জাহাঙ্গীরের উপর নূরজাহানের প্রভাব প্রসঙ্গে নুরজাহানের গুণাবলী, নুরজাহানের সামর বিদ্যা, নুরজাহানের নমনীয়তা, দরবারে নূরজাহান চক্র গঠন, নুরজাহানের ক্ষমতা বিস্তার, দরবারে অশান্তি, খুররমের সঙ্গে বিবাদ, শাহরিয়ারকে সিংহাসন দানের চক্রান্ত, বেণী প্রসাদের অভিমত, ডক্টর ত্রিপাঠীর অভিমত, নুরুল হাসানের অভিমত ও নুরজাহানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে জানবো।
জাহাঙ্গীরের উপর নূরজাহানের প্রভাব
ঐতিহাসিক ঘটনা | জাহাঙ্গীরের উপর নূরজাহানের প্রভাব |
পাদশা বেগম | নূরজাহান |
পূর্ব নাম | মেহেরুন্নেসা |
পিতা | ইতিমাদ উদদৌলা |
ভ্রাতা | আসফ খান |
ভূমিকা :- ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে যখন সম্রাট জাহাঙ্গীর, নূরজাহান বেগমকে বিবাহ করেন তখন নূরজাহানের বয়স ছিল ৩০ বৎসর। কিন্তু এই পরিণত যৌবনেও তিনি ছিলেন অসামান্যা সুন্দরী।
নূরজাহানের গুণাবলী
- (১) তার বুদ্ধিমত্তা ও ব্যক্তিত্ব তার লাবণ্যকে মহিমান্বিত করেছিল। তার বুদ্ধিশক্তি ও উপলব্ধি ছিল প্রখর। যে কোনো জটিল রাজনৈতিক সমস্যাকে তিনি দ্রুত বুঝে নিতেন এবং দূরদৃষ্টি রেখে সিদ্ধান্ত নিতেন।
- (২) সাহিত্য, শিল্প ও সৌন্দর্যের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তিনি মুখে মুখে ফার্সী কবিতার চরণ তৈরি করে জাহাঙ্গীরের কথার উত্তর দিতেন। কাব্যপ্রাণ সম্রাট তার পত্নীর এই গুণে মুগ্ধ ছিলেন।
- (৩) নূরজাহান পোষাক, পরিচ্ছদ, অলঙ্কারের নতুন নতুন শৈলী (Style) আবিষ্কার করতেন। তার রেশমী জরিদার পোষাকের স্টাইল বিশেষ বিখ্যাত ছিল। মুঘল অভিজাতরা তাঁদের পরিবারের রমণীদের এই মহিষীর কাছে আদব-কায়দা ও সহবৎ শিক্ষা করতে পাঠাতেন।
নূরজাহানের সমরবিদ্যা
নূরজাহান কেবলমাত্র কলা ও কাব্য চর্চা করেন নি, প্রাচীন যুগের ‘আমাজন’-দের (Amazon) মত সমর বিদ্যার চর্চাও করেন। তিনি ভাল তীর ছুঁড়তে পারতেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে হাতির পিঠে বসে যুদ্ধ পরিচালনা লক্ষ্য করতেন। সম্রাটের সঙ্গে তিনি শিকারে যেতেন।
নূরজাহানের স্নেহপ্রবণতা
- (১) এই সাহসিকতার সঙ্গে কোমল গুণের সমাবেশ তাঁর চরিত্রকে মধুর করেছিল। তিনি দরিদ্র ব্যক্তিদের প্রতি সদয় ছিলেন। তার উপস্থিত বুদ্ধি ছিল অসাধারণ। শরণাপন্নকে তিনি রক্ষা করতেন। তিনি মুসলিম কন্যাদের বিবাহে অর্থ সাহায্য করতেন।
- (২) আত্মীয় পরিজনকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। সর্বোপরি জাহাঙ্গীরকে প্রেমে, সেবায় তিনি সর্বদা আচ্ছন্ন করেছিলেন। জাহাঙ্গীর তাঁর এই পত্নীর উষ্ণ, উগ্র, অধিকার যুক্ত নিখাদ ভালবাসায় বশীভূত হন।
জাহাঙ্গীরের উপর নূরজাহানের প্রভাব সম্পর্কে ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদের অভিমত
- (১) ডঃ ঈশ্বরীপ্রসাদ মন্তব্য করেছেন যে, “জাহাঙ্গীরের ওপর নূরজাহানের এই বিরাট প্রভাব রাষ্ট্রের পক্ষে মঙ্গলজনক হয় নি।” নুরজাহানের প্রভাবে জাহাঙ্গীর পুরোপুরি আমোদপ্রিয়, আরামপ্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হন (Thoroughbred pleasure seeker) এবং নিজ রাজপদের দায়িত্ব ভুলে যান।
