চিনে সংঘটিত ৪ ঠা মে সংঘটিত আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে আভ্যন্তরীন ও বাহ্যিক সমস্যা, সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা, আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা, ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, ঐতিহ্য বিরোধী সংগ্রাম, অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বুর্জোয়া শ্রেণীর সমর্থন, বয়কট কর্মসূচি, শিল্পপতিদের সমর্থন, বণিক সংগঠনের সমর্থন, আন্দোলনের অর্থনৈতিক আদর্শ ও আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির অংশ গ্ৰহণ সম্পর্কে জানবো।
চীনা সাংস্কৃতিক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক ৪ঠা মে আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে ৪ঠা মে আন্দোলনের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য, ৪ঠা মে আন্দোলনের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য, ৪ঠা মে আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির অংশ গ্ৰহণ ও ৪ঠা মে আন্দোলনের অর্থনৈতিক আদর্শ সম্পর্কে জানব।
৪ঠা মে আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
ঐতিহাসিক ঘটনা | ৪ঠা মে আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য |
সময়কাল | ৪ মে ১৯১৯ খ্রি |
দেশ | চীন |
শ্লোগান | জিউ গুয়ো |
নিউ ইউথ পত্রিকা | চেন তু শিউ |
ভূমিকা :- চিনের ৪ঠা মে আন্দোলন-এর সব থেকে জনপ্রিয় স্লোগান ছিল “জিউগুয়ো” অর্থাৎ “দেশকে বাঁচাও”। প্রকৃতপক্ষে ৪ঠা মে আন্দোলন ছিল চীনের ওপর বৃহৎ শক্তিবর্গের অপমানজনক শর্তাবলী জোর করে চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে এক দেশপ্রেমিক প্রতিবাদ।
৪ঠা মে আন্দোলনের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য
চিনের ৪ঠা মে আন্দোলনের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য গুলি হল –
(ক) আভ্যন্তরীন ও বাহ্যিক সমস্যা
- (১) এই জাতীয় অভ্যুত্থানের সব থেকে মৌলিক দিক ছিল এই যে, আন্দোলনকারীরা একই সাথে অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় শত্রুর বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়েছিলেন। খুব সম্ভব চিনের আধুনিক ইতিহাস-এ এই প্রথম একটি আন্দোলন অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।
- (২) পিকিং-এর বিক্ষোভকারীরা তাঁদের উদ্দেশ্য খোলসা করেই ব্যক্ত করেছিলেন, বহিরাগত দিক দিয়ে চিনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম চালাতে হবে এবং অভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে।
(খ) সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা
- (১) ৪ঠা মে-র রাজনৈতিক সংগ্রাম একই সাথে বৃহৎ শক্তিগুলির চীনের প্রতি সাম্রাজ্যবাদী ও অসম চুক্তিব্যবস্থা চালিয়ে যাবার নীতির এবং এই সমস্ত বৃহৎ শক্তিবর্গের লালসা বৃদ্ধিকারী অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে দেশের রক্ষণশীল অংশের সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়বৃত্তি করার নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিল।
- (২) এই যোগসূত্র প্রায় ২০ বছর পর মাও সে-তুং-কেও চীনা বিপ্লবকে একই সাথে “সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী” এবং “সামন্ততন্ত্র বিরোধী” হিসাবে আখ্যায়িত করতে সাহায্য করেছিল। চীনের বিপ্লবের এই সংজ্ঞাই ছিল মাও সে-তুং-এর “নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব”-এর ধারণার তাত্ত্বিক ভিত্তি।
(গ) আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা
- (১) ৪ঠা মে আন্দোলনের আর একটি মৌলিক রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ছিল আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে চীনের রাজনীতিবিদ বা পর্যবেক্ষকেরা চীনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এতটা সুদূরপ্রসারী অথচ অকস্মাৎ পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।
- (২) ভার্সাই শান্তি-চুক্তিতে চীনের প্রতি বৃহৎ শক্তিবর্গের অপমানজনক আচরণের প্রতিবাদে পিকিং-এর ছাত্রসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এই আন্দোলনের পেছনে কোনো সংগঠিত বা সক্রিয় রাজনৈতিক দলের হাত ছিল না।
- (৩) এমনকি, তৎকালীন চীনের সব থেকে সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন সান ইয়াৎ-সেনের নেতৃত্বাধীন চুংমুয়া কেমিং টাং’ পর্যন্ত এই অভ্যুত্থানের স্বতঃস্ফূর্ততায় আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। এই সংগঠনের নেতা এবং বুদ্ধিজীবীরা প্রথম দিকে আন্দোলনে যোগ দেন নি। কিন্তু যখন তাঁরা দেখলেন যে, বেশিদিন এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বাইরে থাকা সম্ভব নয়, তখন তাঁরা এই আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন।
(ঘ) ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম
সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ – ছাত্র-সংগঠন, বণিক-সংগঠন এবং শ্রমিক-সংগঠনগুলি ও বিভিন্ন বামপন্থী পত্র- পত্রিকার সাথে যুক্ত বুদ্ধিজীবীরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলে সাম্রাজ্যবাদ ও তার অভ্যন্তরীণ সহায়ক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম চালানোর সূত্র খুঁজে পেয়েছিল।
(ঙ) ঐতিহ্য বিরোধী আন্দোলন
