জাপানের সাথে আজাদ হিন্দ বাহিনীর যোগসূত্র প্রসঙ্গে জাপানে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি, জাপানের উদ্যোগ, ভারতীয় সেনাদের মর্যাদা প্রদান, ফারার পার্ক বক্তৃতা, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গঠন, সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি, আদর্শ, রাসবিহারী বসুকে সাহায্য দান, সুভাষচন্দ্র বসুকে সাহায্য দান ও আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান সম্পর্কে জানবো।
দূর প্রাচ্যের জাপানের সাথে আজাদ হিন্দ বাহিনীর যোগসূত্র প্রসঙ্গে জাপানে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গঠন, জাপানের উদ্যোগে ভারতীয় সেনাদের মর্যাদা প্রদান, রাসবিহারী বসুকে জাপানের সাহায্য প্রদান ও সুভাষচন্দ্র বসুকে জাপানের সাহায্য প্রদান সম্পর্কে জানব।
জাপানের সাথে আজাদ হিন্দ বাহিনীর যোগসূত্র
ঐতিহাসিক ঘটনা | জাপানের সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজের যোগসূত্র |
ফারার পার্ক বক্তৃতা | ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ খ্রি |
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি | জাপান |
লেফটেন্যান্ট কর্নেল | ক্যাপ্টেন মোহন সিং |
প্রধান কার্যালয় | নী-সুন ক্যাম্প |
ভূমিকা :- জাপান ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর মার্কিন নৌঘাঁটি পার্ল হারবারে বোমাবর্ষণের মধ্য দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে এক বৃহত্তর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী ৬ মাস ধরে জাপান প্রবল গতিতে পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে জাপানের বিজয় পতাকা উত্তোলন করতে সক্ষম হয়। এই সময় জাপান মিত্রশক্তির অন্যতম সদস্য ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ভারত-এর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ব্যবহার করার সুযোগ পায়। জাপানের সামরিক বাহিনীর ছত্রছায়ায় সেখানে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ (Indian National Army) গঠিত হয়।
জাপানে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর (১৯৩৯-৪৫ খ্রি.) সময় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ভারতের বাইরেও বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতের বীর দেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্র বসু এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজ বা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (The Indian National Army = INA)-র সংগ্রাম। প্রধানত জাপানের উদ্যোগে, সহযোগিতায় ও ছত্রছায়ায় এই বাহিনী গড়ে উঠেছিল।
জাপানের উদ্যোগ গ্রহণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হাতে বন্দি ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে জাপান উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) ফুজিওয়ারা কিকন
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে জাপানি ইম্পিরিয়াল জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স মেজর ইওয়াইচি ফুজিওয়ারার নেতৃত্বে ব্যাঙ্ককে ফুজিওয়ারা কিকন নামে একটি মিশন গঠন করে। এই মিশনের অন্যতম দায়িত্ব ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলা।
(২) বন্দি সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ
থাইল্যান্ড ও নিকটবর্তী অঞ্চলে নির্বাসিত ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে জাপানি সেনাবাহিনীর মেজর ইওয়াইচি ফুজিওয়ারা সাফল্যের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলেন। এদিকে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন মোহন সিং ও এই বাহিনীর বহু সৈন্য জাপানের হাতে বন্দি হন। এই বাহিনীর অন্যতম নেতা ছিলেন প্রিতম সিং।
জাপানে বন্দি ভারতীয় সেনাদের মর্যাদা দান
বন্দি ভারতীয় সেনাদের জাপানে বিভিন্ন ভাবে মর্যাদা দেওয়া হয়। যেমন –
(১) সমাবেশের আয়োজন
তরুণ জাপানি মেজর ফুজিওয়ারা জাপানের হাতে বন্দি সেনাদের মধ্যে ইংরেজ ও অস্ট্রেলীয় সেনাদের থেকে ভারতীয় সেনাদের পৃথক করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাপান সিঙ্গাপুর দখল করার ২ দিন পর ফুজিওয়ারা এই বন্দি ভারতীয় সেনাদের নিয়ে সিঙ্গাপুরে একটি সমাবেশের আয়োজন করেন।
(২) ফুজিওয়ারা-র উদ্যোগ
জাপানের তরুণ সামরিক অফিসার ইওয়াইচি ফুজিওয়ারা ভারতের ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে এই বন্দি ভারতীয় সেনাদের ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেন। তিনি এই বন্দি সেনাদের নিয়ে মোহন সিং-এর নেতৃত্বে একটি সেনাদল গঠনের পরামর্শ দেন। জাপানের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য একটি ‘মুক্তিবাহিনী’ গঠন করা।
ফারার পার্ক বক্তৃতা
এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হল –
(১) ফুজিওয়ারা-র বক্তৃতা
ক্যাপ্টেন মোহন সিং-এর নেতৃত্বে জাপানের হাতে বন্দি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাদের নিয়ে সিঙ্গাপুরের পতনের পরের দিন অর্থাৎ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের ফারার পার্ক-এ এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মেজর ইওয়াইচি ফুজিওয়ারা ফারার পার্ক-এর সমাবেশে ভারতীয় বন্দি সেনাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমরা আশা করি তোমরা আই. এন. এ.-তে যোগ দেবে। জাপানি সেনারা তোমাদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে নয়, বন্ধু বলে মনে করবে। আমরা তোমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেব এবং তোমাদের কাজে সর্বতোভাবে সহায়তা করব।”
(২) বন্দি সেনাদের উৎসাহ
ফুজিওয়ারা-র ঘোষণার পর ভারতীয় শ্রোতারা (সেনারা) উল্লাসিত হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে জাপানে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন। তিনিও ভারতে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার উদ্দেশ্যে জাপানের হাতে বন্দি ভারতীয়দের নিয়ে একটি সেনাবাহিনী গঠনে উৎসাহ দেন।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গঠন
