মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে উজবেক বিদ্রোহ প্রসঙ্গে উজবেকদের ক্ষোভ, উজবেক বিদ্রোহের কারণ, বিহারে বিদ্রোহ, উজবেক নেতা, আব্দুল্লাহ খানের বিদ্রোহ, ইস্কিন্দার খানের বিরুদ্ধে অভিযান, উজবেকদের শোচনীয় পরাজয় ও উজবেকদের চরম শাস্তি প্রদান সম্পর্কে জানবো।
মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে উজবেক বিদ্রোহ
বিষয় | আকবরের আমলে উজবেক বিদ্রোহ |
সময়কাল | ১৫৬৪-১৫৬৭ খ্রি |
মুঘল বাদশা | আকবর |
উজবেক নেতা | জামান খান, ইস্কিন্দার খান |
অযোধ্যা উদ্ধার | টোডরমল |
ভূমিকা :- আকবরের বিজয় অভিযানের অগ্রগতি ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে উজবেক আমিরদের বিদ্রোহে দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়। উজবেক আমিররা আকবরের রাজদরবারে একটা দলে পরিণত হয়।
বাবরকে সমরখন্দ থেকে বিতাড়ন
উজবেকরা তৈমুর বংশীয়দের বংশগত শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। উজবেকরাই আকবরের পিতামহ বাবরকে সমরখন্দ থেকে বিতাড়িত করেছিল।
আনুগত্য অনিশ্চিত
এই উজবেক আমিররা তৈমুর বংশীয় আকবরের ভারত অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু তাদের আনুগত্য তৈমুর বংশের প্রতি খুবই অনিশ্চিত ছিল। জামান খান ও তার নিকটবর্তীরা সাইবানি খানের বংশধর বলে নিজেদের খুবই গর্বিত মনে করত।
উজবেকদের ক্ষোভ
আকবর পারস্যের আমিরদের রাজদরবারে উচ্চপদ দেওয়ায় উজবেক আমিররা অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হয়।
উজবেকদের বিদ্রোহের কারণ
- (১) Cambridge Shorter History of India গ্রন্থে উজবেকদের বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, রাজদরবারে শিয়া ও হিন্দুদের প্রাধান্য দেওয়ার ফলে আকবরের সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত আমির উজবেকরা বিদ্রোহ করে।
- (২) তবে উজবেক আমিররা নিজেদের স্বাধীন বলেই মনে করত। স্বাধীন মানসিকতা ও উচ্চাশার বশবর্তী হয়েই উজবেক আমিররা বিদ্রোহ করে।
বিহারে বিদ্রোহ
বৈরাম খানের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে বিহারে আফগান শক্তি আদিল শাহের পুত্রের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ দমন করা হয়।
উজবেকদের সাথে যোগাযোগ
একটা সময় উজবেক বিদ্রোহীরা আকবরের বৈমাত্র ভ্রাতা কাবুলের শাসক হাকিমের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। কিন্তু বুখারার বিখ্যাত উজবেক নেতা আবদুল্লা খানের সঙ্গে এই যোগাযোগ স্থাপন হয়েছিল কিনা, তার প্রমাণ নেই।
উজবেক নেতা
উজবেক উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আলি কুলি খান, জৌনপুরের শাসক জামান খান। জামান খানই প্রকৃতপক্ষে উজবেকদের নেতা ছিলেন। জামান খানের ভাই বাহাদুর খান এবং তাঁর কাকা ইব্রাহিম খান সারাহারপুরের শাসক ছিলেন। অউধ-এর জমিদার ইস্কিন্দার খান ও মালবের শাসক আবদুল্লা খান বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন।
জৌনপুরের আফগান বাহিনীর পরাজয়
১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে আকবর চুনার দুর্গ দখল করেন এবং খান জামান বশ্যতা স্বীকার করেন। এই বছরই খান জামান ও তাঁর ভাই বাহাদুর খান জৌনপুরের আফগান বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেছিলেন এবং চরম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছিলেন। আকবর অবশ্য এই নিষ্ঠুরতা অনুমোদন করেন নি।
আবদুল্লা খানের বিদ্রোহ
- (১) গক্কর বিদ্রোহ দমনের পর আকবর উজবেকদের বিদ্রোহ আশঙ্কা করেন। মালবের শাসক আবদুল্লা খানের কার্যে প্রথম বিদ্রোহের লক্ষণ দেখা যায়। ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে আকবর মারোয়াড়ের মধ্য দিয়ে মাণ্ডুতে আসেন এবং আবদুল্লা খান গুজরাটে পালিয়ে যান।