- (২) জাহাঙ্গীর এক সময় মন্তব্য করেন যে, “রাষ্ট্রের দায়িত্ব বহনে নূরজাহান তাঁর বিজ্ঞতার জোরে পারদর্শিনী এবং তিনি নিজে এক বোতল মদ্য ও একখণ্ড মাংস পেলেই আনন্দিত থাকবেন। ইকবালনামার মতে, জাহাঙ্গীর রাজ কার্যকে ভার মনে করতে থাকেন এবং বলেন যে এসব দায়িত্ব এখন সাম্রাজ্ঞী বইবেন।
- (৩) যে জাহাঙ্গীর একদা তাঁর পিতার যোগ্য উত্তরাধিকারীর পরিচয় দেন, তাঁর এই আচরণ তার দুর্ভাগ্যজনক দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক। জাহাঙ্গীরের আমোদ-প্রবণতাকে নূরজাহান বিপজ্জনকভাবে বাড়িয়ে তাঁকে রাজকার্যে উদাসীন ও অবহেলা-পরায়ণ করেন।
- (৪) এই সুযোগে নূরজাহান সম্রাটের সকল ক্ষমতা হস্তগত করেন। এই ক্ষমতালোভী প্রভুত্বপরায়ণা বেগম (Masterful Begum) তার স্বামীকে আরাম ও প্রমোদের পিচ্ছিল ও ধ্বংসকর পথে ঠেলে দেন। ফলে জাহাঙ্গীর রাজদণ্ড ছেড়ে সুরাপাত্রকেই সার জ্ঞান করেন। তার স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙে পড়তে থাকে।
দরবারে নুরজাহান চক্র গঠন
- (১) নূরজাহান জাহাঙ্গীরকে হাতের পুতুলে পরিণত করেন। তিনি তাঁর পিতার পরিবারের লোকজনদের উচ্চ পদে নিয়োগ করে দরবারে ‘নূরজাহান চক্র‘ তৈরি করেন। ডঃ বেণীপ্রসাদের মতে, ১৬১১-২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নূরজাহান চক্রের ভেতর সাম্রাজ্ঞী, তার পিতা ও ভ্রাতা ছাড়া যুবরাজ খুররমও ছিলেন।
- (২) এই চক্রের সাহায্যে নূরজাহান তাঁর আত্মীয়দের দ্রুত উচ্চপদে বসিয়ে দেন। তিনি স্বজনপোষণের খারাপ দৃষ্টান্ত দেখান। মহাবৎ খানের মত যোগ্য মনসবদারেরা কোনো স্বীকৃতি পান নি। নূরজাহানের পিতা ইতিমাদ উদদৌলা ৭ হাজারী মনসবদার, ভ্রাতা আসফ খাঁ ৬ হাজারী মনসবদারের পদ পান।
- (৩) ডঃ আর. পি. ত্রিপাঠী অভিমত দিয়েছেন যে, নূরজাহানের পিতা বা ভ্রাতা নিজগুণে পদোন্নতি করেন। তাদের যথেষ্ট যোগ্যতা ছিল। তথাপি এত অল্পদিনের মধ্যে এরূপ উন্নতি নূরজাহানের আনুকূল্য ছাড়া সম্ভব হত না। তাছাড়া তাদের অপেক্ষা প্রবীণ ও যোগ্য অভিজাত মহাবৎ খাঁর পদোন্নতি হয় নি।
- (৪) সুতরাং পক্ষপাতহীনভাবে এই পদোন্নতির কাজ হয়েছিল মনে করা যায় না। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এই দাঁড়ায় যে, নূরজাহানের কৃপা না হলে দরবারের কোনো অভিজাতের মর্যাদা, পদ ও ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ থাকার সম্ভাবনা ছিল না। অন্তত সভাসদরা তাই মনে করতেন।
- (৫) নূরজাহান চক্রের প্রভাবে খান-ই-আজমকে বন্দী করা হয়। যুবরাজ খুররমকে নূরজাহানের ভ্রাতুষ্পুত্রী মমতাজমহলের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়। খুররমের ভ্রাতা পারভেজকে দমিয়ে রাখা হয়, যাতে তিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী না হতে পারেন। দরবারে নূরজাহান চক্র এবং বিরোধী গোষ্ঠী এই দুভাগে অভিজাতরা ভাগ হয়ে যান।
নূরজাহানের ক্ষমতা বিস্তার
