প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের কার্যাবলী প্রসঙ্গে বিরোধের মীমাংসা, আন্তর্জাতিক চুক্তি হিসেবে জেনেভা প্রোটোকল, লোকার্নো চুক্তি, কেলগ-ব্রিয়াঁ চুক্তি, অন্যান্য কার্যাবলী, ব্যর্থতা, বিলুপ্তি, ব্যর্থতার কারণ ও জাতিসংঘের কৃতিত্ব সম্পর্কে জানবো।
১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের কার্যাবলী
ঐতিহাসিক ঘটনা | জাতিসংঘের কার্যাবলী |
ঘটনা | জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা |
প্রতিষ্ঠা দিবস | ২৮ এপ্রিল, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ |
প্রথম অধিবেশন | ১০ জানুয়ারি, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ |
জনক | উড্রো উইলসন |
প্রেক্ষাপট | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ |
ভূমিকা :- জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার এক দশকের মধ্যে তার মর্যাদা সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়। এই সময়কালকে লিগের ইতিহাসে ‘সুবর্ণ যুগ’ বলে চিহ্নিত করা হয়। জাতিসঙ্ঘের প্রধান কাজ ছিল পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান।
জাতিসংঘের কার্যাবলী
সর্বক্ষেত্রে প্রশংসনীয় সাফল্য না পেলেও দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে (১৯১৯-১৯৩৯ খ্রিঃ) আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যাপারে লিগ যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। যেমন –
(১) জাতিসংঘের মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা
আল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের বিরোধ, সাইলেশিয়া নিয়ে জার্মানি ও পোল্যান্ড -এর বিরোধ এবং ইঙ্গ-মিশর, ইঙ্গ-চীন, তুরস্ক-ইরাক, গ্রিস-বুলগেরিয়া, ইতালি-গ্রিস, পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়া বিবাদে লিগ যথেষ্ট প্রশংসনীয় ভূমিকা গ্রহণ করে।
(২) জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চুক্তি স্থাপন
আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষার ব্যাপারে লিগ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পাদন করে। যেমন –
(ক) জাতিসংঘের মাধ্যমে জেনেভা প্রোটোকল
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে জেনেভা প্রোটোকল রচিত হয়। জাতিসঙ্ঘ যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়, কিন্তু ইংল্যান্ড -এর বিরোধিতায় তা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয় নি।
(খ) জাতিসংঘের মাধ্যমে লোকার্নো চুক্তি
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে লিগের উদ্যোগে লোকার্নো চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির সঙ্গে ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের সীমানা নির্ধারিত হয়, জার্মানি-সংলগ্ন রাষ্ট্র ফ্রান্স, বেলজিয়াম, চেকোশ্লোভাকিয়া ও পোল্যান্ডের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয় এবং ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি জাতিসঙ্ঘে যোগদান করে।
(গ) জাতিসংঘের মাধ্যমে কেলগ-ব্রিয়াঁ চুক্তি
- (১) ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে ৬২টি দেশ কেলগ-ব্রিয়াঁ চুক্তি স্বাক্ষর করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্তর্জাতিক বিবাদ-বিসংবাদ মেটাবার প্রতিশ্রুতি দেয়।
- (২) বিভিন্ন সদস্য-রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষা করা, একটি স্থায়ী দাসত্ব কমিশন, স্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবী সমবায় সংস্থা, বিশ্ব অর্থনীতি সম্মেলন গঠন এবং ম্যানডেটের অধীনস্থ স্থানগুলির তত্ত্বাবধান, ডানজিগ ও সার অঞ্চলের শাসন পরিচালনা, নিরস্ত্রীকরণ এবং যৌথ-নিরাপত্তা ব্যবস্থার পক্ষে লিগ কার্যকরী ও প্রশংসনীয় ভূমিকা গ্রহণ করে।
জাতিসংঘ সম্পর্কে হালের মন্তব্য
করডেল হাল বলেন যে, “মানবিক ও বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের জন্য জাতিসঙ্ঘ ইতিহাসের যে কোনও সংস্থা অপেক্ষা অধিকতর দায়িত্বশীল ছিল।”
জাতিসংঘের ব্যর্থতা
উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলিতে সাফল্য অর্জন করলেও বহুক্ষেত্রে লিগ চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। যেমন –
- (১) ভিলনা শহরকে কেন্দ্র করে পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়া (১৯২২ খ্রিঃ) এবং গ্রিসের করফু দ্বীপকে কেন্দ্র করে গ্রিস ও ইতালির (১৯২৩ খ্রিঃ) বিরোধের মীমাংসা করা জাতিসঙ্ঘের পক্ষে সম্ভব হয় নি।
- (২) জাপান কর্তৃক চিনের মাঞ্চুরিয়া দখল (১৯৩১ খ্রিঃ), ইতালি কর্তৃক আবিসিনিয়া অধিকার (১৯৩৫-১৯৩৬ খ্রিঃ), নিরস্ত্রীকরণ সমস্যার সমাধান, জার্মানি কর্তৃক ক্রমাগত ভার্সাই সন্ধি লঙ্ঘন প্রভৃতি ক্ষেত্রে লিগ কোনও কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয় নি।
শান্তি প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘের বিলুপ্তি
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কার্যত লিঙ্গের বিলুপ্তি ঘটে।
জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণ
এই জাতিসঙ্ঘের ব্যর্থতার মূলে নানা কারণ বিদ্যমান ছিল। যেমন ধারণার অভাব, ভার্সাই চুক্তির অংশ, বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির অনুপস্থিতি, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের প্রাধান্য, আন্তরিকতা ও ঐক্যের অভাব, সাংগঠনিক দুর্বলতা, সামরিক শক্তির অভাব, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি।
জাতিসংঘের কৃতিত্ব
লিগ তার উদ্দেশ্যপূরণে ব্যর্থ হলেও তার কৃতিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। যেমন –
- (১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত ও রণক্লান্ত পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক বিবাদ-বিসম্বাদের মীমাংসা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় লিগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। সর্বক্ষেত্রে সফল না হলেও তার ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না।
- (২) বিশ্বের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক উন্নয়নেও লিগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। জনস্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শ্রমিকদের কল্যাণসাধন, দাসপ্রথার উচ্ছেদ, দরিদ্র জনসাধারণের আর্থিক উন্নয়ন, শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়ন প্রভৃতি কাজে লিগের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
উপসংহার :- সবশেষে বলা যায় যে, লিগই প্রথম আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির ধারণাটিকে জনপ্রিয় করে তোলে। এটিই তার শ্রেষ্ঠ অবদান। এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত হয় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ।
(FAQ) জাতিসংঘের কার্যাবলী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯১৯ সালে।
২৮ এপ্রিল।
১০ জানুয়ারি, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো।