আধুনিক ইতিহাস চর্চা হল অতীত ঘটনাকে নতুনভাবে উপলব্ধি করার পথ। ইতিহাস চর্চার আধুনিক পন্থা অবলম্বন করে বা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে আধুনিক ইতিহাস সম্পর্কে চর্চা করা হল।
আধুনিক ইতিহাস চর্চা ইতিহাসের ঘটনা গুলির প্রধান প্রধান ফলাফল ব্যাখ্যা করার প্রয়াসে সচেষ্ট হয়।মানব সভ্যতার ইতিহাসের ধারা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। তাই বর্তমানে আধুনিক ইতিহাস চর্চার বিষয় ও উপাদানের বৈচিত্র্যতা থেকেই ইতিহাস তথা আধুনিক ইতিহাসের বিভিন্ন দিক গুলি তুলে ধরা হল।
ইতিহাস মানুষের কাহিনি, মানুষের এগিয়ে চলার কাহিনি, মানুষের জয়যাত্রার কাহিনি। এই কাহিনির ব্যাখ্যা ও গবেষণা করেন ঐতিহাসিকেরা। তাদের এই কাজকে বলা হয় ইতিহাস চর্চা।
ইতিহাস বহমান, তাই নির্দিষ্ট স্থান ও কালের সীমানার মধ্যে ইতিহাসকে আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। আধুনিক ইতিহাস চর্চায় যেমন বিশ্বজনীন ইতিহাসের কথা উঠে এসেছে তেমনি আবার অনুন্নত জাতি গোষ্ঠি বা নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার উপরেও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
আধুনিক ইতিহাস (Adhunik Itihas) চর্চা কাকে বলে
কিছু ঘটনা যথাযথ অর্থে নতুন না হলেও বিশ্বকে উপলব্ধি করার নতুন পথ দেখায়। আধুনিকতার ধারণা এই সব ঘটনার সাধারণ অর্থ ব্যাখ্যা করে এবং আধুনিক ইতিহাস চর্চা সেগুলোর প্রধান প্রধান ফলাফলের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।
আধুনিক ইতিহাস যুগ
ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ ‘আধুনিক’ শব্দটির উদ্ভব হয়, যা বর্তমান বা সাম্প্রতিক সময়কে নির্দেশ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। ল্যাটিন ক্রিয়া-বিশেষণ Modo থেকে আধুনিক শব্দটি উদ্ভূত, যার অর্থ হল ‘এইমাত্র’। আধুনিক যুগ বা আধুনিকতা হল উত্তর-মধ্যযুগ, যা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, নগরায়ন, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং বিশ্বায়ন দ্বারা চিহ্নিত সময়ের একটি বিস্তৃত সময়কাল। এককথায় বিজ্ঞান, রাজনীতি, যুদ্ধবিগ্রহ, এবং প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য যে সকল উন্নয়ন হয় তার সময়কাল ছিল আধুনিক যুগ।
আধুনিক ইতিহাস (Adhunik Itihas) চর্চার বৈশিষ্ট্য
এই আধুনিক ইতিহাস চর্চার বিষয় ও উপাদানগত বৈচিত্র্যের মধ্যেই রয়েছে এর প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি।
- ১) আধুনিক ইতিহাস শুধু রাজকাহিনী নয়, তা হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষেরও ইতিহাস।
- ২) শুধুমাত্র যুদ্ধ-বিগ্রহ বা রাজ্যশাসন নয়, সমস্ত মানুষের জীবনধারণের প্রতিটি ক্ষেত্র (আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক) হয়েছে আধুনিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু।
- ৩) আধুনিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবে উঠে এসেছে নতুন নতুন সূত্র। পুরনো উপাদানগুলির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে ইচ্ছাপত্র, আত্মকথা, চিঠিপত্র, সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র, চিত্রকলা, ফটোগ্রাফি, ইন্টারনেট ইত্যাদি।
ইতিহাস তত্ত্ব
ইতিহাসবিদরা যে সমস্ত নিয়ম-নীতি, আদর্শ ও পদ্ধতি মেনে ইতিহাস রচনা করে থাকেন, তাকেই ইতিহাস তত্ত্ব বলা হয়।
আধুনিক ইতিহাস তত্ত্ব
অষ্টাদশ শতক থেকে শুরু করে বিংশ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত ইতিহাস চর্চাকে আধুনিক ইতিহাস তত্ত্ব বোঝায়।
আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য
এই ইতিহাস তত্ত্বের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
- (১) জাতীয়তাবাদ
- (২) যুক্তিবাদ
- (৩) প্রগতির ধারণা
- (৪) দৃষ্টবাদ
- (৫) অবয়ববাদ ও উত্তর অবয়ববাদ
- (৬) আধুনিকতা
- (৭) উত্তর আধুনিকতা
- (৮) আপেক্ষিকতাবাদ
- (৯) বিজ্ঞানধর্মিতা
- (১০) নৈতিকতাবাদ
আধুনিক ইতিহাস চর্চার প্রধান উপাদান
বর্তমানে ইতিহাসের গতিধারা দিক পরিবর্তন করেছে। তাই আধুনিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে উপাদানে বৈচিত্র্য এসেছে।
- (ক) প্রাথমিক উপাদান বা সূত্র
- (খ) গৌণ উপাদান
- (গ) অন্যান্য উপাদান
আধুনিক যুগের সময়কাল
বিশ্বের সর্বত্র একই সঙ্গে আধুনিক ইতিহাসের যুগ -এর সূচনা হয় নি। ইউরোপ -এর ইতিহাসে আধুনিক যুগের সময়কাল ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইউরোপে শুরু হয় উত্তর আধুনিক যুগ। ভারতের ইতিহাসে আধুনিক যুগের সূচনাকাল সম্পর্কে মতভেদ আছে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ থেকেই ভারত -এ আধুনিক যুগের সূচনা হয়। আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বা মহাবিদ্রোহ থেকে ভারতে শুরু হয় আধুনিক যুগ।
আধুনিকতার লক্ষণ
মানবিকতা, ব্যক্তিচেতনা, সমাজচেতনা, জাতীয়তাবোধ, রোমান্টিকতা, মৌলিকতা, মুক্তবুদ্ধি, নাগরিকতা প্রভৃতি আধুনিকতার বিশেষ লক্ষণ।
আধুনিক ইতিহাসের জনক
ইবনে খালদুন আধুনিক ইতিহাস চর্চার জনক নামে পরিচিত।
আধুনিক যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য
সমাজের প্রায় সকল ক্ষেত্রে মহান পরিবর্তনগুলিই ছিল আধুনিক যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
- (ক) বিশ্বায়ন
- (খ) রেনেসাঁস বা নবজাগরণ, মানবতাবাদ
- (গ) মার্কেন্টাইলিজম বা মার্কেনটাইলবাদ
- (ঘ) ভূগোল এবং রাজনীতি
- (ঙ) অর্থনীতি ও সমাজ
- (চ) ধর্ম
- (ছ) দর্শন ও চিন্তা
- (জ) শিল্প
- (ঝ) হিংসা
আধুনিক ইতিহাস চর্চার বৈচিত্র্য
মানবসভ্যতার ইতিহাসের ধারা বহমান। এই ধারা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। তাই আধুনিক ইতিহাস চর্চায় বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
- (ক) ধারণা বদল
- (খ) ক্ষেত্র বদল
- (গ) উপাদানের বৈচিত্র্য
আধুনিক ইতিহাস চর্চায় খেলার ইতিহাসের গুরুত্ব
খেলাধুলার ইতিহাস চর্চা মানব সমাজকে নানাভাবে প্রভাবিত করে আসছে। তাই সামাজিক ইতিহাস চর্চায় খেলাধুলার ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব তাৎপর্যপূর্ণ।
- (ক) জাতীয়তাবোধের সঞ্চার
- (খ) বর্ণবৈষম্য রোধ
- (গ) সামাজিক ঐক্য
- (ঘ) যৌথ উদ্যোগ
- (ঙ) সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তন
- (চ) জাতীয় আবেগ সৃষ্টিতে
