ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসন নীতি

ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসন নীতি প্রসঙ্গে জনহিতকর নীতি, উদার স্বৈরতন্ত্র, নমনীয় নীতি, স্থায়ী জাগীর প্রথা, আকবরের সাথে তুলনা, ধর্মনীতি, সেনাদল ধ্বংস, শৈথিল্য ও উদাসীনতা এবং শাসন নীতির ত্রুটি সম্পর্কে জানবো।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসন নীতি

ঐতিহাসিক ঘটনা ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসন নীতি
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক
বংশ তুঘলক বংশ
পূর্বসূরি মহম্মদ বিন তুঘলক
ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসন নীতি

ভূমিকা :- ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসন নীতি সমকালীন যুগের লেখকদের দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। সামস-ই-সিরাজ আফিফ তাঁর তারিখ-ই-ফিরোজশাহীতে সুলতানের শাসন সংস্কারের দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন এবং তার উচ্চ প্রশংসা করেছেন। এর ওপর নির্ভর করে হেনরী এলিয়ট ফিরোজকে “সুলতানি যুগের আকবর” বলেছেন।

জনহিতকর নীতি

  • (১) এ কথা সত্য যে, ফিরোজ শাহ উদার প্রাণ, ধর্মনিষ্ঠ, দয়ালু শাসক ছিলেন। তিনি আলাউদ্দিনের আমলের বাড়তি কর লোপ করেন, জলসেচের ব্যবস্থা করে কৃষকের উপকার করেন। তিনি শরিয়ত সম্মত ৪ প্রকার কর এবং সেচকর আদায় করতেন। পূর্ববর্তী সুলতানদের মত তিনি বাড়তি কর ও উপকর আদায় করতেন না।
  • (২) তিনি অন্তঃশুল্ক লোপ করে বাণিজ্যের উন্নতি করেন। মোট ২৪ প্রকার উপকর ও শুল্ক তিনি লোপ করেন। তাঁর আমলে কৃষির প্রভূত উন্নতি হয় এবং স্বাভাবিকভাবে সরবরাহ বেশী থাকায় খাদ্যশস্যের দাম যথেষ্ট সস্তা ছিল।
  • (৩) আফিফের মতে, তিনি আলাউদ্দিনের মত দমন নীতি প্রয়োগ না করেই, খাদ্যশস্যের সরবরাহ ঠিক রাখেন এবং দাম সস্তা রাখেন। তাঁর ৩৮ বছর রাজত্বকালে কোনো দুর্ভিক্ষ বা খাদ্য সঙ্কট দেখা যায় নি।
  • (৪) মধ্য যুগের ঐতিহাসিকরা সাধারণত কোন সুলতানের শাসন ভালো অথবা মন্দ তা বিচার করার জন্য খাদ্যশস্যের দামের কথা বিচার করেন এবং খাদ্য সরবরাহ সঠিক ছিল কিনা তা দেখেন। এই মাপকাঠিতে বিচার করলে ফিরোজ তুঘলককে এক অসাধারণ সফল সুলতান বলা চলে। তার জনপ্রিয়তা তাঁর সফলতার বড় প্রমাণ।
  • (৫) যে ক্ষেত্রে সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের শাসন ব্যবস্থা ঘন ঘন বিদ্রোহের দ্বারা ভেঙে পড়ে, সেক্ষেত্রে ফিরোজ শাহের বিরুদ্ধে অভিজাত অথবা সাধারণ কৃষক প্রজারা কোনো বিদ্রোহ করে নি।

উদার স্বৈরতন্ত্র

ফিরোজ শাহ যদিও স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু তাঁর শাসনব্যবস্থাকে উদারতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র বলা যায়। আলাউদ্দিন তার স্বৈরতন্ত্রকে সামরিক শক্তি ও দমন নীতির দ্বারা কায়েম করেন। অভিজাত শ্রেণীকে তিনি দমন নীতির দ্বারা বশে রাখতেন। মহম্মদ বিন তুঘলক দমন নীতির দ্বারা তার স্বৈরতন্ত্রকে রক্ষা করেন। এজন্য ইবন বতুতা মহম্মদের স্বৈর শাসনের নিন্দা করেছেন।

নমনীয় নীতি

ফিরোজ শাহ তুঘলক যখন সিংহাসনে বসেন তখন মহম্মদের আমলের বিদ্রোহের আগুনে সুলতানি সাম্রাজ্য জ্বলছিল। ফিরোজ তাঁর উদার, নমনীয় নীতির প্রভাবে সেই ক্ষত নিরাময় করেন। ফিরোজ শাহ অভিজাত, উলেমা ও অন্যান্য সরকারী কর্মচারীদের প্রতি দমননীতি না নিয়ে নমনীয় নীতি নেন। এর ফলে তিনি অভিজাত ও উলেমা শ্রেণীর সমর্থন পান।

স্থায়ী জাগীর প্রথা

সিংহাসনে বসার পরেই তিনি অভিজাত ও অন্যান্য লোকদের কাছে সরকারের যে অর্থ প্রাপ্য ছিল তা মকুব করেন। তিনি নগদ বেতনের স্থলে জাগীর দেন। জাগীরদারের মৃত্যু হলে তার পরিবারে জাগীরটি স্থায়ী করার ব্যবস্থা করেন। তিনি উলেমাদের বৃত্তি দেন এবং মসজিদ, খানকায় নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ করেন। প্রাদেশিক কর্মচারীরা দুর্নীতিগ্রস্থ হলেও তিনি তাদের প্রতি দমনমূলক নীতি নেন নি।

আকবরের সাথে তুলনা

ফিরোজ শাহ জনহিতকর কাজের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। এই বিষয়ে তাকে সম্রাট আকবরের সঙ্গে তুলনা করা চলে। তিনি দরিদ্র ব্যক্তিদের জন্য দাতব্য বিভাগ গঠন করেন। এখানে সহায়, সম্বলহীন লোকেরা বিনামূল্যে খাদ্য ও চিকিৎসার সুযোগ পেত। তিনি কন্যাদায়গ্রস্থ মুসলিম পিতামাতা দরিদ্র হলে তাদের কন্যার বিবাহের জন্য অর্থ সাহায্য দিতেন।

ধর্মনীতি

  • (১) ফিরোজ শাহ তুঘলকের ধর্মনীতি সম্পর্কেও উল্লেখ করা দরকার। তাঁর রাজত্বের শেষের ১৫ বছর বাদে তিনি মোটামুটিভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি রক্ষা করেন। যদিও তিনি জিজিয়া কর আরোপ করেন, কিন্তু ডঃ নিজামী প্রমুখের মতে ফিরোজ শাহ জিজিয়াকে ধর্মীয় কর হিসেবে ভাবতেন না। ভূমিকর ছাড়া অমুসলিমদের প্রদেয় কর হিসেবেই জিজিয়াকে গণ্য করা হয়।
  • (২) ১৩৭৪ খ্রিস্টাব্দের পর উলেমাদের প্রভাবে ফিরোজ শাহ তার ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে কিছুটা সরে আসেন। তথাপি একথা বলা যায় যে, ফিরোজ কোনরকমেই ধর্মান্ধ সুলতান ছিলেন না। তাঁর আমলে হিন্দু খুৎ, মুকাদ্দম শ্রেণী বিশেষভাবে অর্থবান হয়।
  • (৩) কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, ফিরোজ শাহ উলেমাদের সঙ্গে আপোষ করে তার সিংহাসন সুরক্ষিত করেন। এজন্য উলেমাদের কিছু কিছু দাবী তিনি রাজনৈতিক কারণে মেনে নেন। তবে তিনি যুক্তিহীন, ধর্মান্ধ, গোঁড়া সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন সুলতান ছিলেন তা মনে করা যায় না।

