বখতিয়ার খলজির বাংলা জয় প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক উপাদান, বখতিয়ার খলজির উত্থান, বিহার অভিযান, লক্ষ্মণ সেনের অপদার্থতা, নদীয়া আক্রমণ, লক্ষ্মণ সেনের পরায়ণ নদীয়া লুন্ঠন ও রাজধানী স্থাপন সম্পর্কে জানবো।
বখতিয়ার খলজির বাংলা জয়
ঐতিহাসিক ঘটনা | বখতিয়ার খলজির বাংলা জয় |
সেনাপতি | বখতিয়ার খলজি |
উপাদান | তবাকৎ-ই-নাসিরি |
বাংলার রাজা | লক্ষ্মণ সেন |
রাজধানী স্থাপন | লক্ষ্মণাবতী |
ভূমিকা :- কুতুবউদ্দিন আইবকের অনুমতিতে তার অনুচর বখতিয়ার খলজি বাংলা ও বিহার জয় করেন। তার বাংলা অভিযানের সময় বাংলার রাজা ছিলেন লক্ষ্মণ সেন।
উপাদান
- (১) বখতিয়ার খলজির বাংলা জয় সম্পর্কে মিনহাজ উদ্দিন সিরাজের তবাকৎ-ই-নাসিরি গ্রন্থ থেকে পুরো বিবরণ পাওয়া যায়। মিনহাজ বাংলা জয়ের প্রায় অর্ধশতক পরে সামসুদ্দিন নামে জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী সেনার কাছ থেকে বখতিয়ার খলজির বাংলা জয়ের বিবরণ সংগ্রহ করেন।
- (২) তারিখ-ই-ফিরিস্তা ও হাসান নিজামীর তাজ-উল-মাসির থেকেও কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। ডঃ মজুমদার মিনহাজের বিবরণের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কারণ মিনহাজ নিজ অভিজ্ঞতা থেকে এই বিবরণ দেননি। তবে ফিরিস্তার বিবরণ হতে মিনহাজ মোটামুটি সমর্থিত হন। ইসামীর রচনা থেকেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
বখতিয়ার খলজির উত্থান
- (১) বখতিয়ার খলজির পূর্ব জীবন সম্পর্কে জানা যায় যে, তার পুরো নাম ছিল মালিক ইজুজ-উদ-দিন-মহম্মদ-বখতিয়ার খলজি। তিনি ছিলেন গরমশীরের অধিবাসী। তিনি ছিলেন কদাকার এবং উচ্চাকাঙ্খী।
- (২) ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে গজনী, দিল্লী হয়ে তিনি বদাউনের মাক্তাদারের অধীনে সৈনিকের চাকুরীতে যোগ দেন। পরে তিনি অযোধ্যার শাসনকর্তার অধীনে ইক্তাদার নিযুক্ত হন। এই স্থান থেকে তিনি প্রতিবেশী বিহারের দিকে দৃষ্টি দেন। সেই সময় বিহার ছিল সেন রাজাদের অধীনে।
বিহার অভিযান
- (১) বখতিয়ার প্রথমে বিহারে অভিযান চালিয়ে বহু ধনরত্ন লুঠ করেন। এই অর্থের দ্বারা তিনি এক শক্তিশালী সেনাদল গড়েন। বহু তুর্কী, খলজি সেনা তার অধীনে যোগ দেয়। এই আক্রমণের সময় বখতিয়ার দুর্গ বলে ভ্রমবশত একটি বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করেন ও বহু ভিক্ষুকে হত্যা করেন।
- (২) লামা তারানাথের মতে, বখতিয়ার বিক্রমশীলা বিহার ধ্বংস করেন। তিনি ওদন্তপুরী বিহার ধ্বংস করে সেই স্থলে একটি দুর্গ স্থাপন করেন। এর পর তিনি ১২০০ খ্রিস্টাব্দে প্রচুর উপঢৌকনসহ কুতব উদ্দিন আইবকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলা অভিযানের অনুমতি লাভ করেন।
লক্ষ্মণ সেনের অপদার্থতা
- (১) ১২০৩-৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বখতিয়ার খলজি বিহার জয় করে বাংলার সীমান্তে এসে পড়েন। ৮০ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন বা রায় লখমনিয়া তার ধর্ম-কর্ম ও জ্যোতিষচর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় প্রকৃতভাবে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি করতে অবহেলা করেন।
- (২) তিনি বখতিয়ারের আক্রমণের সম্মুখে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জ্যোতিষীদের কাছে জানতে চাইলে জ্যোতিষীরা তাকে “তুর্কীদের অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাজধানী ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