- (ছ) নারী স্বাধীনতা
- (জ) পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি
- (ঝ) বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ববােধ
- (ঞ) খেলাধুলার ইতিহাস চর্চা
আধুনিক ইতিহাস চর্চায় দৃশ্য শিল্পের গুরুত্ব
দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস বলতে ছবি আঁকা এবং ফোটোগ্রাফিকে বোঝানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইতিহাসের লিখিত উপাদানগুলি বস্তুনিষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত হয় না। বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ উপাদান সরবরাহ করতে পারে একমাত্র আঁকা ছবি এবং ফোটোগ্রাফ। ছবি ও ফোটোগ্রাফি সাধারণভাবে রক্ষণশীলতা বা প্রগতিশীলতার পরোয়া করে না, যা ঘটছে তার দৃশ্যরূপ কোনোরকম অস্পষ্টতা ছাড়াই তুলে ধরে। এজন্য ইতিহাস চর্চায় দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
আধুনিক ইতিহাস চর্চায় ফটোগ্রাফির গুরুত্ব
মানুষের আঁকা ছবি এবং ফটোগ্রাফির ইতিহাস চর্চাকেই এককথায় দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস বলা হয়ে থাকে।আধুনিক ইতিহাস চর্চায় ফটোগ্রাফি এক আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।
আধুনিক ইতিহাস চর্চার সংবাদপত্রের গুরুত্ব কি
ইতিহাসের উপাদান রূপে সংবাদপত্রের বিভিন্ন ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন –
- (১) বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংবাদপত্রের মাধ্যমে পুরনো দিনের কোন ঘটনার কথা জানতে পারা যায় বা সেই ঘটনার নির্দিষ্ট সময় সম্পর্কেও জানা যায়।
- (২) সংবাদপত্রের মাধ্যমে পুরনো দিনের সমাজ সংস্কৃতি এবং সমাজ সংস্কারে বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকা সম্পর্কেও জানতে পারা যায়।।
আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি
এই আধুনিক কালের যথার্থ ইতিহাসে যে লেখন পদ্ধতি গড়ে উঠেছে তা সাম্প্রতিক বা আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি নামে পরিচিত। লিওপোল্ড ভন রাঙ্কে এই ইতিহাস চর্চার বিজ্ঞানসম্মত পথ দেখান। এই পথ অনুসরণ করে বিশ শতকে ব্ৰদেল, ই.এইচ.কার, ফিশার, লাদুরি, মার্কব্লক প্রমুখ ইতিহাসবিদ যথার্থ ইতিহাসের যে লিখন পদ্ধতি গড়ে তুলেছেন তা এই সময়ের ইতিহাস লিখন পদ্ধতি (নীতি) নামে পরিচিত।
আধুনিক কালের যথার্থ ইতিহাস লেখার জন্য সুংবদ্ধ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যেমন – উৎসের অনুসন্ধান, উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ, তথ্যের যাচাইকরণ, তথ্যের সংরক্ষণ, তথ্যের বিশ্লেষণ, ঘটনা ও বক্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন, ধারাবাহিকতা ও কালানুক্রম, ভৌগোলিক অবস্থানের উল্লেখ, কার্যকারণ পদ্ধতি ইত্যাদি অনুসরণ করতে হবে।
(FAQ) আধুনিক ইতিহাস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
নতুন ও সামাজিক ইতিহাসকে আধুনিক ইতিহাসের জননী বলা হয় ।
ইবনে খালদুন আধুনিক ইতিহাস চর্চার জনক নামে পরিচিত।
আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বের জনক হলে লিও পোল্ড ভন রাঙ্কে।