শাসন নীতির ত্রুটি

ফিরোজের শাসন নীতির এমন কতকগুলি ভুল ছিল যার ফলে সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। যেমন –

  • (১) মধ্যযুগে দিল্লীর সুলতানি শাসকের স্বৈরক্ষমতা, দক্ষতা ও তার সম্পর্কে জনসাধারণের ভীতির ওপর দাঁড়িয়েছিল। বলবন, আলাউদ্দিন সফল শাসক ছিলেন কারণ লোকে তাদের ভয় করত।
  • (২) ফিরোজ তার সুলতানি শাসনের পশ্চাতে force অর্থাৎ শক্তিকে দুর্বল করে ফেলেন। তিনি সকল ক্ষেত্রে তোষণ অথবা আপোষ নীতি গ্রহণ করায় সুলতানের সিংহাসনের ক্ষমতা দ্রুত ক্ষয় পায়। ফিরোজের মৃত্যুর পর এই ক্ষমতা আর ফিরিয়ে আনা যায় নি।
  • (৩) সুলতান ফিরোজ শাহ যে উদারনৈতিক ও সংস্কার দ্বারা অভিজাত ও উলেমা শ্রেণীর কাছ থেকে শান্তি ক্রয় করেন, পরিণামে তা তার সাম্রাজ্যের সংহতি বিনষ্ট করে। তার আপোষ নীতি বা তোষণ নীতি তাকে জনপ্রিয়তা দিলেও, তার সাম্রাজ্যের ঐক্য ও শাসন ব্যবস্থার শক্তিকে তা দৃঢ় করতে পারে নি।
  • (৪) ফিরোজ তার শাসনব্যবস্থার সঙ্গে কোরাণের নীতির সমন্বয় সাধনের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। ডঃ নিজামীর মতে, ফিরোজের স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে কোরাণের নীতির সমন্বয় সফল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।
  • (৫) ফিরোজ উলেমাদের শাসনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের অধিকার দেন। এর ফলে রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে। তিনি অভিজাতদের সিংহাসনের অধীনে রাখার চেষ্টা না করে তাদের হাতে প্রচুর ক্ষমতা দেন।
  • (৬) জাগীর প্রথা প্রবর্তনের ফলে অভিজাতরা শক্তিশালী হয়ে পড়ে। এর ফলে নিজ নিজ অঞ্চলে অভিজাতরা স্বাধীন শাসকের মত আচরণ করে। শাসনব্যবস্থার সর্বস্তরে দুর্নীতি দেখা দেয়। কিন্তু ফিরোজ দুর্নীতি দমন না করে উদাসীন থাকেন।