- (১) ইকবালনামার মতে, সাম্রাজ্ঞী নূরজাহান ক্রমে পাদশাহের অধিকারগুলি নিজ হাতে একে একে নিতে থাকেন। সম্রাটের পরিবর্তে তিনিই ঝরোখা দর্শন দিতে থাকেন। জাহাঙ্গীরের কোনো কোনো মুদ্রায় তাঁর সঙ্গে বেগমের প্রতিকৃতি খোদাই করা হয়।
- (২) দরবারে কোনো গুরুতর সিদ্ধান্ত তাকে না জানিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি কোনো দক্ষ, স্বাধীন চেতা অভিজাত কর্মচারী বা সেনাপতিকে সহ্য করতে পারতেন না। তিনি এঁদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক আচরণ করতেন।
মোঘল দরবারে অশান্তি
- (১) এর ফলে দরবারে শান্তি, সংহতি ও আনুগত্যে ভাঙন ধরে। দরবারে এক শ্রেণীর অভিজাতরা নূরজাহানের প্রতি আনুগত্য দেখালেও বাকিরা এজন্য বিরক্তি বোধ করেন। দরবারে অভিজাতরা একদিকে নূরজাহান চক্র অপরদিকে নূরজাহান বিরোধী চক্রে ভাগ হয়ে যান।
- (২) নূরজাহান চক্রের সমর্থনে একথা বলা হয় যে, এই চক্র যতদিন কার্যকরী ছিল ততদিন নূরজাহানের একক স্বৈরতন্ত্র স্থাপিত হয় নি। নূরজাহানকে চক্রের সদস্যদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নিতে হত। সম্রাট জাহাঙ্গীরের মনোভাব ও মূলনীতি বুঝে এই চক্র কাজ করত।
খুররমের সঙ্গে নূরজাহানের বিবাদ
- (১) ১৬২০ খ্রিস্টাব্দের পর নূরজাহান বুঝতে পারেন যে, তাঁর স্বামীর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে। যদি স্বামীর মৃত্যু হয় তাহলে তার ক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। একথা ভেবে তিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ খুররমকে নিজ গোষ্ঠীর ভেতর আনতে চেষ্টা করেন।
- (২) তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী আর্জুমান্দ বানু বেগম বা মমতাজমহলের সঙ্গে খুররমের বিবাহ দেন। মমতাজ ছিলেন নূরজাহানের ভ্রাতা আসফ খাঁর কন্যা। কিন্তু খুররম তাঁর বিমাতার ক্রীড়নক হতে রাজী ছিলেন না। খুররমও ছিলেন তার বিমাতার মতই উচ্চাকাঙ্খী।
- (৩) নূরজাহানের ভ্রাতুষ্পুত্রী মমতাজ মহলও তাঁর স্বামী যুবরাজ খুররমের পক্ষ নেন। এজন্য বেগম নূরজাহান যুবরাজ খুররমকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
নূরজাহান কর্তৃক শাহরিয়ারকে সিংহাসন দানের চক্রান্ত
- (১) জাহাঙ্গীরের অপর পুত্র শাহরিয়ারের সঙ্গে নূরজাহান, তাঁর প্রথম পক্ষের কন্যা লাডলী বেগমের বিবাহ দেন। তিনি সম্রাটের কাছে খুররম (পরবর্তীতে শাহজাহান)সম্পর্কে বিষোদগার করে, সম্রাটের মন শাহরিয়ারের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
- (২) ঢোলপুরের জায়গীর যা খুররমেরই প্রাপ্য ছিল, তা নূরজাহানের পরামর্শে শাহরিয়ারকে দেওয়া হয়। জাহাঙ্গীর অবশ্য জানতেন যে, খুররমই তার জীবিত পুত্রদের মধ্যে উপযুক্ত। সুতরাং জাহাঙ্গীরের মনের ভাব বুঝতে পেরে নূরজাহান, খুররমকে দরবার থেকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করেন।
- (৩) তিনি মনে করেন যে, খুররমকে চোখে না দেখলে তাঁর প্রতি সম্রাটের স্নেহ ক্ষয় পাবে। সুতরাং খুররমকে কান্দাহারে পারসিক আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য কান্দাহার যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়। খুররম তাঁর বিমাতার চক্রান্তে দরবার হতে নির্বাসিত হতে অস্বীকার করেন। এবং কান্দাহার যাত্রায় অনিচ্ছা দেখান।
- (৪) এজন্য জাহাঙ্গীর অসন্তুষ্ট হন এবং তার পদমর্যাদা কমাবার আদেশ দিলে, খুররম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি দাক্ষিণাত্যে চলে যান। স্যার যদুনাথ সরকার-এর মতে, ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে নূরজাহানের চক্রান্তে খুররম তার প্রাপ্য পদ ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী হন।
জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মহাবত খাঁর বিদ্রোহ
- (১) নূরজাহান দরবারের অনুগত ও স্বাধীনচিত্ত অভিজাতদের প্রতি স্বেচ্ছাচারী ও অপমানজনক ব্যবহার করতেন। খুররম বা শাহজাহানের বিদ্রোহ দমনে সেনাপতি মহাবত খাঁ নিয়োজিত হলে তিনি তাঁকে বাংলা ও দক্ষিণে পরাস্ত করেন। এজন্য মহাবত খাঁর জনপ্রিয়তা ও মর্যাদা বাড়ে।
- (২) কিন্তু নূরজাহান এতে মহাবত খাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে বাংলা অভিযানের খরচের হিসেবপত্র ও মহাবত খাঁর সংগ্রহ করা হাতিগুলি ফেরত দিতে নির্দেশ দেন। মহাবত খাঁ কেন সম্রাটের বিনা অনুমতিতে তাঁর কন্যার সঙ্গে বারমুরদার নামে জনৈক অভিজাত পুত্রের বিবাহ দেন তাঁর কৈফিয়ৎ দাবী করা হয়।
- (৩) এই অপমানের ফলে মহাবত খাঁ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং সম্রাটকে কিছুকাল বন্দী করেন। তিনি শেষ পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যে খুররমের সঙ্গে যোগ দেন। এদিকে খুররমের ও মহাবত খাঁর বিদ্রোহের ফলে কান্দাহার পারসিত অধিকারে চলে যায়।
মোঘল দরবারে গোষ্ঠীতন্ত্র স্থাপন
- (১) নূরজাহান দরবারে দল ও গোষ্ঠী তৈরি করে শাসনব্যবস্থায় ঐক্য ও সংহতি নষ্ট করেন। জাহাঙ্গীর তাঁর রাজত্বের গোড়ায় যে ন্যায় বিচার ব্যবস্থা ও সমন্বয় নীতি প্রচলন করেন তা ব্যাহত হয়। জাহাঙ্গীরের ভাল আইনগুলি আর কার্যকর ছিল না।
- (২) সম্রাট নিজেই রাজকার্য থেকে সরে যান। রাজ্য বিস্তারের যে উজ্জ্বল যুগের ধারা আকবরের যুগ হতে জাহাঙ্গীরের রাজত্বের গোড়ার দিক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল তা গতিরুদ্ধ হয়।
- (৩) আগ্ৰার দরবার সন্ত্রাস, গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব ও তোষণকারীদের লীলাভূমিতে পরিণত হয়। স্বাধীনচিত্ত, যুক্তিবান, সৎ, যোগ্য প্রশাসকরা নিষ্ক্রিয়তা ও অবহেলায় মুখ লুকিয়ে ফেলেন।
জাহাঙ্গীরের উপর নূরজাহানের প্রভাব সম্পর্কে ডাঃ বেশী প্রসাদের অভিমত
- (১) ডাঃ বেণীপ্রসাদ তাঁর হিস্ট্রি অফ জাহাঙ্গীর গ্রন্থে বলেছেন যে, ১৬১১-১৬২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নূরজাহানের প্রভাব তত প্রখর ছিল না। এই সময় নূরজাহানের মাতা আসমত বেগম জীবিত ছিলেন। তিনি তার উচ্চাকাক্ষিনী কন্যাকে অনেকটা সংযত রাখতেন।
