র সব তন্ত্রমন্ত্রের মধ্যেই চিকিৎসকদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ ছিল।

প্রাচীন গ্ৰিস দেশের চিকিৎসা

  • (১) প্রাচীন গ্রীস দেশে চিকিৎসার দেবতা ছিলেন অ্যাপেলো। তার হাতে থাকত দণ্ড। একে বলা হয় হার্মিসের দণ্ড। এই দণ্ড চিকিৎসাবিদ্যার প্রতীক। গ্রীসের বিভিন্ন স্থানে এই অ্যাপেলোর মন্দির ছিল। লোকে অসুস্থ হলে এই মন্দিরে গিয়ে পূজা দিত, শূকর, ভেড়া উৎসর্গ করত।
  • (২) মন্দিরের পুরোহিতরাই প্রধানত ছিল চিকিৎসক। তারা খুশিমত চিকিৎসার নানান বিধান দিত। লোকে ভাবত দেবতার ক্রোধে মানুষ অসুস্থ হয়। পুরোহিতরা দেবতার প্রতিনিধি, তারা ইচ্ছা করলে সেই রোগ সুস্থ করে তুলতে পারে।
  • (৩) এইভাবে এক শ্রেণীর পুরোহিত সম্প্রদায় গড়ে উঠল, চিকিৎসাই হল তাদের প্রধান পেশা। কালক্রমে বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চিকিৎসার সম্বন্ধে তারা কিছু জ্ঞান অর্জন করল। যে যেটুকু জ্ঞান অর্জন করত তাকে অ্যাপেলো প্রদত্ত মনে করে গোপন করে রাখত।

গুপ্তবিদ্যা

তখন চিকিৎসাবিদ্যাকে বলা হত গুপ্ত বিদ্যা। এই বিদ্যা শুধুমাত্র পিতা তার সন্তানকে দিত। হিপোক্রেটস ছিলেন এমনি এক চিকিৎসকের পুত্র।

হিপোক্রেটসের উপর প্রভাব

তিনি যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রায় একই সময়ে গ্রীসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সক্রেটিস, এসকাইলাস, কিছু পরে সোফোক্লিস প্লেটোর মত মহান দার্শনিক নাট্যকাররা। তাদের মুক্ত স্বাধীন চিন্তা হয়ত হিপোক্রেটসকে প্রভাবিত করেছিল।

হিপোক্রেটসের জন্ম

অ্যাপিয়ান সাগরের “কস” দ্বীপে হিপোক্রেটসের জন্ম।

হিপোক্রেটসের বংশ পরিচয়

তাঁর জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কোন তথ্য উদ্ধার করা যায় না। সামান্য যেটুকু তথ্য পরবর্তীকালে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তার ভিত্তিতে জানা যায় হিপোক্রেটসের বাবা ছিলেন কসের অ্যাপোলো মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। সেই সূত্রে সমাজে ছিল যেমন প্রভাব তেমনি প্রতিপত্তি। সুখ-স্বচ্ছন্দ্যের মধ্যেই প্রতিপালিত হয়েছিলেন তিনি।

হিপোক্রেটসের শিক্ষা

  • (১) শিক্ষার সূত্রপাত হয় তাঁর পিতার কাছে। পিতার কাছ থেকে যাবতীয় গুপ্তবিদ্যা তিনি অর্জন করেছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই হিপোক্রেটস ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। সেই সময় একমাত্র এথেন্সে চিকিৎসাশাস্ত্র সংক্রান্ত কিছু পড়াশুনা হত।
  • (২) হিপোক্রেটস পিতার কাছ থেকে সব কিছু শিক্ষা লাভ করবার পর এথেন্সে গেলেন চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করতে। সেখানে তার শিক্ষক ছিলেন ডিমোক্রিটাস। তিনি ছিলেন সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি।
  • (৩) বিজ্ঞান, গণিত, দর্শন তিনটি বিষয়েই ডিমোক্রিটাসের ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্য। এছাড়াও এথেন্সের আরো কয়েকজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতের কাছে হিপোক্রেটস শিক্ষা লাভ করেন।

এথেন্সের লাইসিয়াম

  • (১) সেই যুগে এথেন্স ছিল শিক্ষা-সংস্কৃতির পীঠস্থান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে বলা হত লাইসিয়াম, যার অর্থ জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। এক একটি লাইসিয়াম এক এক জন প্রখ্যাত শিক্ষকের অধীনে গড়ে উঠত।
  • (২) প্রত্যেকে নিজের অধিগত বিদ্যা ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা জ্ঞানের সামান্য অংশই ছাত্রদের দিতেন। নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের বেশির ভাগ অংশই প্রকাশ করতেন না।

