আকবরের সাম্রাজ্যবাদ নীতির বৈশিষ্ট্য

আকবরের সাম্রাজ্যবাদ নীতির বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য, আকবরের সাম্রাজ্য নীতি সম্পর্কে বিভিন্ন মত, সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্খা, আকবরের সাম্রাজ্যবাদের উজ্জ্বল দিক ও আকবরের সাম্রাজ্য বিস্তার নগ্ন রাজ্য বিস্তার নয় বিষয়ে জানবো।

আকবরের সাম্রাজ্যবাদ নীতির বৈশিষ্ট্য

ঐতিহাসিক ঘটনাআকবরের সাম্রাজ্যবাদ নীতির বৈশিষ্ট্য
সম্রাটআকবর
পূর্বসূরিহুমায়ুন
উত্তরসূরিজাহাঙ্গীর
আকবরের সাম্রাজ্যবাদ নীতির বৈশিষ্ট্য

ভূমিকা :- মধ্যযুগের ভারতীয় শাসকদের মধ্যে সাম্রাজ্য-এর সংগঠক এবং বিজেতা হিসেবে মহামতি আকবর অনন্য স্থান অধিকার করেছেন। একমাত্র আলাউদ্দিন খলজি তার আগে এক বৃহৎ অঞ্চল জয় করেন।

আকবরের সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য

সম্রাট আকবরই সর্বপ্রথম উত্তর ও মধ্যভারত সম্পূর্ণভাবে তার অধীনে আনেন। দক্ষিণেও তিনি রাজ্য বিস্তার করেন। ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণে আসিরগড় দুর্গ জয় করার পর আকবর তার তরবারি কোষবন্ধ করেন। তিনি এক সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপন করে তাকে সুশাসিত করার ব্যবস্থা করেন।

আকবরের সাম্রাজ্য নীতি সম্পর্কে বিভিন্ন মত

আকবর সিংহাসনে বসার পর থেকেই রাজ্য বিস্তার নীতির সূচনা করেন।

  • (১) আকবরের রাজ্য বিস্তার নীতির প্রকৃতি সম্পর্কে বিভারিজ মন্তব্য করেছেন যে, “আকবর ছিলেন এক শক্তিশালী ও বলিষ্ঠ সাম্রাজ্যবাদী, যার সাম্রাজ্যবাদী সূর্যের জ্যোতির কাছে লর্ড ডালহৌসীর সাম্রাজ্যবাদী তারকা ম্লান হয়ে যায়।” (Akbar was a strong and stout annexationist before whose sun the modest star of Lord Dalhousie pales)।
  • (২) কিন্তু ফন নোয়ার নামে গবেষক বিভারিজের মন্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন যে, রাজ্য জয়ের নেশা আকবরকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করে নি। তিনি ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতি স্থাপন এবং পৈত্রিক রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য যুদ্ধ-বিবাহ করেন।
  • (৩) আকবরের সভাপণ্ডিত এবং প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল মনে করতেন যে, “স্বৈরাচারী রাজাদের স্বার্থপর, অনিয়ন্ত্রিত স্বৈরাচারে জর্জরিত জনসাধারণকে শান্তি ও সমৃদ্ধিদানের জন্য আকবর রাজ্য জয় নীতি অনুসরণ করেন।”

আকবরের মন্তব্য

সম্রাট আকবর নিজেই মন্তব্য করেছিলেন যে, “প্রতি রাজার কর্তব্য হল রাজ্য-বিস্তারের চেষ্টা করা; নতুবা প্রতিবেশী দেশগুলি আক্রমণ করবে; সেনাদলকে যুদ্ধে অভ্যস্ত রাখা দরকার; নতুবা সেনাদল আত্ম-গর্বিত হয়ে পড়বে।”