- (২) মাণ্ডুতে খান্দেশের শাসক মুবারক শাহের কন্যাকে আকবর বিবাহ করেন। সেই যুগের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মির্জা হায়দারের ভাইপো বাহাদুর খানকে মালবের শাসক নিযুক্ত করে আকবর ৯ অক্টোবর আগ্রায় ফিরে আসেন।
ইস্কিন্দার খানের বিরুদ্ধে অভিযান
- (১) আবদুল্লা খান ও জামান খানের বিশ্বাসভঙ্গতায় আকবর সমগ্র উজবেক জাতির প্রতি সন্দিগ্ধ হয়ে পড়েন। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে আকবর ইস্কিন্দার খানকে দরবারে আনার জন্য আসরফ খানকে প্রেরণ করেন। কিন্তু ইস্কিন্দার খান জৌনপুরে চলে যান।
- (২) ইস্কিন্দার সারহারপুর থেকে ইব্রাহিম খানকে সঙ্গে নিয়ে জামান খানের নেতৃত্বে তিনজনে একত্রে পরিকল্পিতভাবে কনৌজ অভিযান করেন এবং সীতাপুর জেলার নিমখার নামক স্থানে মুঘল বাহিনীকে পরাজিত করেন। জামান খান ও বাহাদুর খান মানিকপুর দখল করেন। আসরফ খান বাধা দিতে ব্যর্থ হন।
মুনিম খানকে প্রেরণ
- (১) আকবর তৎক্ষণাৎ আসরফ খানকে সাহায্যের জন্য মুনিম খানকে প্রেরণ করেন এবং স্বয়ং ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে আগ্রা থেকে যাত্রা করেন। আকবর কনৌজে মুনিম খানের সঙ্গে যোগ দেন।
- (২) সেখান থেকে তিনি লক্ষ্ণৌ অভিমুখে যাত্রা করলে ইস্কিন্দার খান লক্ষ্ণৌ ছেড়ে পালিয়ে যান। এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে জামান খান মানিকপুরের অধিকার ত্যাগ করে পূর্বদিকে পালিয়ে যান।
সুলেমান কররানির সাহায্য প্রার্থনা
জামান খান অপরাপর উজবেক নেতাদের সঙ্গে হাজিপুরে মিলিত হয়ে রোটাসের আফগানদের ও বঙ্গদেশের সুলতান সুলেমান কররানির সাহায্যের জন্য কথাবার্তা চালাতে থাকেন।
আকবরের অনুরোধ
এই পরিস্থিতিতে আকবর জৌনপুরে চলে যান এবং সেখান থেকে উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেবকে অনুরোধ করেন যদি সুলেমান কররানি বিদ্রোহীদের সাহায্য করে, তাহলে তিনি যেন এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে সুলেমানকে আক্রমণ করেন।
উজবেকদের শোচনীয় পরাজয়
আসরফ খানের দলের মধ্যে ভাঙন ধরলে, আকবরের অবস্থা জটিল হয়ে ওঠে। মুনিম খান ও জামান খানের মধ্যে এক আপস হয়। কিন্তু আপস সত্ত্বেও মির মুইজ-উল-মুল্ক এবং রাজা টোডরমল খইরাবাদের যুদ্ধে বাহাদুর খান ও ইস্কিন্দার খানকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন।
আলি কুলি খানের সেনাবাহিনী প্রেরণ
১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি আকবর জৌনপুর থেকে বারাণসীর নিকে অগ্রসর হন এবং পথিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি চুনার দুর্গ পরিদর্শন করেন। জৌনপুর ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে আলি কুলি খান গাজিপুর ও জৌনপুর দখল করার জন্য এক সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।
আলি কুলি খানের বিরুদ্ধে অভিযান
আকবর উজবেক নেতা আলি কুলিকে সমুচিত শাস্তি দেওয়ার জন্য জৌনপুরে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু আলি কুলি খান পার্বত্য অঞ্চলে পালিয়ে যান।
বাহাদুর খানের বারাণসী লুন্ঠন
বাহাদুর খান জৌনপুরের দিকে অগ্রসর হয়ে আসরফ খানকে পরাজিত করেন এবং তাঁর মাকে মুক্তি দেন ও বারাণসী লুণ্ঠন করেন।
জামান খানের ক্ষমা প্রার্থনা
আকবর তৎক্ষণাৎ জৌনপুরকে সদর দপ্তর হিসেবে ঘোষণা করেন এবং উজবেক বিদ্রোহের মূলোৎপাটনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। তখন জামান খান পুনরায় ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।
বিদ্রোহীদের ক্ষমা প্রদর্শন
দীর্ঘদিন বিদ্রোহ দমনের কাজে ব্যাপৃত থাকায় আকবর বিদ্রোহীদের ক্ষমা করে তাদের নিজ নিজ পদে পুনরায় বহাল করেন এবং ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ মার্চ আগ্রা অভিমুখে যাত্রা করেন।
উজবেকদের পুনরায় যুদ্ধ ঘোষণা
আপাতত উজবেক বিদ্রোহের ঝড় প্রশমিত হলেও ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় উজবেকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা কাবুলের শাসককে ভারত আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করে এবং জামান খান কাবুলের শাসকের নামে জৌনপুরে ‘খুতবা’ পাঠ করান।
শেরগড় দুর্গ অবরোধ
১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে যখন আকবর পাঞ্জাবে বৈমাত্রেয় ভ্রাতা মির্জা হাকিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, সেই সময় জামান খান কনৌজের নিকটবর্তী শেরগড় দুর্গ অবরোধ করেন।
ইস্কিন্দার ও ইব্রাহিম খানের অগ্ৰসর
উজবেক বিদ্রোহী বাহাদুর খান মানিকপুরে মুঘল সেনাপতি আসরফ খান ও মজনুন খানকে আক্রমণ করেন এবং ইস্কিন্দার খান ও ইব্রাহিম খান অযোধ্যা দখল করতে অগ্রসর হন।
উজবেকদের চরম শাস্তি প্রদান
- (১) আকবর পুনরায় ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে আগ্রা থেকে শেরগড়-এর দিকে যাত্রা করেন এবং রাজা টোডরমল, মুজফ্ফর খান, রাজা ভগবান দাস ও খাজা জাহান-এর নেতৃত্বে আকবর উজবেক বিদ্রোহীদের একে একে বিধ্বস্ত করেন।
- (২) উজবেকরা সামান্য বাধা দিতে সমর্থ হলেও, তারা যুদ্ধে পরাস্ত হয়। এই সময় উজবেকরা আকবরের উপস্থিতি ভাবতেই পারে নি। খান জামান নিহত হন এবং বাহাদুর খান ও অপরাপর নেতাদের প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। আকবর বিরক্ত হয়ে উজবেক বিদ্রোহীদের চরম শাস্তি প্রদান করেন।
আকবরের এলাহাবাদ ও বারাণসী অভিযান
এরপর আকবর এলাহাবাদ ও বারাণসী অভিযান করে জৌনপুরে যান এবং সেখানে মুনিম খানকে জামান খান ও অন্যান্য উজবেক বিদ্রোহীদের চরম শাস্তির কথা ব্যক্ত করেন।
সংকটময় পরিস্থিতির অবসান
ইত্যবসরে টোডরমল ইস্কিন্দার খানকে বিতাড়িত করে অযোধ্যা দখল করেন। ইস্কিন্দার খান গোরখপুরে আফগানদের কাছে পালিয়ে যান।
মির্জা গোষ্ঠীর বিদ্রোহ
- (১) উজবেক বিদ্রোহ দমন করে আকবর ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জুলাই আগ্রা প্রত্যাবর্তন করেন। এরপরও আকবরকে মির্জাগোষ্ঠীর কয়েকটি বিদ্রোহ দমন করতে হয়। এই গোষ্ঠী তৈমুর বংশীয় রাজপুত্রদের দ্বারা গঠিত ছিল এবং এদের নেতা ছিলেন মহম্মদ সুলতান মির্জা।
- (২) এই বিদ্রোহের মূল কেন্দ্র ছিল সম্বল ও মালব। পরে এই বিদ্রোহের কেন্দ্র গুজরাটে স্থানান্তরিত হয়। উজবেক বিদ্রোহ দমন করার পর আকবর পুনরায় ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১ আগস্ট মির্জাগোষ্ঠীর বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে আগ্রা ত্যাগ করেন।
- (৩) মালবে উপস্থিত হয়ে সিয়াবউদ্দিন খানকে মির্জাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উজ্জয়িনী প্রেরণ করেন। মির্জাগোষ্ঠীর বিদ্রোহীরা মান্ডুতে পালিয়ে যান এবং গুজরাটের নিরঙ্কুশ শাসক চেঙ্গিজ খানের আশ্রয় গ্রহণ করেন।
উপসংহার :- উজবেকদের দমন ও চরম শাস্তি প্রদানের ফলে উজবেক বিদ্রোহ আকবরের রাজত্বকালের প্রাথমিক পর্বে যে সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল তার অবসান ঘটে।
(FAQ) মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে উজবেক বিদ্রোহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে।
জামান খান, ইস্কিন্দার খান।
১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জুলাই।
টোডরমল।