হিপোক্রেটসের চোখে চিকিৎসার অবৈজ্ঞানিক দিক প্রকট

চিকিৎসকের পুত্র হলেও হিপোক্রেটস নিজের গভীর জ্ঞান, বাস্তব যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, সে যুগের চিকিৎসা ব্যবস্থার ভ্রান্তি আর দোষত্রুটি। তাঁর অবৈজ্ঞানিক দিকগুলি তাঁর চোখে প্রকট হয়ে উঠেছিল।

হিপোক্রেটস কর্তৃক গুরুর জ্ঞান আয়ত্ত

তিনি ঠিক করলেন বিভিন্ন চিকিৎসকদের কাছ থেকে তাঁদের জ্ঞানকে অর্জন করতে হবে। কিন্তু কাজটি সহজ ছিল না। কারণ বেশির ভাগ চিকিৎসকই ছিলেন অহংকারী দাম্ভিক। হিপোক্রেটস তাঁদের অনুগত শিষ্য হয়ে নানান স্তুতি প্রশংসায় তাদের মন জয় করে নিতেন। তারপর নিজের অসাধারণ প্রতিভায় অল্পদিনের মধ্যেই গুরুর সব জ্ঞান আয়ত্ত করে নিতেন।

হিপোক্রেটসের মতে সঠিক চিকিৎসা প্রণালী

  • (১) তিনি তার চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত করলেন। শুরু হল রুগীর চিকিৎসা। এতদিনকার প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে এ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তখন শুধুমাত্র রোগীর রোগের উপসর্গ দেখে চিকিৎসকরা বিধান দিত। অন্য কিছু জিজ্ঞাসা বা বিচার করবার প্রয়োজন মনে করত না।
  • (২) কিন্তু হিপোক্রেটস বললেন, একজন প্রকৃত চিকিৎসকের উচিত রোগ নয়, রুগীর চিকিৎসা করা। একটি উপসর্গ বা রোগ লক্ষণের উপর নির্ভর করে রোগ নির্ণয় করা উচিত নয়। একজন চিকিৎসকের রোগীর যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন।
  • (৩) যেমন রোগীর প্রতিদিনকার জীবনযাত্রা, তাঁর পিতা-মাতা বা অন্যদের রোগের ইতিহাস, তাঁর কাজকর্ম, কোন পরিবেশে সে বাস করে। এই সব তথ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই রোগীর সঠিক চিকিৎসা প্রণালী নির্ধারণ করতে হবে।

হিপোক্রেটস কর্তৃক পরিষ্কার জল ব্যান্ডেজ ব্যবহারের নির্দেশ

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হিপোক্রিটাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান হল বিভিন্ন ধরনের ঘা, ফোঁড়া, কাটা, পচনের কারণ ও প্রতিকার নির্ণয়। এই বিষয় নিয়ে তিনি গভীরভাবে অনুশীলন করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন অপরিচ্ছন্নতা ও দূষিত দ্রব্য ব্যবহারই এই সব রোগের বৃদ্ধি ঘটায়। তাই তিনি পরিষ্কার জল, ব্যান্ডেজ, ঔষধ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন।

মৃগীরোগ সম্পর্কেহিপোক্রেটসের মত

  • (১) মৃগীরোগ সম্বন্ধে শুধু সেই যুগে নয়, বর্তমান কালেও বহু মানুষের ধারণা কোনো অপদেবতা কিম্বা শয়তান যখন মানুষের উপর ভর করে তখন মৃগীরোগ হয়।
  • (২) কিন্তু সেই যুগে হিপোক্রেপটস তাঁর অন দি স্যারেড ডিসিস গ্রন্থে লিখেছেন আর দশটি ব্যাধির মতই মৃগী একটি ব্যাধি এবং সুনির্দিষ্ট কারণেই এই ব্যাধির সৃষ্টি হয়।
  • (৩) সেই যুগের প্রচলিত সংস্কারের উর্ধ্বে উঠে হিপোক্রেটস তাঁর শিষ্যদের কাছে নিজের জ্ঞানকে উজাড় করে দিতেন যাতে তারা চিকিৎসার আলোকে ছড়িয়ে দিতে পারে বৃহত্তর মানব সমাজের কাছে।

প্লেটোর সাথে হিপোক্রেটসের পরিচয়

মহান দার্শনিক প্লেটোর সাথে হিপোক্রেটসের পরিচয় ছিল। তিনি হিপোক্রেটসকে বলছেন চিকিৎসাবিদ্যার এক মহান গুরু আদর্শ শিক্ষক।

