ইউরোপে নবজাগরণ নবজাগরণের সংজ্ঞা অর্থ ব্যাপক অর্থে নবজাগরণ নবজাগরণের স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্য হিসেবে দীর্ঘ বিবর্তনের ফলশ্রুতি যুক্তিবাদ প্রাচীন শিক্ষা-সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার নতুন জীবনদর্শন অনুসন্ধিৎসা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন বিজ্ঞানচর্চার প্রসার মানবতাবাদ ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বীকৃতি এবং ধর্মনিরপেক্ষ শিল্প সাহিত্য ও জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ সম্পর্কে জানবো।
নবজাগরণ
ঐতিহাসিক ঘটনা | নবজাগরণ |
অর্থ | পুনর্জন্ম |
সময়কাল | পঞ্চদশ শতক |
কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন | ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে |
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা | দ্বাদশ শতকে |
ভূমিকা:- মধ্যযুগে মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের কোনও সুযোগ ছিল না। মানুষের চিন্তা ও মানসিক বৃত্তি সম্পূর্ণভাবে গির্জার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। সেদিন মানুষের স্বাধীনভাবে চিন্তা করা বা মতপ্রকাশের কোনও স্বাধীনতা ছিল না।
মধ্যযুগে গির্জার প্রভাব
গির্জা, পোপ ও ধর্মযাজকদের আদেশই ছিল শিরোধার্য। মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা, জীবনধারা, শিল্প-সাহিত্য—সবই সেদিন গির্জা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হত।
নবজাগরণের সংজ্ঞা
দীর্ঘ দিনের জড়তার পর কালক্রমে এক বলিষ্ঠ ও স্বাধীন চিন্তাধারায় মানুষের অবলুপ্ত ব্যক্তিত্ব পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠল। এই পুনরুজ্জীবিত ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীন চিন্তাশক্তির বিকাশ রেনাসাঁস বা নবজাগরণ নামে পরিচিত।
নবজাগরণের অর্থ
‘রেনাসাঁস’ কথাটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল পুনর্জন্ম। নবজাগরণ বলতে সাধারণভাবে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবার অদম্য উৎসাহকে বোঝায়।
ব্যাপক অর্থে নবজাগরণ
ব্যাপক অর্থে রেনাসাঁস হল ব্যক্তিত্বের পুনর্জন্ম—এক নতুন, স্বাধীন, সাহসিকতাপূর্ণ, ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তিবাদী চেতনা ও অনুসন্ধিৎসার বিকাশ।
নবজাগরণের স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্য
ইউরোপ-এ রেনেসাঁ বা নবজাগরণের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য গুলি হল –
(ক) দীর্ঘ বিবর্তনের ফলশ্রুতি
- (১) নবজাগরণ কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। দীর্ঘ বিবর্তনের ফলে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে নবজাগরণ নিজ রূপ পরিগ্রহ করে। প্রাচীনকালে গ্রিস ও রোমকে কেন্দ্র করে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে এক বিরাট সভ্যতা গড়ে ওঠে। পঞ্চম শতকে বর্বর জার্মান উপজাতির আক্রমণে রোমান সাম্রাজ্য-এর পতন হলে এই সভ্যতাও বিলুপ্ত হয়।
- (২) কেবলমাত্র পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে কিছু পণ্ডিত নিজেদের মধ্যে গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন ও বিজ্ঞানচর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। ইউরোপের সাধারণ মানুষ তখন সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, ভার্জিল, লিভি প্রমুখ মনীষীদের কথা ভুলেই গিয়েছিল।
- (৩) এই অবস্থায় ক্রুসেড-এর পরবর্তীকালে আরবীয় সভ্যতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, বাণিজ্যের প্রসার, শহরের বিকাশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্তন ইউরোপের মানুষের চিন্তাধারাকে নতুন পথে প্রবাহিত করে।
- (৪) দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে গ্রিক ও আরবীয় দর্শনে পারদর্শী কৃতী পণ্ডিতগণ প্রচলিত বিশ্বাসকে অন্ধভাবে না মেনে একটি যুক্তিগ্রাহ্য মনোভাব গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। আর কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাস নয়—মানুষ সব কিছুর পিছনে যুক্তির অনুসন্ধান করতে থাকে। যুক্তির দ্বারা যা সমর্থিত নয় মানুষ তা বর্জন করে।
- (৫) দ্বাদশ শতক থেকে ইউরোপের নানা স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাইবেল এবং পোপ ও অন্যান্য সন্ন্যাসীদের ধর্মসংক্রান্ত রচনাবলী, অ্যারিস্টটলের তর্কশাস্ত্র ও দর্শন, আরবীয় চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত, জাস্টিনিয়ানের আইনগ্রস্থ প্রভৃতি পড়ানো হলে এই শিক্ষাধারা তরুণ মনে নবচেতনার সঞ্চার করে।
- (৬) এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু কৃতী ও উল্লেখযোগ্য শিক্ষক ছিলেন। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার এবেলার্ড (১০৭৯-১১৪২ খ্রিঃ) ছিলেন প্রবল যুক্তিবাদী। যুক্তির আলোকে বিচার না করে তিনি কোনও কিছুই গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না।
- (৭) ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের পতনের পূর্ব থেকেই গ্রিক ও রোমান সাহিত্যে সুপণ্ডিত ব্যক্তিগণ ইউরোপের নানা দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে শুরু করেন। এর ফলে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য ও সংস্কৃতি জনমনে প্রবল আগ্রহের সঞ্চার করে।
- (৮) ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের পতন হলে সেখানকার গ্রিক পণ্ডিতেরা তাঁদের জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে ইতালি ও ইউরোপের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েন। এর ফলে ইতালি ও ইউরোপে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতি সম্পর্কে অনুরাগ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
(খ) যুক্তিবাদ
- (১) মধ্যযুগে সব কিছুই ছিল ধর্মনির্ভর। গির্জা, পোপ ও ধর্মযাজকরাই ছিলেন মানব-জীবন, সমাজ ও সভ্যতার মূল নিয়ন্তা। তাঁদের আদেশ ছিল অভ্রান্ত ও অপরিবর্তনীয়। এর বিরুদ্ধে কোনও প্রশ্ন তোলা যেত না। গির্জা-বিরোধী যে কোনও বক্তব্য বা আচরণ ছিল ধর্মবিরোধী এবং ক্ষমার অযোগ্য।
- (২) এই যুগের মূল কথাই ছিলসব কিছু মেনে নাও, কিছু জানতে চেয় না।’ ক্রমে এই অন্ধবিশ্বাস ও আনুগত্যের স্থলে এলো যুক্তিবাদ। এই যুক্তিবাদই হল নবজাগরণের মূল বক্তব্য। যুক্তিহীন বা পরীক্ষিত সত্য নয় এমন কোনও কিছুই মানুষ আর গ্রহণ করতে রাজি হল না।
- (৩) দ্বাদশ শতক থেকে পণ্ডিতরা গির্জার নির্দেশকে অভ্রান্ত বলে না মেনে যুক্তির কাছে আশ্রয় গ্রহণের পরামর্শ দিতে থাকেন।
(গ) প্রাচীন শিক্ষা-সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার
- (১) মধ্যযুগে গ্রিক ও রোমান সাহিত্য ও দর্শন অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। যুক্তিবাদের স্থলে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার সমগ্র ইউরোপকে ছেয়ে ফেলে। গির্জার প্রভাবে মানুষ ইহলোক অপেক্ষা পরলোকের চিন্তায় ভীত হয়ে ওঠে।
- (৩) পঞ্চদশ শতকে অবলুপ্ত গ্রিক ও রোমান সাহিত্য ও দর্শনের প্রতি প্রবল আগ্রহই নবজাগরণের সূচনা করে। মানুষ বুঝতে পারে যে, প্রাচীন গ্রিস ও রোমের মানুষ স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করত। তারা যুক্তির দ্বারা সব কিছু বিচার করত।
- (৪) মধ্যযুগে প্রাকৃতিক জগৎ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কে কিছু চিন্তা করা ধর্মবিরুদ্ধ ছিল। নবজাগরণ প্রাকৃতিক জগৎ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈজ্ঞানিক সত্য সম্পর্কে মানুষকে শ্রদ্ধাশীল করে তোলে।
(ঘ) নতুন জীবনদর্শন
- (১) নবজাগরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মানবতাবাদ ( Humanism)। এখানে মানুষই প্রধান। মানুষ এবং জড় জগতই হল সব কিছুর কেন্দ্রে। এইভাবে নবজাগরণ মানুষের কাছে ব্যক্তি-স্বাধীনতা, মানবতাবাদ, মানবমুক্তি, ঐহিকতা ও যুক্তিবাদের বার্তা বহন করে আনে।
- (২) এর ফলে জীবন সম্পর্কে ধর্মনিরপেক্ষ পুরোনো গ্রিক মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত হয়। মানুষ তার মর্যাদা ফিরে পায়। গির্জা মানুষকে পরলোকে সুখভোগের স্বপ্ন দেখাত। নবজাগরণ কিন্তু মানুষকে ইহজগতে পার্থিব সুখভোগ ও আনন্দময় জীবনযাপনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে।
- (৩) পরলোক নিয়ে মানুষ আর চিন্তিত নয়। নানা প্রাকৃতিক ঘটনা বা দুর্দৈবকে মানুষ আর দেবতার কাজ বলে মানতে রাজি নয়। এগুলির পিছনে যুক্তিসম্মত বৈজ্ঞানিক কারণের অনুসন্ধান শুরু হয়।
(ঙ) অনুসন্ধিৎসা
নবজাগরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল অনুসন্ধিৎসা। মানুষের মধ্যে অজানাকে জানার আগ্রহ দেখা দেয়। লুপ্তপ্রায় গ্রন্থাদি ও চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে অদম্য আকাঙ্ক্ষা দেখা দেয়। এ থেকেই সাহিত্য, দর্শন, শিল্প, বিজ্ঞান ও ইতিহাস সম্পর্কে নতুন জ্ঞানলাভের চেষ্টা শুরু হয়। গির্জার অনুশাসন, অনাচার ও সামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা হয়। শুরু হয় ভৌগোলিক আবিষ্কারের প্রয়াস।
(চ) সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
মধ্যযুগে ধর্মের নিরঙ্কুশ প্রভাব থাকায় ধর্মভিত্তিক সাহিত্য রচিত হত। কিন্তু নবজাগরণের ফলে ধর্মভিত্তিক সাহিত্যের অবসান ঘটে। পুনরুত্থান ঘটে লৌকিক সাহিত্যের। আর ল্যাটিন ভাষার পরিবর্তে মাতৃভাষায় সাহিত্য রচিত হতে থাকে।
(ছ) বিজ্ঞানচর্চার প্রসার
নবজাগরণের আলােকে মানুষের যুক্তিবাদী মন বিজ্ঞান চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ঘটনার পিছনে যে বৈজ্ঞানিক সত্য লুকিয়ে আছে তা জানার জন্য মানুষ অধীর হয়ে ওঠে। ফলে বিজ্ঞান চর্চার প্রসার ঘটে ও বৈজ্ঞানিক আবিস্কার ঘটতে থাকে।
(জ) মানবতাবাদ
নবজাগরণের প্রভাবে ইউরােপে এক নতুন মানবকেন্দ্রিক মতবাদের উদ্ভব ঘটে, যা মানবতাবাদ নামে পরিচিত।এই মতবাদের অনুগামীরা পরকাল ও পাপপুণ্যের পরিবর্তে ইহজীবনে মানুষের পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব দেন।
(ঝ) ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বীকৃতি
নবজাগরণের যুগে পােপতন্ত্রের অবাধ কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। মানুষ তাদের হৃত মর্যাদা ও স্বাধীনতা ফিরে পায়।
(ঞ) ধর্মনিরপেক্ষ শিল্প, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ
নবজাগরণের যুগে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বন্ধনমুক্ত শিল্প, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটে। ফলে মানুষ ধর্মীয় উদারতা তথা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে।
উপসংহার:- এইভাবে নবজাগরণ মানুষের জীবনচর্যার ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। দুর্বিসহঃ অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগ থেকে উদ্ধার প্রাপ্তির জন্যই রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সূত্রপাত হয়।
(FAQ) নবজাগরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
পঞ্চদশ শতকে প্রথমে ইটালির ফ্লোরেন্সে ও পরে পশ্চিম ইউরােপে প্রাচীন গ্রিক ও রােমান শিক্ষা সংস্কৃতির পুনরায় চর্চার ফলে পশ্চিম ইউরােপে যে নতুন সাংস্কৃতিক বৌদ্ধিক পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল তা ইউরােপীয় নবজাগরণ বা রেনেসাঁস নামে পরিচিত।
ফরাসি শব্দ ‘Renaistre’ থেকে।
ঐতিহাসিক মিশেলে ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে।
নবজন্ম বা পুনর্জন্ম।
ইতালিতে।