সেনাদল ধ্বংস

  • (১) সুলতানি সেনাদল ছিল সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ড। এই সেনাদল দ্বারা দিল্লীর সুলতানরা তাদের স্বৈরশাসন চালু রাখতেন, বিদ্রোহ দমন এবং বৈদেশিক আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতেন। আলাউদ্দিন তাঁর সংস্কার নীতির দ্বারা এই সেনাদলকে এক শক্তিশালী যন্ত্রে পরিণত করেন।
  • (২) আলাউদ্দিন ও মহম্মদ এই সেনাদলে কঠোর শৃঙ্খলা স্থাপন করেন এবং নগদ বেতন প্রদানের নীতি চালু করেন। ফিরোজ তার সেনাদলে নিয়মিত ‘আরজ’ বা সামরিক কুচকাওয়াজ ও পরিদর্শনের নিয়ম রক্ষা করেন নি। নিয়মিত ‘আরজ’ রহিত করার ফলে সেনাদলে শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়।
  • (৩) তিনি দাগ ও হুলিয়া প্রথা রক্ষা না করায়, সেনারা উপযুক্ত যুদ্ধের ঘোড়া, যার জন্য তারা সরকার থেকে অর্থ পেত তা রাখা বন্ধ করে দেয়। ফিরোজ সেনাদের ও সামরিক কর্মচারীদের পদগুলি বংশানুক্রমিক করার ফলে সেনাদলের দক্ষতা একেবারে নষ্ট হয়।
  • (৪) ডঃ নিজামীর মতে, ফিরোজের এই ব্যবস্থাটি ছিল মূর্খতাপূর্ণ ও বুদ্ধিহীনতার পরিচায়ক। ফিরোজ সেনাদলকে নগদ বেতন না দিয়ে, জাগীরগুলি থেকে তাদের প্রাপ্য অর্থ নেওয়ার জন্য ইৎলাখনামা দেন। এটি ছিল এক ধরনের ভাতা বা পেনশন।
  • (৫) ইৎলাখনামা প্রাপ্ত সৈনিকটির মৃত্যুর পর তার বংশধররা এই ইৎলাখনামার সাহায্যে নিয়মিত অর্থ পেত। কিন্তু তারা প্রয়োজনীয় সামরিক দায়িত্ব পালন করত না। ‘আরজ’ প্রথা ভেঙে পড়ায় সাধারণ সৈনিক ও নিম্নপদের সামরিক কর্মচারীরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে উৎকোচ দিয়ে, ইৎলাখনামা আদায় করে নিত।
  • (৬) সামরিক মন্ত্রী ইমাদ-উল-মুলক বশির এইভাবে দুর্নীতি দ্বারা ১৩ কোটি টাকা সঞ্চয় করেন, যার পরিমাণ ছিল ফিরোজ শাহের গোটা সাম্রাজ্যের দুবছরের মোট রাজস্বের সমান। কৃষকরা যেমন গোলায় ধান বা গম মজুদ রাখে, বশির মাটির ভেতর পাকা গাঁথনীর কূপ খুঁড়ে সমুদায় অর্থ মজুদ করেন।

শৈথিল্য ও উদাসীনতা

ফিরোজের শিথিল ও উদাসীন নীতির ফলে সুলতানি সরকারের প্রধান শক্তি সেনাদল ভেঙে পড়ে। সিন্ধুদেশে সুলতানের অভিযানের পর থেকেই এই ভাঙন শুরু হয়। তাঁর গোটা বাহিনী দুর্নীতি ও শৃঙ্খলাহীনতায় ক্ষয় পেতে থাকে। ফিরোজ তা জানা সত্ত্বেও উদাসীন থাকেন।

আফিফের মন্তআফিফ বলেছেন যে, সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে খাদ্যশস্যের দাম কম ছিল, লোকে সুখে ছিল এবং সাম্রাজ্যে দুর্ভিক্ষ ছিল না, কিন্তু ইনশা-ই-মহুরু ও খয়ের-উল-মজলিস থেকে তা সমর্থিত হয় নি। ইনশা-ই-মহুরুতে বলা হয়েছে যে, খাদ্যশস্যের দাম উঠা-নামা করত এবং বণিকরা দাম বৃদ্ধি করত।

উপসংহার :- খয়ের-উল-মজলিস অনুসারে, ফিরোজ শাহের রাজত্বের গোড়ার দিকে জনসাধারণের অর্থনৈতিক দুর্দশা তীব্র ছিল এবং আলাউদ্দিনের আমলে ফিরোজের আমল অপেক্ষা সস্তায় খাদ্য পাওয়া যেত। ফিরোজ বহু শত ক্রীতদাস ক্রয় করে রাজ্যের ভাঙা অর্থনীতিকে আরও ভারাক্রান্ত করেন।

(FAQ) ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসন নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ফিরোজ শাহ তুঘলক কে সুলতানী যুগের আকবর বলেছেন কে?

হেনরী এলিয়ট।

২. কোন সুলতান শরিয়ত সম্মত ৪ প্রকার কর আদায় করতেন।

ফিরোজ শাহ তুঘলক।

৩. কোন সুলতানের সময়কালে সেনাবাহিনীর আরজ প্রথা ভঙ্গে পড়ে?

ফিরোজ শাহ তুঘলক।

Leave a Comment