১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে চেন তু-শিউ কর্তৃক প্রকাশিত New Youth পত্রিকা পুরাতনতান্ত্রিক ও ঐতিহ্যবাহী ধ্যান-ধারণার বিরোধিতা করেছিল। ৪ঠা মে আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসাবে চিনের ঐতিহ্য-বিরোধী ও প্রগতিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা “ইয়ং চায়না” (Young China) নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করেছিল।
৪ঠা মে আন্দোলনের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য
চিনের ৪ঠা মে আন্দোলনের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য গুলি হল –
(ক) বুর্জোয়া শ্রেণীর সমর্থন
চিনের বুর্জোয়া শ্রেণীর ৪ঠা মে আন্দোলন সমর্থন করার পেছনে দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, তাঁরা চীনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এবং দ্বিতীয়ত, তাঁরা নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন।
(খ) বয়কট কর্মসূচি
বিক্ষোভকারী ছাত্রদের জাপানি পণ্য বয়কট করার কর্মসূচি সাধারণ মানুষের কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, কারণ তাঁরা এই কর্মসূচিকে দেশপ্রেমিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা বলে মনে করেছিলেন।
(গ) শিল্পপতিদের সমর্থন
অন্যদিকে চিনা শিল্পপতিরা দেশীয় বাজারে তাঁদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জাপান-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামকে স্বাভাবিকভাবেই সমর্থন করেছিলেন। জাঁ শ্যেনো বলেছেন, “জাতীয় ও শ্রেণী স্বার্থের এই যৌথ প্রকাশ ৪ঠা মে আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল” (This combined expression of national and class interest was a salient feature of the May Fourth Movement.)।
(ঘ) বণিক সংগঠনের সমর্থন
৪ঠা মে আন্দোলন আরম্ভ হবার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বুর্জোয়া শ্রেণী এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক সমর্থন জানিয়েছিল। ক্যান্টন, তিয়েনসিন, সাংহাই প্রভৃতি বড়ো বড়ো শহরে বিভিন্ন চেম্বার অফ কমার্স ও বণিক সংগঠনগুলি ৪ঠা মে’র ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করেছিল এবং সরকারি দমননীতির তীব্র নিন্দা করেছিল।
(ঙ) আন্দোলনের অর্থনৈতিক আদর্শ
- (১) জাপানি পণ্য বয়কট করার কর্মসূচি চিনা ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শ্রেণীস্বার্থের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। সাংহাই অঞ্চলের বস্ত্রশিল্পে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মাত্র এক বছরের মধ্যেই সুতার আমদানি ৫৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই চিনে তৈরি সুতা এই শূন্যস্থান পূরণ করেছিল।
- (২) চিনের বণিকেরা এই আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে জাতীয় পণ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ভরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। “দেশপ্রেমিক পণ্য” কেনার অনুরোধ জানিয়ে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার চালানো হয়েছিল। আবার অনেক ক্ষেত্রে ছোটো উদ্যোক্তাদের চাঁদার টাকায় ছোটো ছোটো কারখানা গড়ে ওঠে।
- (৩) এই সমবায় ভিত্তিক পুঁজিবাদের উত্থান ৪ঠা মে আন্দোলনের অর্থনৈতিক আদর্শ প্রতিফলিত করেছিল। এই ধরনের উদ্যোগের ফলস্বরূপ বেশ কিছু দিয়াশলাই ও কাগজের কারখানা গড়ে উঠেছিল।
(চ) আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির অংশ গ্ৰহণ
- (১) ৪ঠা মে আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণীর অংশগ্রহণ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনোরকম শ্রেণীস্বার্থের দ্বারা পরিচালিত হয়ে তাঁরা এই আন্দোলনে যোগ দেন নি। কেবল দেশপ্রেমিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরা এই আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন।
- (২) সাংহাই-এর ধর্মঘটি শ্রমিকেরা একটি প্রচারপত্রে নিজেদের “ছাত্র ও বণিকদের রক্ষাকবচ” (Rear guard shield of the students and merchants) হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ৪ঠা মে আন্দোলনের পর থেকেই শ্রমিকশ্রেণী নিজেদের রাজনৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে আরম্ভ করে।
উপসংহার :- ৪ঠা মে আন্দোলনের কর্মকাণ্ডে কৃষকশ্রেণী ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। চিনের গ্রামীণ সমাজ এই আন্দোলন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিল, কারণ এই আন্দোলনের মুখ্য পরিচালক ছিল শহরাঞ্চলে নতুন উঠে আসা সামাজিক শ্রেণীগুলি।
(FAQ) ৪ ঠা মে সংঘটিত আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
চিনে।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ মে।
জিউ গুয়ো অর্থাৎ দেশ কে বাঁচাও।
চেন তু শিউ।
অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি
- কেন্দ্রীয় চোল শাসন
- সাম্রাজ্য ও রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য
- অর্থনীতিতে দাসপ্রথার গুরুত্ব
- রোমের দাসদের মুক্তির উপায়
- রোমান সাম্রাজ্য ও উপমহাদেশীয় সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে যোগাযোগের প্রভাব
- জাস্টিনিয়ান পরবর্তী রাজবংশ
- রোমান সমাজে নারীর অবস্থান
- বাইজানটাইন সভ্যতা-সংস্কৃতির নানা দিক
- রোমান সাম্রাজ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশ