বিশাখা

প্রাচীন ভারতের বিদুষী নারী বিশাখা প্রসঙ্গে বিশাখার জন্ম, বিশাখার পিতৃ পরিচয়, গৌতম বুদ্ধের সাথে বিশাখার প্রথম সংস্পর্শ, বিশাখার পিতা ধনঞ্জয়ের কোশল রাজ্য গমন, পঞ্চ কল্যানী কন্যার বৈশিষ্ট্য, পঞ্চকল্যাণী কন্যা বিশাখা, বিশাখার বিবাহ, বিশাখার প্রতি পিতা ধনঞ্জয়ের উপদেশ, বিশাখার পতিগৃহে যাত্রা, নির্গন্থ জ্ঞাতিপুত্র ও বিশাখার কাহিনী, বিশাখার শ্বশুরালয় ত্যাগের ভাবনা, গৌতম বুদ্ধের জন্য বিশাখার আয়োজন, গৌতম বুদ্ধ ও বিশাখার কথোপকথন, বিশাখার নিকট বৌদ্ধ সঙ্ঘের ঋণ, বিশাখার সন্তান-সন্ততি ও শক্তিশালিনী মহিলা বিশাখা সম্পর্কে জানবো।

ভারতের প্রাচীন যুগের বিদুষী নারী বিশাখা প্রসঙ্গে বিশাখার পিতৃ পরিচয়, বিশাখা ও গৌতম বুদ্ধের প্রথম সাক্ষাৎ, পঞ্চকল্যাণী কন্যা বিশাখা, গৌতম বুদ্ধের জন্য বিশাখার আয়োজন, শক্তিশালিনী মহিলা বিশাখা, গৌতম বুদ্ধ ও বিশাখার কথোপকথন সম্পর্কে জানব।

প্রাচীন ভারতের বিদুষী নারী বিশাখা

ঐতিহাসিক চরিত্রবিশাখা
জন্মস্থানঅঙ্গ রাজ্য
পিতাধনী শ্রেষ্ঠি ধনঞ্জয়
স্বামীপূর্ণবর্ধন
কর্মবৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের সেবা
প্রাচীন ভারতের বিদুষী নারী বিশাখা

ভূমিকা :- বৌদ্ধশাস্ত্র পাঠ করে আমরা যে সকল সতীসাধ্বী এবং দানশীল মহিলার পরিচয় পাই তাদের মধ্যে প্রাচীন ভারত-এ বিশাখাকে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠস্থান প্রদান করা যেতে পারে।

বিশাখার জন্ম

পিতামাতার দিক থেকে বিশাখা যেমন শ্রেষ্ঠ বংশে এবং অতুল ধনসম্পদের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর বিবাহও সেইরূপ অতি প্রসিদ্ধ শ্রেষ্ঠীর গৃহে হয়েছিল।

ভারতের বিদুষী নারী বিশাখার পিতৃপরিচয়

বিশাখার পিতামহ সেণ্ডক, পিতা ধনঞ্জয়, সকলেই বিপুল ধনশালী ছিলেন।

গৌতম বুদ্ধের সাথে বিশাখার প্রথম সংস্পর্শ

অঙ্গদেশের ভদ্রঙ্কর নামক স্থানে তাঁদের বাস ছিল। গৌতম বুদ্ধ যখন অঙ্গদেশে প্রথম ধর্মপ্রচার করতে গমন করেন, সে সময়ে বিশাখা সাত বছর বয়স্কা বালিকা মাত্র। কিন্তু এই বয়সেই বুদ্ধদেবের মধুর উপদেশাবলী তাঁর প্রাণের মধ্যে একটা প্রেরণা জাগিয়েছিল, বালিকার কোমল প্রাণে সেবাধর্মের উপকারিতা অনুভূত হয়েছিল।

বিশাখার পিতা ধনঞ্জয়ের কোশল রাজ্য গমন

  • (১) সেই সময়ে মগধ-এ অনেক ধনী ও প্রভাবশালী শ্রেষ্ঠী বাস করতেন। কোশল-এ মগধের ন্যায় ধনী ও প্রতিপত্তিশালী শ্রেষ্ঠীদের বাস ছিল না। এই জন্য নৃপতি প্রসেনজিৎ রাজা বিম্বিসারকে রাজগৃহ হতে একজন ধনী শ্রেষ্ঠীকে তাঁর রাজ্যে প্রেরণ করবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
  • (২) মগধের প্রথম শ্রেণীর শ্রেষ্ঠীরা কেউই কোশলে যেতে সম্মত হলেন না। ধনঞ্জয় দ্বিতীয় শ্রেণীর ধনী। বিম্বিসার তাঁকেই কোশলরাজ্যে প্রেরণ করলেন। ধনঞ্জয় কোশলে গমন করে সাকেতপুর নামক নগরে বাস করতে লাগলেন ।

পঞ্চকল্যাণী কন্যার বৈশিষ্ট্য

সেই সময়ে শ্রাবস্তী নগরীতে মৃগার নামক একজন ধনবান শ্রেষ্ঠী বাস করতেন। মৃগারের পুত্র পূর্ণবর্ধন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি পঞ্চকল্যাণী কন্যা না পেলে বিবাহ করবেন না। পঞ্চকল্যাণীর অর্থ এইরূপ –

  • (১) তার কেশদাম হবে ময়ূরপুচ্ছের ন্যায় সুচিক্কণ,
  • (২) অধরোষ্ঠ হবে পক্ব বিম্বফলের ন্যায় সুদর্শন,
  • (৩) তার দন্তসমূহ হবে মুক্তাফলের ন্যায় শুভ্র উজ্জ্বল, ঘনবিন্যস্ত, সমদীর্ঘ।
  • (৪) দেহের বর্ণ হবে সর্বত্র একরূপ,
  • (৫) আর বিংশতি সন্তানের জননী হলেও সে হবে স্থিরযৌবনা।

পঞ্চকল্যাণী কন্যা বিশাখা

মৃগার পুত্রের এইরূপ পণ অনুযায়ী পাত্রীর সন্ধান করতে করতে অবশেষে বিশাখাকে এই সমুদয় গুণবিশিষ্ট দেখতে পেয়ে তার সাথেই পুত্রের বিবাহ দেওয়া স্থির করলেন। এই সময়ে বিশাখার বয়স হয়েছিল মাত্র পনের বছর।

বিশাখার বিবাহ

  • (১) ধনঞ্জয় কন্যার বিবাহে বহু অর্থ ব্যয় করেছিলেন। স্বয়ং কোশল-নৃপতি পাত্রমিত্র ইত্যাদি সহ সৈন্যসামন্তগণে পরিবেষ্টিত হয়ে বিবাহসভায় উপস্থিত ছিলেন। সেই সময় বর্ষাকাল ছিল বলে শুষ্ক কাষ্ঠের অভাব হওয়ায় ধনঞ্জয় চন্দন কাষ্ঠ দ্বারা সমবেত অভ্যাগতদের খাদ্য দ্রব্যাদি রন্ধন করিয়ে পরিপাটিরূপে ভোজন করিয়েছিলেন।
  • (২) বিবাহের সময় ধনঞ্জয় কন্যাকে যে যৌতুক দিয়েছিলেন সে সকলের মধ্যে শিরোভূষণস্বরূপ একটি কৃত্রিম ময়ুর দিয়েছিলেন। এটি বিভিন্ন বর্ণের মণিমুক্তাদ্বারা এমনি সুকৌশলে নির্মিত হয়েছিল যে তাকে প্রকৃত ময়ূর বলে ভ্রম হত। বায়ু প্রবাহিত হলে উহার মুখ হতে কেকারব নির্গত হত। এইরূপ কলাকৌশল দেখে সকলেই আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন।

পতিগৃহে বিশাখার যাত্রা

ধনঞ্জয় কন্যাকে পতিগৃহে প্রেরণ করবার সময় কয়েকটি উপদেশ দিয়েছিলেন। সেই উপদেশ গুলি প্রহেলিকাময়ী ভাষায় বিবৃত হয়েছিল, সহজে বুঝতে পারার সাধ্য কারও ছিল না। বিশাখার শ্বশুর মৃগার অন্তরালে থেকে এই উপদেশ গুলি শুনতে পেয়েছিলেন, কিন্তু তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন নি।

বিশাখার প্রতি পিতা ধনঞ্জয়ের উপদেশ

পিতার উপদেশসমূহ বিশাখা তার জীবনে অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করেছিলেন। এগুলি হল –

  • (১) ঘরের আগুন বাইরে দিও না, অর্থাৎ গৃহের গুপ্তকথা অপরের নিকট প্রকাশ করো না।
  • (২) বাইরের আগুন ঘরে আনিও না, অর্থাৎ ভৃত্যগণ যে সমস্ত বিষয় আলোচনা করে সে সব কথা শ্বশুর প্রভৃতি গুরুজনের নিকট বলিও না।
  • (৩) যে দেয় তাকে দান করিও।
  • (৪) যে দেয় না তাকে দান করবে, অর্থাৎ নিঃস্ব আত্মীয় স্বজনকে দান করবে।
  • (৫) যে দেয় বা দেয় না তাকেও দান করবে; অর্থাৎ দরিদ্রদিগকে দান করবে।
  • (৬) সুখে উপবেশন করবে, অর্থাৎ উচ্চাসনে বসবে না, কারণ গুরুজন উপস্থিত হলে তা ত্যাগ করতে হবে।
  • (৭) সুখে আহার করবে, গুরুজন ও ভৃত্যাদির আহারান্তে নিজে নিশ্চিন্তমনে ভোজনে বসবে।
  • (৮) সুখে শয়ন করবে, অর্থাৎ গুরুজন নিদ্রিত হইলে নিজে শয়ন করিবে।
  • (৯ ) অগ্নির পূজা করবে, অর্থাৎ পতি, শ্বশুর প্রভৃতির পূজা করবে।
  • (১০) গৃহাগত দেবতাদের অর্চনা করবে, অর্থাৎ প্রব্রাজক ও অতিখি প্রভৃতিকে বিশেষ যত্নের সাথে অভ্যর্থনা এবং সেবা-যত্ন করবে।

নির্গন্থ জ্ঞাতিপুত্র ও বিশাখার কাহিনী

  • (১) বিশাখার শ্বশুর মৃগার নিগ্রন্থ জ্ঞাতিপুত্র নামক তীর্থিকের শিষ্য ছিলেন। বিবাহের পর মৃগার পুত্রবধূ বিশাখাকে নিয়ে গুরুদেবের পূজা করতে গমন করেছিলেন। বিশাখা দেখলেন তীৰ্থিক সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় উপবিষ্ট রয়েছেন। এতে তিনি অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ করলেন।
  • (২) নিগ্রন্থ তাঁর মনের ভাব বুঝতে পেরে মৃগারকে বললেন, “তুমি এই বধূকে তোমার গৃহ হতে বহিষ্কৃত করে দাও, এই বধূ অলক্ষণা। এ গৌতমের শিষ্যা। যদি একে বহিষ্কৃত করে না দাও, তাহলে তোমার সর্বনাশ হবে।” মৃগার গুরুদেবের কথায় ভীত হয়ে বললেন, “গুরুদেব, আমার পুত্রবধূ বালিকা মাত্র, তাকে ক্ষমা করবেন।”

বিশাখার শ্বশুরালয় ত্যাগ

  • (১) আর একটি ঘটনাতেও মৃগার পুত্রবধূর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। একদিন একজন অর্হৎ ভিক্ষার্থে মৃগারের বাড়ীতে উপস্থিত হলেন। বিশাখা অর্হৎকে বললেন “আপনি অন্যত্র ভিক্ষার্থে গমন করুন, এই বাড়ীর কর্তা ‘পুবাণ’ অর্থাৎ পর্যুষিত খাদ্য গ্রহণ করে থাকেন।
  • (২) মৃগার এই কথা শুনে বিশাখাকে দূর করে দেবার সঙ্কল্প করলেন। বিশাখা শ্বশুরের সঙ্কল্পের কথা জানতে পেরে দৃঢ়স্বরে বললেন, “আমি এ বাড়ীর ক্রীতদাসী নই যে, আপনি ইচ্ছা করলেই যে কোনো মুহূর্ত আমাকে দূর করে দিতে পারবেন। আমার রক্ষার্থ পিতা আটজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি দিয়েছেন, আপনি তাঁদেরকে আসতে বলুন।”
  • (৩) মৃগার তাঁদেরকে আহ্বান করে আনলেন। তখন বিশাখা সেই আটজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বললেন, “আমার শ্বশুর ‘পুবাণ’ খাইতেছেন, অর্থাৎ পূর্বজন্মার্জিত কর্মফল ভোগ করছেন। আপনারা আমাকে পিতৃগৃহে নিয়ে চলুন।”

মৃগার ও বিশাখার কথোপকথন

  • (১) একদিন রাত্রিকালে বিশাখা একটা আলো নিয়ে গৃহের বাইরে গিয়েছিলেন। মৃগার তা দেখতে পেয়ে বিশাখাকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। বিশাখা বললেন “একটি অশ্বী শাবক প্রসব করেছে, তা দেখতে গিয়েছিলাম।” তখন মৃগার বললেন “তোমার পিতা তোমাকে ঘরের আলো বাইরে নিয়ে যেতে নিষেধ করেছিলেন, তবে তুমি তা করলে কেন?
  • (২) বিশাখা বললেন “ আমার পিতা নিন্দা, কুংসা ইত্যাদি লক্ষ্য করেই ‘অগ্নি’ শব্দের প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁর উপদেশ অনুসরণ করে আমি কখনও ঘরের কথা বাইরে বলি না।” এইরূপ বলে বিশাখা শ্বশুরের নিকট একে একে পিতৃদত্ত সমুদয় উপদেশগুলির অর্থ প্রকাশ করে বললেন। এবার মৃগার নিজের ভ্রম বুঝতে পারলেন। বিশাখা বললেন, “তবে আমি এখন পিতৃগৃহে গমন করি।” মৃগার বললেন “মা, তুমি আমাকে আর লজ্জা দিও না। তুমি এই গৃহ পরিত্যাগ করে যেও না।”
  • (৩) বিশাখা বললেন, “আপনি তীর্থিকদের মতাবলম্বী, আমি ত্রিরত্নের উপাসিকা। আপনি যদি আমাকে ইচ্ছামত দান করতে এবং ধর্মোপদেশ শুনতে অনুমতি দেন তাহলে আমি আপনার গৃহে থাকব, নচেৎ নয়।” মৃগার তাতেই সম্মত হলেন, আর কোনো আপত্তি করিলেন না।

গৌতম বুদ্ধের জন্য বিশাখার আয়োজন

বুদ্ধদেব যখন শিষ্যগণ সমভিব্যাহারে কোশলের রাজধানী শ্রাবস্তী নগরে এসে পৌঁছালেন তখন বিশাখা ভিক্ষুদের অভ্যর্থনা করবার জন্য প্রচুর আয়োজন করলেন।

বুদ্ধদেব ও বিশাখার কথোপকথন

একদিন বিশাখার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে বুদ্ধদেব শিষ্যমণ্ডলী সহ মৃগারের গৃহে ভোজন করেছিলেন। তোজনান্তে বুদ্ধদেব যখন সুখোপবিষ্ট রয়েছেন, এমন সময়ে বিশাখা প্রনামান্তে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন,

বিশাখা: “ভগবান। আমার কয়েকটি প্রার্থনা আছে, শ্রবণ করুন।”

গৌতম বুদ্ধ: বুদ্ধদেব প্রশান্তোজ্জ্বল হাস্যে বললেন, “বৎসে! তোমার অভিলাষ জ্ঞাপন কর, তবে তোমার সমুদয় প্রার্থনা রক্ষিত হবে কি না বলতে পারি না।”

বিশাখা: বিশাখা বিনীত ভাবে বললেন, “আমার প্রার্থনা এই যে, আমি যতদিন জীবিত থাকব, ততদিন ভিক্ষুদেরকে বর্ষায় বস্ত্রদান করব। কোনো ভিক্ষু পীড়িত হলে আমি তাকে ঔষধ ও পথ্য প্রদান করব এবং তাঁদের অনুচরবর্গকে অন্নদান, ভিক্ষুদেরকে ভিক্ষান্ন বিতরণ, ভিক্ষুণীদেরকে বস্ত্রদান, এই সকল সৎপাত্রে দান করি এটাই আমার একান্ত ইচ্ছা।”

বুদ্ধদেব: “বিশাখা, তুমি তোমার অভিপ্রায় বেশ স্পষ্ট করে প্রকাশ কর।”

বিশাখা: “দেব! এখানে নানা দেশ হতে বহু ভিক্ষু এসে থাকেন, কিন্তু তাঁরা কেউই এখানকার পথঘাটের সাথে পরিচিত নন, তাঁদের ভিক্ষা সংগ্রহ করতে বিশেষ ক্লেশ হয়। আমার ইচ্ছা আমি তাঁদেরকে অন্নদান করি। তাহলে তাঁরা নিশ্চিন্ত মনে ধর্মাচরণ এবং নগর পরিভ্রমণে সমর্থ হবেন। কোনো পরিব্রাজক ভ্রমণ, ভ্রমণের সময় অন্ন সংগ্রহের চিন্তায় বিব্রত থাকলে তিনি হয়ত তাঁর দলের পশ্চাতে পড়ে থাকবেন। নতুবা তার গন্তব্য স্থানে পৌঁছাতে পারবেন না। তিনি যদি আমার অন্নসত্র হতে প্রস্তুত অন্ন ভোজন করতে পান তাহলে এইরূপ কষ্টভোগ হয় না। তিনি বিশ্রাম করতেও পারেন এবং ইচ্ছামত ভ্রমণ করবার সুযোগও তাঁর ঘটে। পরিব্রাজকদেরকে অন্নদান – এটাই আমার দ্বিতীয় ইচ্ছা।

বিশাখা: “প্রভো! আমার আর একটি নিবেদন এই যে, অনেক সময় এইরূপ ঘটে যে, অচিরাবতী নদীতে ভিক্ষুণীরা স্নান করতে নামেন, আর তাঁদের সঙ্গে বারাঙ্গনারাও একই সময় স্নান করতে আসে। এই নির্লজ্জা স্ত্রীরা ভিক্ষুণীদেরকে উপহাস করে বলে থাকে ‘তোমরা এই বয়সে ধর্মসাধনের জন্য এত কষ্ট করছ কেন ? যৌবন প্রমোদ-বিলাসের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত কর। শেষবয়সে ধর্ম করো, তাহলে ইহকাল এবং পরকাল দুই-ই রক্ষা হবে।’

বিশাখা: বারাঙ্গনাদের এইরূপ উপহাসে ভিক্ষুণীরা বড়ই লজ্জিতা হয়ে থাকেন, লজ্জা নারীর ভূষণ, বিবস্ত্র হয়ে নদীতে স্নান করতে নামা তাদের পক্ষে শোভন নয়, তাদের মানবস্ত্র যোগাতে পারি, এই আমার তৃতীয় ভিক্ষা

গৌতম বুদ্ধ: বুদ্ধদেব বিশাখার এইরূপ কল্যাণজনক লোকহিতকর প্রস্তাবের কথা শুনে বললেন, “বৎসে ! তোমার এই সকল সাধু ইচ্ছা পূর্ণ হোক ! আমি আশীর্বাদ করি ক্ষুধার্তকে অন্নদান, তৃষ্ণাতুরকে পানীয় দান, পরিশ্রান্ত জনে আসনদান, রোগীকে ঔষধপথ্য প্রদান – অশন বসন, ঔষধপথ্য যার যা চাই তা যথেচ্ছ দান করবার ক্ষমতা তোমার অক্ষয় হোক। পরের দুঃখ হরণ ও কুশল বর্ধন এই সকল পুণ্যকার্যে নিরন্তর রত থেকে স্বর্গে তোমার সুকৃতির ফল ভোগ করতে থাক।”

বিশাখার নিকট বৌদ্ধ সঙ্ঘের ঋণ

বুদ্ধদেবের এই আশীর্বাদ বাণী বিশাখা তার জীবনে সার্থক করে তুলেছিলেন। বিশাখার নিকট বৌদ্ধ সঙ্ঘের ঋণ বড় কম নয়। তিনি নগরের পূর্ব দিকস্থ একটি সুরম্য উদ্যান সঙ্ঘে উৎসর্গ করে তার নাম দিয়েছিলেন ‘পূর্বারাম।’

‘মৃগার মাতা’  বিশাখা

বিশাখা তাহার শ্বশুর মৃগারকে বুদ্ধদেবের নিকট নিয়ে গিয়েছিলেন। মৃগার বুদ্ধদেবের সুমধুর উপদেশাবলী শ্রবণ করে মুগ্ধ হয়ে বিশাখাকে বলেছিলেন, “মা, এতদিনে তুমি এই হতভাগ্য সন্তানের উদ্ধার সাধন করলে। এরপর বিশাখা ‘মৃগার মাতা’ নামে অভিহিতা হতে থাকেন।

সন্তান সন্ততির জননী বিশাখা

বিশাখার দশটি পুত্র ও দশটি কন্যা জন্মগ্রহণ করেছিল। এদের প্রত্যেকের আবার দশটি করে সন্তান জন্মেছিল। এই দুই শত পৌত্র-দৌহিত্রাদির আবার কুড়িটি করে সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এই সকল সন্তানেরা সকলেই সুস্থ, সবল, নীরোগ এবং চরিত্রবান ছিলেন।

শক্তিশালিনী মহিলা বিশাখা

বিশাখা এইরূপ শক্তিশালিনী মহিলা ছিলেন যে, তিনি মত্ত হস্তীকেও শুণ্ড ধরে নিশ্চল রাখতে পারতেন।

উপসংহার:- এই পুণ্যবতী মহিলা পরিণত বয়সে অতুল সুখসৌভাগ্যের অধিকারিণী হয়ে নির্বাণ লাভ করেন। বিশাখার নাম উজ্জ্বল হীরকের ন্যায় জ্যোতিঃমণ্ডিত হয়ে চিরকাল বৌদ্ধশাস্ত্র আলোকিত করবে।

(FAQ) প্রাচীন ভারতের বিদুষী নারী বিশাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বিশাখা কে ছিলেন?

অঙ্গদেশের এক ধনী শ্রেষ্ঠির কন্যা। তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের সেবা করতেন।

২. বিশাখার পিতা কে ছিলেন?

বিম্বিসারের রাজ্যের ধনী শ্রেষ্ঠি ধনঞ্জয়।

৩. বিশাখার বিবাহ হয় কার সাথে?

শ্রাবস্তী নগরের শ্রেষ্ঠি মৃগার পুত্র পূর্ণবর্ধনের সাথে।

৪. মৃগার মাতা কাকে বলা হয়?

বিশাখা কে।

Leave a Comment