জাপানি সেনা অফিসার ফুজিওয়ারা-র উদ্যোগে মোহন সিং-এর নেতৃত্বে বন্দিভারতীয় সৈন্যরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে রাজি হয়। এরপর মোহন সিং ফারার পার্ক-এ তাঁর বক্তৃতায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গঠনের কথা ঘোষণা করেন।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি
- (১) ক্যাপ্টেন মোহন সিং এবং প্রিতম সিং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সদস্যদের কাছে আবেদন জানান যে, মাতৃভূমির মুক্তির জন্য তাদের এই সুযোগ গ্রহণ করা উচিত। তাঁদের আবেগময় বক্তৃতা বন্দি ভারতীয় সেনাদের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। মোহন সিং এই বাহিনীতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবীদের যোগদানের আহ্বান জানান।
- (২) আগে ব্রিটিশ বাহিনীর প্রতি সেবাদানের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ যেসব সেনা জাপানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে যোগদানের বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে মোহন সিং বলেন, “ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্যের শপথ ভঙ্গ এবং ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য নতুন শপথ গ্রহণ হল একটি নৈতিক ও ধর্মীয় কাজ।” তাঁর প্রচেষ্টায় ২৫ হাজার ব্যক্তি এই সেনাদলে যোগ দেয়। এই সংখ্যা শীঘ্রই ৪০ হাজারে পৌঁছোয়।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বাহিনীর সুস্থিতি
জাপানে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি প্রতিষ্ঠার সময় মোহন সিং এই বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল নিযুক্ত হন। নী সুন ক্যাম্প-এ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়। মোহন সিং-এর নিজস্ব কার্যালয় স্থাপিত হয় মাউন্ট প্লিজ্যান্ট উপনগরীতে, ফুজিওয়ারা কিকন-এর প্রধান কার্যালয়ের কাছেই। এই বাহিনীর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী জাপানি সামরিক বাহিনীর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জাপানের পক্ষ থেকে এই বাহিনীর সেনাদের রেশন, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির আদর্শ
এই বাহিনী ঐক্য, আত্মবিশ্বাস ও আত্মোৎসর্গ – এই তিনটি আদর্শের ভিত্তিতে ভারতকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করার শপথ নেয়।
রাসবিহারী বসুকে সাহায্য দান
ব্রিটিশের অন্যতম প্রধান শত্রু রাসবিহারী বসু জাপানে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেন। তিনি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রবাসী স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের নিয়ে ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগ’ গঠন (১৯৪২ খ্রি. ১৫ জুন) করার ক্ষেত্রে জাপানের সাহায্য পান, এমনকি জাপানি সামরিক অফিসারদের সঙ্গে মত বিরোধে মোহন সিং বন্দি হয়ে নির্বাসিত হলে রাসবিহারী বসু ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
সুভাষচন্দ্র বসুকে সাহায্য দান
সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন জার্মানি থেকে জাপানে এসে পৌঁছোন। এরপর তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজোর কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাপানের সক্রিয় সাহায্যের আশ্বাস পান। সুভাষচন্দ্র বসু ইণ্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগের দায়িত্ব গ্রহণ করলে এবং ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ গঠন করলে জাপান-সহ ৯ টি রাষ্ট্র এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। প্রসঙ্গত জাপান আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দুটি তুলে দেয়।
আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান
জাপানের সহায়তায় ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের প্রথম থেকেই আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান বীরত্ব ও আত্মত্যাগের এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছিল। মণিপুরের ইম্ফল পর্যন্ত তাঁরা অগ্রসর হলেও শেষপর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্যাভাব এবং জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের (আত্মসমর্পণ ১৫ আগস্ট ১৯৪৫) পরিপ্রেক্ষিতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অভিযান ব্যর্থ হয়।
ফ্যাসিবাদী জাপান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের সামরিক শাসক তোজোর নেতৃত্বে বহুনিন্দিত ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত, হয়। এই যুদ্ধের সময় জাপান উগ্র সাম্রাজ্যবাদী অক্ষশক্তির সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তোলে। তা ছাড়া জাপান এই সময় নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে বার্মা, ইন্দোনেশিয়া-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থান দখল করে নেয়।
উপসংহার :- ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি কর্তৃক জাপানের সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাসী শক্তির সহায়তা গ্রহণের বিষয়টি খুবই বিতর্কিত, ফ্যাসিবাদী সরকারের কাছ থেকে এই সহায়তা গ্রহণের বিষয়টিকে অনেকেই সমর্থন করেন নি। সুভাষচন্দ্র বসু ফ্যাসিবাদী শক্তিকে কখনোই সমর্থন করেন নি। কিন্তু মনে রাখতে হবে সুভাষচন্দ্র আগে সাম্যবাদী রাশিয়ার সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। শুধুমাত্র মাতৃভূমির মুক্তির প্রয়োজনে তিনি নিরুপায় হয়ে ফ্যাসিবাদী শক্তির সহায়তা গ্রহণ করেছেন। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য এই পদক্ষেপকে তাই অনেকেই অন্যায় বলে মনে করেন না।
(FAQ) জাপানের সাথে আজাদ হিন্দ বাহিনীর যোগসূত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
জাপানে।
আজাদ হিন্দ ফৌজ।
জাপানে।
ক্যাপ্টেন মোহন সিং।
নী-সুন ক্যাম্পে।