জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে শাহজাহানের বিদ্রোহ

পিতা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে শাহজাহানের বিদ্রোহ প্রসঙ্গে বিদ্রোহের কারণ, নুরজাহানের দায়িত্ব, নুরজাহানের সঙ্গে বিরোধ, শাহজাহানের দায়িত্ব, শাহজাহানের পরাজয়, সম্রাটের ক্ষমা প্রদর্শন, নুরজাহানের উপলব্ধি ও শাহজাহানের নাসিকে গমণ সম্পর্কে জানবো।

পিতা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে শাহজাহানের বিদ্রোহ

ঐতিহাসিক ঘটনাশাহজাহানের বিদ্রোহ
প্রকৃত নামখুররম
পিতাজাহাঙ্গীর
পিতামহআকবর
পিতা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে শাহজাহানের বিদ্রোহ

ভূমিকা :- জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল যুবরাজ খুররম বা শাহজাহান-এর বিদ্রোহ। তৈমুর বংশে পিতার বিরুদ্ধে পুত্রের বিদ্রোহের বহু নজীর দেখা যায়। স্বয়ং জাহাঙ্গীর পিতা আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন।

শাহজাহানের বিদ্রোহের কারণ

জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে শাহজাহানের বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দুই প্রকার ব্যাখ্যা দেখা যায়। যেমন –

  • (১) ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ প্রমুখ মনে করেন যে, বেগম নুরজাহানের চক্রান্ত ও অন্যায় ব্যবহারের জন্যই শাহজাহান বিদ্রোহ করতে বাধ্য হন।
  • (২) ডঃ আর. পি. ত্রিপাঠি এই মত প্রকাশ করেছেন যে, “নুরজাহান দৃশ্যত শাহজাহানের অসন্তুষ্ট হওয়ার মত কিছু করেন নি। কিন্তু শাহজাহান সকল দোষ নুরজাহানের ওপর ন্যাস্ত করাই সুবিধাজনক মনে করেন… শাহজাহান রানীর প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ ছিলেন এবং তাঁর নিজ উচ্চাকাঙ্খা ছিল।”

নিরপেক্ষ বিচারে শাহজাহানের বিদ্রোহ দায়িত্ব

নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পশ্চাতে সাম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ও যুবরাজ খুররমের (শাহজাহানের) উচ্চাকাঙ্খার সঙ্ঘাত কাজ করেছিল বলা চলে।

শাহজাহানের বিদ্রোহয়ে নূরজাহানের দায়িত্ব

এই বিদ্রোহের জন্য নূরজাহানই বেশী দায়ী ছিলেন এতে সন্দেহ নেই। তিনিই আগ্রাসী নীতি নিয়ে যুবরাজ খুররমকে তাঁর প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চনার চেষ্টা করেন। খুররম ছিলেন দৃঢ় চরিত্রের লোক। তিনি বেগমের আধিপত্য সহ্য করতে চান নি এবং তার চক্রান্ত ব্যর্থ করার চেষ্টা করনে।

শাহজাহানের বিদ্রোহ সম্পর্কে ঈশ্বরী প্রসাদের অভিমত

ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ মন্তব্য করেছেন যে, “নুরজাহানের গোপন ষড়যন্ত্রগুলি শাহজাহানকে বিদ্রোহের পথে যেতে বাধ্য করে” (Nur Jahan’s backstar intrigues had driven Shahjahan into revolt)।

নূরজাহানের সঙ্গে শাহজাহানের বিরোধ

  • (১) নূরজাহান জাহাঙ্গীরের নাম করে দরবারে সকল ক্ষমতা করায়ত্ত করেন। দরবারে ‘নূরজাহান’ গোষ্ঠীই সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী হয়। জাহাঙ্গীরের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়লে দূরদর্শী নূরজাহান বুঝতে পারেন যে, খুররম তাঁর অবর্তমানে সিংহাসনে বসবেন।
  • (২) তিনি খুররমকে নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তাঁর ভ্রাতা আসফ খাঁর কন্যা মমতাজমহলের সঙ্গে খুররমের বিবাহ দেন। কিন্তু বেগম শীঘ্রই বুঝতে পারে যে, খুররম তার হাতের ক্রীড়নক থাকবেন না।
  • (৩) নূরজাহান জাহাঙ্গীরের অন্য পুত্র শাহরিয়ারের সঙ্গে তার প্রথম পক্ষের কন্যা লাডলী বেগমের বিবাহ দেন। মেরুদণ্ডহীন, দুর্বল শাহরিয়ার ছিলেন সম্রাজ্ঞীর আজ্ঞাবহ।
  • (৪) নূরজাহান শাহজাহানের বদলে শাহরিয়ারকে সম্রাটের উত্তরাধিকারী করার চক্রান্ত করেন। জাহাঙ্গীর এতে রাজী না হলে তিনি শাহজাহানকে দরবার থেকে দূরে সরিয়ে তাঁর প্রতি সম্রাটের দুর্বলতা দূর করার চেষ্টা করেন।
  • (৫) এজন্য শাহজাহানকে সদর কান্দাহারে নিয়োগ করা হয়। শাহজাহান এই দায়িত্ব নিতে রাজী না হলে, সম্রাজ্ঞী জাহাঙ্গীরকে বুঝান যে শাহজাহান কিরূপ স্বেচ্ছাচারী হয়েছেন। জাহাঙ্গীর এজন্য শাহজাহানকে শাস্তি দিলে তিনি বিদ্রোহ করেন।

জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে শাহজাহানের দায়িত্ব

  • (১) শাহজাহানের এই বিষয়ে কিছু দায়িত্ব ছিল। তিনি ঢোলপুরের জায়গীর প্রার্থনা করেন। কিন্তু নূরজাহানের প্রভাবে এই জায়গীর শাহরিয়ারকে দেওয়া হলে তিনি ক্রুদ্ধ হন। তিনি তার রক্ষীদল পাঠিয়ে ঢোলপুর থেকে শাহরিয়ারের লোকেদের বিতাড়িত করেন।
  • (২) এরপর জাহাঙ্গীর বিরক্ত হয়ে শাহজাহানের জন্য নির্দিষ্ট হিসার ফিরোজার জায়গীর বাজেয়াপ্ত করেন। কান্দাহারের মত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পারসিক আক্রমণ প্রতিরোধ করা শাহজাহানের উচিত ছিল। জাহাঙ্গীর তাঁর আত্মজীবনীতে এজন্য আক্ষেপ করেছেন।
  • (৩) অবহেলার ফলে কান্দাহার মুঘলের হাতছাড়া হয়। শাহজাহান এজন্য সকল দোষারোপ নূরজাহানের ওপর দিলেও, তাঁর দায়িত্ব স্খালন করা যায় না।
  • (৪) শাহজাহান যে জায়গীরগুলি চান তার সবগুলি তাকে দিলে তাঁর অপরিমেয় ক্ষমতা বাড়ত। তিনি দোয়াব ও পাঞ্জাবের জায়গীর ভোগ করতেন। তদুপরি ঢোলপুরের জায়গীর দিলে পশ্চিম ভারতে তার ক্ষমতা বাড়ত। নূরজাহান একাজ যুক্তিযুক্ত মনে করেন নি।
  • (৫) দরবারে শাহজাহানেরও সমর্থক গোষ্ঠী ছিল। তার শ্বশুর আসফ খাঁ প্রমুখ তার পক্ষে ছিলেন। সুতরাং তিনি একেবারেই দুর্বল ছিলেন না।

জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে শাহজাহানের পরাজয়

১৬২২ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহান বিদ্রোহ করার পর আগ্রা আক্রমণের চেষ্টা করলে সেনাপতি মহাবৎ খাঁ ও যুবরাজ পারভেজের বাহিনী তাকে বিলোচপুরের যুদ্ধে (১৬২৩ খ্রি) পরাস্ত করলে শাহজাহান দক্ষিণে পালান।

বাংলা-বিহারে শাহাজাহানের পলায়ন

দক্ষিণে মালিক অম্বর বা গোলকুণ্ডার সুলতান তাকে আশ্রয় দিতে রাজী না হওয়ায় এবং মুঘল বাহিনী তার পিছু নেওয়ায় তিনি উড়িষ্যা হয়ে বাংলা-বিহারে চলে আসেন। তিনি এই দুই প্রদেশে রাজস্ব আদায় করেন এবং উত্তরপ্রদেশে অযোধ্যা দখলের চেষ্টা চালান।

মালিক অম্বরের পক্ষ লাভে সমর্থ শাহাজাহান

মুঘল বাহিনীর আক্রমণে বিব্রত হয়ে তিনি পুনরায় দক্ষিণে চলে যান। এই সময় আহমদনগরের উজীর মালিক অম্বর তাঁর পক্ষ নেন।

জাহাঙ্গীরের নিকট শাহজাহানের ক্ষমা নিবেদন

সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে যুবরাজ পারভেজ ও মহাবৎ খাঁ পুনরায় শাহজাহানের বিরুদ্ধে দক্ষিণে অভিযান করেন। শাহজাহান বুরহানপুর অবরোধ করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারেন যে, সংখ্যাগুরু মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে বাধাদান নিষ্ফল। তিনি সম্রাটের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

নূরজাহানের উপলব্ধি

বুদ্ধিমতী নূরজাহান উপলব্ধি করেন ক্ষমতাশালী সেনাপতি মহাবৎ খাঁ ও যুবরাজ পারভেজ একজোটে শাহজাহানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে, নিজেরাই একটি ক্ষমতালোভী চক্র গড়ে তুলতে পারেন। এরূপ সম্ভাবনা দুর করতে হলে শাহজাহানের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করা দরকার। তাহলে মহাবৎ খাঁকে দরবারে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের ক্ষমা প্রদর্শন

১৬২৬ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহানকে সম্রাট ক্ষমা ভিক্ষা দেন।

শাহাজাহানের নাসিকে গমন

শাহজাহান রোটাস ও আসিরগড় দুর্গ ছেড়ে দেন। দশ লক্ষ টাকা নজরানা দেন। তাঁর বালক পুত্র দারা ও ঔরঙ্গজেবকে জামিন হিসেবে দরবারে পাঠিয়ে দেন। শাহজাহান তাঁর পত্নী মমতাজ ও পুত্র মুরাদ সহ মহারাষ্ট্রের নাসিকে চলে যান।

উপসংহার :- শাহজাহানের বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার কারণ ছিল যে, তার বিরুদ্ধে মহাবাৎ, পারভেজ প্রমুখ দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁর শ্বশুর আসফ খাঁ তাকে যথোচিত সাহায্য করেন নি। সম্রাটের সামরিক শক্তির সঙ্গে তিনি এঁটে উঠতে পারেন নি।

(FAQ) পিতা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে শাহজাহানের বিদ্রোহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আকবরের কোন পুত্র পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন?

সেলিম বা জাহাঙ্গীর।

২. পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময় শাহজাহানের পক্ষ নেয় কে?

মালিক অম্বর।

৩. শাহজাহানের স্ত্রীর নাম কি?

মমতাজ বেগম।

৪. শাহাজাহানের অবহেলার কারণে কোন স্থান মুঘলদের হাতছাড়া হয়ে যায়?

কান্দাহার।

Leave a Comment