আকবরের মেবার অভিযান

আকবরের মেবার অভিযান প্রসঙ্গে মেবারের বিশাল মর্যাদা, মেবার অভিযানের কারণ, চিতোর দুর্গ অবরোধ, উদয় সিংহের বন্দোবস্ত, প্রত্যহ সম্মুখ যুদ্ধ, মুঘল সেনাদের প্রয়াস, শেষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি, জহরব্রত, চিতোর দুর্গ দখল, আকবরের সমালোচনা, রাজপুতানার অন্য রাজ্যগুলির বশ্যতা স্বীকার, মেবার আক্রমণ ও হলদিঘাটের যুদ্ধ সম্পর্কে জানবো।

আকবরের মেবার অভিযান

ঐতিহাসিক ঘটনাআকবরের মেবার অভিযান
রাজাআকবর
সাম্রাজ্যমুঘল সাম্রাজ্য
রাজত্বকাল১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি
আকবরের মেবার অভিযান

ভূমিকা :- রাজপুতানার মেবার রাজ্য ছিল অন্যান্য রাজপুত রাজ্য থেকে ব্যতিক্রম। মেবারের শিশোদিয়া রাণাদের বংশ গরিমা যেমন ছিল, তেমন ছিল দুর্জয় স্বাধীনতা-স্পৃহা।

আকবরের আমলে মেবারের বিশাল মর্যাদা

মেবারের রাণা সংগ্রাম সিংহ বা রাণা সঙ্গ বাবর-এর গতিরোধ করে খানুয়ার যুদ্ধ-এ পরাজিত হন। তথাপি মেবারের মর্যাদা ছিল বিশাল।

আকবরের মেবার অভিযানের কারণ

  • (১) আকবর বুঝতে পারেন যে, মেবারকে বশ্যতায় না আনতে পারলে অন্য রাজপুত রাজ্যগুলি শীঘ্রই মেবারের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হবে। মেবারের রাণা উদয় সিংহ আকবরের কাছে বশ্যতা স্বীকারের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন।
  • (২) মেবারের রাজধানী চিতোরগড়ের অবস্থান এমন ছিল যে দিল্লীর থেকে গুজরাটের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগের পথ চিতোর নিয়ন্ত্রণ করত।
  • (৩) চিতোরের মত দুর্ভেদ্য দুর্গ বিরোধী শক্তির হাতে থাকা আকবর তাঁর সাম্রাজ্যের পক্ষে নিরাপদ বলে মনে করতেন না।
  • (৪) মধ্যযুগে ভারত-এর সামরিক মানচিত্রে চিতোর, রণথম্ভোর, গোয়ালিয়র ও কালিঞ্জরের দুর্গগুলির বিশেষ স্থান ছিল। এজন্য চিতোর দুর্গের ওপর আধিপত্য স্থাপনে আকবর ব্যস্ত হন।

আকবরের চিতোর দুর্গ অবরোধ

সম্রাট আকবর মেবার অভিযানের জন্য প্রস্তুতি সাঙ্গ করার পর ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে শীতকালে চিতোর দুর্গ অবরোধ করেন।

আকবরের আক্রমণের বিরুদ্ধে উদয় সিংহের বন্দোবস্ত

উদয় সিংহ দুর্গ রক্ষার জন্য উপযুক্ত বন্দোবস্ত করে, দুর্গ ছেড়ে নিকটবর্তী আরাবল্লী পাহাড়ে আশ্রয় নেন।

আকবর ও মেবার পক্ষে প্রত্যহ সম্মুখ যুদ্ধ

আকবর দীর্ঘকাল দুর্গ অবরোধ করলেও রাজপুতদের বিক্রমের সম্মুখে দুর্গ দখল করতে বিফল হন। উভয় পক্ষে প্রত্যহ সম্মুখ যুদ্ধে প্রচুর ক্ষতি হতে থাকে।

মেবার অভিযানে মুঘল সেনাদলের প্রয়াস

অবশেষে আকবর মাটির ভেতর গর্ত করে তাতে বারুদ দিয়ে আগুনের সাহায্যে দুর্গ প্রাচীরের একাংশ ভেঙে ফেলেন। ভাঙা অংশ দিয়ে মুঘল সেনা ঢোকার চেষ্টা করলে রাজপুতরা প্রবলবিক্রমে মুঘল সেনার উত্তাল ঢেউকে ফিরিয়ে দেয়।

শেষ যুদ্ধের জন্য মেবারের প্রস্তুত

দুর্গের অন্যতম সেনাপতি জয়মল আকবরের বন্দুক “সংগ্রামের” গুলিতে নিহত হন। জয়মলের মৃত্যুতে রাজপুতরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং দুর্গরক্ষা অসম্ভব দেখে শেষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়।

মেবারের রাজপুত রমণীদের জহরব্রত

দুর্গের রাজপুত রমনীরা জহরব্রত পালন করে জীবন্ত অবস্থায় আগুনে ঝাপ দেন। বীর রাজপুতরা মাথায় জাফরানী পাগড়ী বেঁধে মরণপণ সংগ্রামে পত্তা বা ফাতার নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আকবরের চিতোর দুর্গ দখল

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুঘল সেনা রাজপুত বাহিনীকে পরাস্ত করে। দুর্গ দখল করে আকবর পরদিন চিতোর দুর্গে ঢুকেন এবং ৩০ হাজার দুর্গবাসীকে হত্যা করেন।

আকবরের সমালোচনা

ভিনসেন্ট স্মিথ এই অকারণ নিষ্ঠুর হত্যার জন্য আকবরের তীব্র সমালোচনা করেছেন। আকবর সেনাপতি আসফ খাঁকে মেবারের শাসনভার দিয়ে আগ্রায় ফিরে আসেন।

আকবরের নিকট রাজপুতানার অন্য রাজ্যগুলির বশ্যতা স্বীকার

  • (১) মেবারের পরাজয়ের ফলে রাজপুতানার অবশিষ্ট রাজ্যগুলি মুঘলের বিরুদ্ধে বাধাদান নিরর্থক ভেবে বশ্যতা স্বীকার করে। ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে রণথম্ভোরের হারা বংশীয় শাসক সুজন সিংহ বশ্যতা জানান।
  • (২) ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে কালিঞ্জরের শাসক রামচন্দ্রও বশ্যতা স্বীকার করেন। ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে বিকানীর, জয়শলমীর বশ্যতা জানায়। মারবাড়ের অধিপতি চন্দ্রসেনও ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আকবরের প্রতি বশ্যতা জানান। সমগ্র রাজপুতানা আকবরের পদানত হয়।

আকবরের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী রাণা প্রতাপ সিংহ

চিতোরের পতন হলেও মেবার আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে নি। রাণা উদয় সিংহের মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র মহারানা প্রতাপ সিংহ পুনরায় মেবারের স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দেন।

মেবারকে মুক্ত করার প্রতিজ্ঞা

যদিও চিতোর দুর্গ তখনও তার অধিকারে ছিল না, যদিও তার সৈন্যসংখ্যা বেশী ছিল না; তবুও প্রতাপ সমগ্র মেবারকে মুঘলের হাত হতে মুক্ত করার জন্যে প্রতিজ্ঞা নেন।

মেবারকে বশ্যতা স্বীকারে আকবরের প্রস্তাব

প্রতাপকে উদার শর্তে বশ্যতা স্বীকারের জন্য আকবর প্রস্তাব পাঠালে প্রতাপ তা অগ্রাহ্য করেন। ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, “আকবর প্রতাপকে ধ্বংস করার সংকল্প নেন। কারণ প্রতাপের প্রধান অপরাধ ছিল তাঁর স্বদেশপ্রেম।”

আকবরের মেবার আক্রমণ

আকবর স্থির করেন যে, মেবারের যে অবশিষ্ট অংশ প্রতাপের হাতে আছে তা অধিকার করে তিনি প্রতাপকে নতজানু করবেন। সেনাপতি আসফ খাঁ ও মান সিংহ-এর নেতৃত্বে আকবর এক বিরাট বাহিনী মেবার আক্রমণের জন্যে পাঠান।

মোঘল বাহিনী ও রাজপুতদের মধ্যে হলদিঘাটের যুদ্ধ

১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১৮ই জুন হলদিঘাটের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করেও প্রতাপ পরাস্ত হন। তিনি হলদিঘাটের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছু হটে যান। তিনি পাহাড়ে, জঙ্গলে আত্মগোপন করে মুঘলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান।

আকবরের সময় রাণা প্রতাপের স্বাধীনতাপ্রিয়তা

১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর আগে বহু দুর্গ ও রাজ্যের বহু অংশ তিনি পুনরুদ্ধার করেন। আকবরও রাণা প্রতাপের স্বাধীনতাপ্রিয়তা ও আত্মসম্মানবোধকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তার বিরুদ্ধে আর কোনো বড় অভিযান পাঠান নি।

উপসংহার :- প্রতাপের মৃত্যুর পর তার পুত্র অমর সিংহ মেবারের সিংহাসনে বসলে আকবর মেবার জয়ের উদ্যোগ করেন। কিন্তু আকবর বাংলা অভিযান-এ ব্যাপৃত থাকায়, তার পক্ষে মেবার জয় সম্ভব হয় নি।

(FAQ) আকবরের মেবার অভিযান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আকবর প্রথমবার কখন মেবার অভিযান করেন?

১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে।

২. আকবরের প্রথম অভিযানের সময় মেবারের রাণা কে ছিলেন?

উদয় সিংহ।

৩. আকবর দ্বিতীয়বার কখন মেবার অভিযান করেন?

১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ।

৪. আকবরের দ্বিতীয় অভিযানের সময় মেবারের রাণা কে ছিলেন?

প্রতাপ সিংহ।

৫. হলদিঘাটের যুদ্ধ কখন হয়?

১৮ জুন, ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ।

Leave a Comment