হিপোক্রেটসের রচনা

  • (১) হিপোক্রেটস তাঁর জীবনব্যাপী গবেষণা, পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতার আলোয় যে জ্ঞান লাভ করেছিলেন, তাঁকে তিনি বিভিন্ন রচনায় লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। এই সব রচনার সংগ্রহ ছিল প্রায় সাতাশিটি খণ্ডে।
  • (২) এক একটি খণ্ডে এক একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার একটি সংগ্রহশালা থেকে এই সব রচনার কিছু কিছু অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল।
  • (৩) এই সব রচনা থেকে জানা যায় হিপোক্রেটস শুধু রোগ বা রোগীদের সম্বন্ধেই আলোচনা করেননি, তিনি চিকিৎসকদের প্রতিও বহু নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন এবং এই নির্দেশগুলি সর্বকালেই প্রযোজ্য।

চিকিৎসকদের প্রতি হিপোক্রেটসের পরামর্শ

তিনি বলেছেন যে চিকিৎসক রোগীর প্রাসঙ্গিক সর্ব বিষয়ে খোঁজ না নিয়ে শুধুমাত্র রোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি কখনোই মহৎ চিকিৎসক হতে পারেন না। তিনি বলতেন জীবন ছোট কিন্তু বিদ্যা বিরাট। সকল বিদ্যার মধ্যে চিকিৎসাবিদ্যাই শ্রেষ্ঠ। শুধু মাত্র কিছু অজ্ঞ চিকিৎসকের জন্যই এই বিদ্যা অন্য সব বিদ্যার পেছনে পড়ে রয়েছে।

হিপোক্রেটিস শপথ

  • (১) যাতে চিকিৎসকরা তাদের সুমহান আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হন সেই কারণে তিনি তাঁর ছাত্রদের বিদ্যা শিক্ষা শেষ হলে শপথ করাতেন। একে বলা হয় “হিপোক্রেটিস শপথ”।
  • (২) প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে পৃথিবীর সর্ব দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্ররা আজও এই শপথ নিয়ে থাকেন। ‘আমি আমার জীবন ও এই পেশাকে পবিত্র, সুন্দর, নির্মল করে রাখব।’
  • (৩) হিপোক্রেটিসের নামাঙ্কিত এই শপথবাক্য আজও সর্বদেশে চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষানবীশ হওয়ার পূর্বে উচ্চারণ করতে হয়। এই থেকেই হিপোক্রেটিস ও তাঁর অনুগামী চিকিৎসকদের সেবার আদর্শ ও সুমহানত্ব-র পরিচয় পাওয়া যায়।
  • (৪) যিনি আমাকে এই ব্যাখ্যাদান করছেন তাঁকে আমার নিজ পিতামাতা জ্ঞান করব। তাঁর সন্তান-সন্ততিরা এই বিদ্যালাভে অভিলাষী হলে বিনাব্যয়ে শিক্ষাদান করব। আমি যে পথ্যাপথ্যের নির্দেশ দেব তা আমার যোগ্যতা ও বিচারবুদ্ধি অনুসারে রোগীর উপকারার্থে নির্ধারিত হবে।
  • (৫) আমার কাছে চাইলেই কোনও ব্যক্তিকে কোনো মারাত্মক ও ক্ষতিকারক ওষুধের পরামর্শ দেব না। রোগীর এবং তাদের পরিবারের সকল তথ্য সাধারণের কাছে গোপন রাখব। আমার জীবন ও শাস্ত্রকে আমি বিশুদ্ধ এবং পবিত্র রাখব।
  • (৬) এই শপথ যথাযথ পালন করে সকল লোকের প্রশংসার পাত্র হয়ে আমি যেন আমার জীবন ও শাস্ত্র সমভাবে উপভোগ করতে পারি। শপথভ্রষ্ট হলে আমার ভাগ্যে যেন বিপরীত ঘটে।

উপসংহার :- যুগে যুগে এই আদর্শ চিকিৎসককে ন্যায়, সত্য ও সেবার পথে অবিচলিত রেখেছে। এই মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানী সমস্ত অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের অন্ধকারকে দূর করে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যুক্তিনিষ্ঠ তত্ত্ব আর তথ্যের ভিত্তিতে। তাই তিনি শুধু সে যুগে নন, সর্ব যুগে চিকিৎসকদের মধ্যে অগ্রগণ্য।

(FAQ) প্রাচীন গ্ৰিসের চিকিৎসক হিপোক্রেটস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. হিপোক্রেটস কে ছিলেন?

প্রাচীন গ্ৰিসের বিখ্যাত চিকিৎসক।

২. সর্ব যুগে চিকিৎসকদের অগ্রগণ্য কাকে বলা হয়?

হিপোক্রেটস।

৩. চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক কাকে বলা হয়?

হিপোক্রেটস।

Leave a Comment