- (২) এই সময় খুররমের সঙ্গে বেগমের সম্পর্ক ভাল ছিল। জাহাঙ্গীরের স্বাস্থ্য তখন বেশী খারাপ হয় নি। তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতেন। যেমন খুররমকে বাদ দিয়ে শাহরিয়ারকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করতে তিনি রাজী হন নি।
- (৩) কিন্তু ১৬২২-১৬২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নূরজাহানের পিতা ও মাতা দেহত্যাগ করেন। বেগমকে নিয়ন্ত্রণ করার আর কেউ ছিলেন না। জাহাঙ্গীরের স্বাস্থ্যও এই সময় ভেঙে পড়ে, ফলে নূরজাহানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়।
জাহাঙ্গীরের উপর নূরজাহানের প্রভাব সম্পর্কে ডঃ ত্রিপাঠীর অভিমত
ডঃ আর. পি. ত্রিপাঠী বলেন যে, খুররম তাঁর বিমাতার প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ ছিলেন ও তাঁর প্রতি ভাল ব্যবহার করতেন না। এর থেকেই বিরোধের উৎপত্তি হয়। আসফ খাঁর প্ররোচনায় নুরজাহান, মহাবত খাঁকে অপদস্থ করেন। যাই হোক নূরজাহানের হস্তক্ষেপের ফল রাষ্ট্রের পক্ষে ক্ষতিকর হয় এতে সন্দেহ নেই।
জাহাঙ্গীরের উপর নূরজাহানের প্রভাব সম্পর্কে নূরুল হাসানের অভিমত
- (১) ডঃ নূরুল হাসান নুরজাহান চক্রের তত্ত্বকে নস্যাৎ করে বলেন যে, ফারসী গ্রন্থগুলিতে নূরজাহান চক্রের অস্তিত্বের উল্লেখ নেই। তারিখ-ই-জাহাঙ্গীর শাহীতেও নূরজাহানের অতিরিক্ত প্রভাবের কোনো কথা পাওয়া যায় না।
- (২) ইতিমাদউদ্দৌল্লা ও আসফ খান নিজ যোগ্যতার বলে উচ্চ মনসবদারের পদ পান, নূরজাহানের জন্য নয়। খান-ই-আলম প্রমুখ মনসবদারগণ নূরজাহান চক্রে যোগ না দিয়ে উচ্চ মনসব পান। এই থেকে প্রমাণিত হয় যে নূরজাহান চক্র বলতে কিছু ছিল না।
- (৩) এছাড়া খুররম যে দ্রুত উন্নতি লাভ করেন তা ছিল তার নিজের যোগ্যতার দ্বারা অর্জিত, নূরজাহান চক্রে যোগদানের জন্য নয়। পরে তাঁর ক্ষমতা অত্যন্ত বৃদ্ধি পেলে জাহাঙ্গীর তাঁর ক্ষমতা হ্রাসের জন্য শাহরিয়ারের প্রতি বেশী পক্ষপাত দেখান।
- (৪) যদি নূরজাহান পরে খুররমের বিরোধিতা করেন, তা তিনি তাঁর স্বামীর স্বার্থেই করেন। কারণ খুররমের উচ্চাকাক্ষা জাহাঙ্গীরের স্বার্থের ক্ষতিকারক ছিল।
নূরজাহানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ক্ষমতা-লাভ
যাই হোক নূরজাহান চক্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ না থাকলেও নূরজাহানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ক্ষমতা-লাভ সম্পর্কে প্রমাণ আছে। এর ফলে মুঘল অভিজাতদের মধ্যে একপক্ষ সম্ভবত সাম্রাজ্ঞীর সমর্থকে পরিণত হয়। এই বেগমের উচ্চাকাঙ্ক্ষা খুররমকে বিদ্রোহের পথে পরিচালিত করে।
উপসংহার :- দরবারে যদি পরস্পর বিরোধী চক্র গঠিত হয় তার মূল কারণ ছিল মনসবদারী ব্যবস্থা সঙ্কট। মনসবদারেরা সর্বদা উচ্চতর মনসব পদের জন্য লালায়িত ছিল। তারা নূরজাহানকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের চেষ্টা করে। জাহাঙ্গীর মনসবদারদের সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাবেন নি।
(FAQ) জাহাঙ্গীরের উপর নূরজাহানের প্রভাব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মেহেরুন্নেসা।
শের আফগান।
মমতাজ বেগম।
জাহাঙ্গীর পুত্র শাহরিয়ারের সঙ্গে।