আকবরের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্খা

  • (১) আকবরের রাজ্য জয় নীতির পশ্চাতে শুধুমাত্র ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনের আগ্রহ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য কাজ করেছিল একথা মনে করা যায় না। তিনি তৈমুর বংশের ধারা অনুসারে রাজ্য জয় নীতিকেই প্রধানত তাঁর কর্তব্য কাজ বলে মনে করতেন।
  • (২) তিনি ছিলেন সুদক্ষ সেনাপতি, কূটনীতিবিদ ও রণপণ্ডিত। সুতরাং প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে তিনি একের পর এক গ্রাস করার নীতি নেন। এর পশ্চাতে তাঁর উচ্চাকাঙ্খা ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবই কাজ করেছিল।
  • (৩) ভারতের তৎকালীন পরিস্থিতিতে আকবরের মত এক প্রতিভাশালী সম্রাটের পক্ষে এই নীতি গ্রহণ ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না। সুতরাং প্রতিবেশী রাজ্য জয় ছিল Manifest destiny বা অবধারিত নিয়তি। এই দিক থেকে বিভারিজের মন্তব্য যথার্থ বলা যায়।

আকবরের সাম্রাজ্যবাদের উজ্জ্বল দিক

তবে রাজ্য জয়ের জন্যই আকবর রাজ্য জয় করেন নি। তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতির নানা উল্লেখযোগ্য দিক ছিল। যেমন –

  • (১) ডঃ এ. এল. শ্রীবাস্তবের মতে, তাঁর রাজত্বকালের দ্বিতীয় ভাগে আকবর জাতীয় নীতি, মানবতাবাদী নীতি গ্রহণ করে বহু সংস্কার প্রবর্তন করেন। এর ফলে তিনি জাতীয় সম্রাটে পরিণত হন।
  • (২) আকবর কোনো কোনো অঞ্চলে প্রত্যক্ষ শাসন স্থাপন করলেও রাজপুতানায় রাজপুত রাজাদের বশ্যতার বিনিময়ে স্বায়ত্ব শাসন দেন।
  • (৩) আকবর বিজিত অঞ্চলে তাঁর উন্নত শাসন, বিচার-ব্যবস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা স্থাপন করেন। অতীতে যে অরাজকতা ছিল তা তিনি দমন করেন।
  • (৪) সাম্রাজ্যে সর্বত্র একই প্রকার আইন ও প্রশাসন চালু হয়। রাস্তাঘাটের উন্নতির ফলে যোগাযোগ ও অর্ন্তবাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।
  • (৫) আকবর তাঁর ধর্মসহিষ্ণুতা বা সুলহ-ই-কুল নীতি দ্বারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্য ও সম্প্রীতি স্থাপন করেন। তিনি হিন্দু রাজপুতদের উচ্চতম পদে নিয়োগ করে তার সমদর্শিতার দৃষ্টান্ত রাখেন। বহু হিন্দু ফার্সী শিক্ষা করে মুঘল সরকারে চাকুরী পায়।

আকবরের সাম্রাজ্য বিস্তার নগ্ন রাজ্য বিস্তার নয়

আকবর ভারতীয় সংস্কৃতির বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। হ্যাভেলের (Havell) মতে, “আকবর ছিলেন ভারতীয়ের ভারতীয়” (Indian of Indians)। তিনি উর্দুভাষা, সাহিত্য, হিন্দুস্থানী সঙ্গীত, চিত্রকলা ও ইন্দো-পারসিক স্থাপত্যের অনুরাগী ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ভারতীয় সংস্কৃতির সমন্বয়বাদী চরিত্র বিশেষভাবে বিকশিত হয়। উপরোক্ত কারণে আকবরের সাম্রাজ্যবাদকে নগ্ন রাজ্য বিস্তার বলা চলে না।

উপসংহার :- আসলে আকবর ‘রক্ত ও লৌহ’ (Blood and Iron) নীতির দ্বারা রাজ্য বিস্তার করলেও উদার, জাতীয় নীতি, প্রশাসনিক সংস্কার, সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টার দ্বারা তাঁর সাম্রাজ্যে এক নবযুগের সৃষ্টি করেন।

(FAQ) আকবরের সাম্রাজ্যবাদ নীতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আকবর কোন নীতি দ্বারা রাজ্য বিস্তার করেন?

রক্ত ও লৌহ নীতি।

২. “আকবর ছিলেন ভারতীয়ের ভারতীয়”- কার উক্তি?

ঐতিহাসিক হ্যাভেল।

৩. সুল-ই-কুল নীতি প্রবর্তন করেন কে?

আকবর।

৪. আকবরের শেষ অভিযান কোথায় ছিল?

দক্ষিণের অসিরগড় দুর্গ জয়।

Leave a Comment