- (৩) জ্যোতিষীরা বলেন যে, শাস্ত্রে লেখা আছে যে, তুর্কীদের হাতে তাঁর রাজ্য বিজিত হবে। তারা জানান যে, “যে ব্যক্তির দুই বাহু এত বড় হবে যে তা সেই ব্যক্তির হাঁটু পর্যন্ত ঝুলে থাকবে, সেই ব্যক্তিই শাস্ত্র মতে বাংলা জয় করবে।”
- (৪) লক্ষ্মণ সেন খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে, বখতিয়ার খলজির দুই হাত এরূপ লম্বা। সুতরাং রাজা লক্ষ্মণ সেন মনোবল হারিয়ে ফেলেন। তিনি “ঐন্দ্রি মহাশান্তি” যজ্ঞ করে ভাগ্য ফেরাবার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। পুরুষাকারের পরিবর্তে তিনি অদৃষ্টবাদকে আশ্রয় করেন।
নদীয়া আক্রমণ
মিনহাজের মতে, ১২০৫-৬ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার তার বাহিনী নিয়ে বাংলার রাজধানী নদীয়া বা নবদ্বীপের দিকে এগিয়ে চলেন। তিনি এত দ্রুত ঘোড়া ছুটান যে, মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী তার সঙ্গে একতালে চলতে পারে। তার পিছনে মূল বাহিনী আসতে থাকে।
লক্ষ্মণ সেনের পলায়ন
- (১) নদীয়ার নগর দরজায় এসে তিনি কাহাকেও আক্রমণ না করে ১৮ জন সহচর সহ রাজপ্রাসাদের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। লোকে তাদের ঘোড়া বিক্রেতা বলে মনে করে। রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটক পার হয়ে তিনি রক্ষীদের আক্রমণ করেন।
- (২) এই সময় রাজা লক্ষ্মণ সেন মধ্যাহ্ন ভোজনে বসেছিলেন। গোলমালের শব্দে তিনি জানতে পারেন যে, তুর্কী সেনা প্রাসাদ আক্রমণ করেছে। লখমনিয়া বা লক্ষ্মণ সেন খালি পায়ে খিড়কি দরজা দিয়ে বজরায় চেপে বিনাযুদ্ধে নদীয়া থেকে পূর্ব বাংলায় পালিয়ে যান।
নদীয়া লুন্ঠন
লক্ষ্মণ সেনের ধন সম্পদ, তার প্রজাবর্গ ও পরিজন এবং দাসদাসীদের বখতিয়ার অধিকার করেন। তুর্কী সেনাদল নদীয়া লুঠ করে বহু ধনরত্ন পায়।
রাজধানী স্থাপন
বখতিয়ার নদীয়াকে তার নব বিজিত রাজ্যের রাজধানীর উপযুক্ত মনে না করে, লক্ষ্মণাবতীকে তার রাজধানী হিসেবে মনোনয়ন করেন। বখতিয়ার উত্তর বাংলায় তাঁর আধিপত্যকে অপেক্ষাকৃত দৃঢ় করেন। নদীমাতৃক দক্ষিণ বাংলা ছিল তাঁর কাছে অনেকটা অপরিচিত, অসুবিধাজনক স্থান।
তিব্বত অভিযান
- (১) বখতিয়ার খলজি এর পর তিব্বত অভিযানের জন্য প্রস্তুত হন। বখতিয়ার খলজির তিব্বত অভিযানের কারণ মিনহাজ উল্লেখ করেননি। ডঃ নিজামীর মতে, সম্ভবত বখতিয়ার তিব্বতের মধ্য দিয়ে তুর্কীস্থানের সঙ্গে যোগাযোগের সংক্ষিপ্ত ও সোজা পথ বের করার চেষ্টা করেন।
- (২) তুর্কীস্থানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে সম্ভবত তিনি তুর্কীস্থান থেকে নুতন সেনা এনে বাংলার অন্যান্য অঞ্চল জয় করার পরিকল্পনা করেন। তাছাড়া দিল্লীর অধীনতা মুক্ত হয়ে স্বাধীন সুলতান হওয়ার উচ্চাকাঙ্খা হয়ত তার ছিল।
হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলে অভিযান
মিনহাজের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, বাগমতী নদী পার হয়ে, কোচ, মেচু প্রভৃতিদের দেশ পার হয়ে তিনি হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলে ঢুকে পড়েন। কিন্তু প্রবল বাধার আশঙ্কায় তিনি ফিরে আসেন। ইতিমধ্যে বাগমতী নদীর পুলটি শত্রুরা ধ্বংস করায় নদী পারাপারের সময় শত্রুর আক্রমণে তাঁর বহু সেনা নিহত হয়।
উপসংহার :- হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলে বাধা পেয়ে সম্পূর্ণ হতবল হয়ে তিনি রাজধানীতে ফিরে আসেন। এর ফলে বখতিয়ার দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় আলিমর্দান খলজি নামে এক ব্যক্তি তাকে নিহত করেন।
(FAQ) বখতিয়ার খলজির বাংলা জয় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
বখতিয়ার খলজি।
লক্ষ্মণ সেন।
লক্ষ্মণাবতী।
মিনহাজ উদ্দিন সিরাজের তবাকৎ-ই-নাসিরি গ্রন্থ থেকে।