পল্লব যুগে ধর্ম আন্দোলন

পল্লব যুগে ধর্ম আন্দোলন প্রসঙ্গে জৈন ধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, ভক্তি ধর্মের গুরুত্ব ও শঙ্করাচার্য সম্পর্কে জানবো।

পল্লব যুগে ধর্ম আন্দোলন

ঐতিহাসিক ঘটনাপল্লব যুগে ধর্ম আন্দোলন
বংশপল্লব বংশ
রাজধানীকাঞ্চী
প্রথম রাজাশিবস্কন্দ বর্মন
শ্রেষ্ঠ রাজাপ্রথম নরসিংহ বর্মন
শেষ রাজাঅপরাজিত বর্মন
পল্লব যুগে ধর্ম আন্দোলন

ভূমিকা :- অষ্টম শতকের বিরাট ধর্ম আন্দোলন, যা দক্ষিণ ভারতকে প্লাবিত করে তা পল্লব যুগেই শুরু হয়। উত্তর ভারতীয় আর্য বা বৈদিক সভ্যতা পল্লব শাসনে দক্ষিণে বিশেষ ভাবে ছড়ায়। পল্লব যুগে সমাজে ব্রাহ্মণ প্রাধান্য এবং ব্রাহ্মণদের ব্যাপক ভূমিদান এই কথা প্রমাণ করে।

পল্লব যুগে জৈন ধর্ম

ভারতের পল্লব যুগের গোড়ার দিকে জৈন ও বৌদ্ধরাই দক্ষিণের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতেন। কাঞ্চী ও মাদুরায় জৈন-ধর্মগুরু তাদের কেন্দ্র স্থাপন করেন। তামিল, প্রাকৃত ও সংস্কৃত ভাষায় তারা তাদের বাণী প্রচার করতেন। পদুকোট্টাই ও পার্বত্য অঞ্চলে জৈন ধর্ম -এর প্রভাব এখনও দেখা যায়।

পল্লব যুগে বৌদ্ধধর্ম

ভারতের পল্লব যুগে বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তাও ছিল। হিউয়েন সাঙ কাঞ্চীতে কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার দেখেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের প্রবল চাপে বৌদ্ধ ধর্ম জনপ্রিয়তা হারায়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে গুহাবাসী হন। রাজানুকুল্য হারিয়ে বৌদ্ধধর্ম ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের কাছে হঠে যায়।

পল্লব যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম

  • (১) পল্লব যুগ ছিল দক্ষিণে ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের অগ্রগতির যুগ। এই ধর্মকে আশ্রয় করে দক্ষিণে আর্য সভ্যতা প্রসারিত হয়। বহু হিন্দু দেব দেবী মন্দির পল্লব রাজারা তৈরি করেন। এই মন্দিরে সংস্কৃত শিক্ষার কেন্দ্রগুলিকে বলা হত ঘেটিকা। কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ বালকরাই ছাত্র হিসেবে যোগ দিতে পারত।
  • (২) এই মন্দির ও ঘেটিকার ব্যয় নির্বাহের জন্য পল্লব রাজারা ও সামন্তরা অগ্রহার ভূমিদান করতেন। ঘেটিকাগুলি বিদ্যাচর্চার সঙ্গে রাজনীতি চর্চার প্রধান কেন্দ্র ছিল। রাজার পক্ষে অথবা সময় সময় বিপক্ষে ঘেটিকা থেকে প্রচার চালিয়ে জনমত প্রভাবিত করা হত।
  • (৩) অষ্টম শতকে দক্ষিণে বহু হিন্দু মঠ স্থাপিত হয়। মঠগুলি ছিল পুজো, অর্চনা, বিতর্ক, শিক্ষাদান, দরিদ্রসেবা ও বিশ্রাম কেন্দ্র। কাঞ্চী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল দক্ষিণে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃত ভাষা প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু। হিন্দু ভারতের সাতটি শ্রেষ্ঠ শহরের অন্যতম ছিল কাঞ্চী।
  • (৪) পল্লব রাজারা বিষ্ণু ও শিবের উপাসক ছিলেন। তবে তাঁরা অন্য দেব-দেবীরও পুজো করতেন। পল্লব যুগে বৈষ্ণব ও শৈব ভক্তি সাহিত্যের বিশেষ বিকাশ হয়। তামিল ভাষায় অসাধারণ ভক্তি গীত রচিত হয়। এই গীতগুলিতে ভক্ত ও ভগবানের আধ্যাত্মিক মিলনের কথা বলা হয়।
  • (৫) শৈব নয়নারগণ তাদের ভক্তি গীতগুলি গান করতেন। অপ্পার, সম্বন্ধর, মাণিকা- বাসগার প্রমুখ ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে ভক্তিগীত রচনা করেন। অপ্পার ও নাস্কালভার ছিলেন বিখ্যাত বৈষ্ণব সাধক ও কবি। তামিল ভাষায় এদের ভক্তিগীতি আজও গাওয়া হয়।
  • (৬) এই সকল সাধকদের অনেকেই ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু। বৈষ্ণব ও শৈব ধর্মের প্রভাবে এঁরা সাধনার উচ্চ মার্গে যেতে পারেন। ভক্তিধর্ম সমাজের পতিত শ্রেণীর মধ্যে মুক্তির স্বাদ এনেছিল।

পল্লব যুগে ভক্তিধর্মের গুরুত্ব

রোমিলা থাপারের মতে, তামিল ভক্তিধর্ম ছিল আর্য ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া। যাগ-যজ্ঞ ও উচ্চবর্ণাশ্রিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে ভক্তিধর্মের জাগরণ ঘটে। এর ফলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে ভক্তি ধর্মের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। দক্ষিণের ভক্তি ধর্মের নারী সাধিকা, যাকে দক্ষিণের মীরাবাঈ বলা হয়, তিনি ছিলেন অন্ডাল।

পল্লব যুগে শঙ্করাচার্যের দর্শন তত্ত্ব

  • (১) এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত দার্শনিক ও ধর্মগুরু শঙ্করাচার্যের কথা উল্লেখ্য। বৈদিক দর্শনকে বিচার করে নৈয়ায়িক পণ্ডিতরা তাতে বহু অসঙ্গতি দেখান। শঙ্করাচার্য তার অদ্বৈতবাদী বেদান্ত দর্শন তত্ত্ব প্রচার দ্বারা এই অসঙ্গতি দূর করার চেষ্টা করেন এবং নিজ মতবাদকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।
  • (২) কিংবদন্তি অনুসারে তিনি তার বিরুদ্ধবাদীদের তর্কে পরাস্ত করে তাঁর মত গ্রহণে বাধ্য করেন, এবং বৌদ্ধ পণ্ডিতদের পরাস্ত করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেন। শঙ্কর এই জগৎ-সংসারকে মায়া বলে মনে করতেন। তাঁর কাছে একমাত্র ধ্রুবসত্য ছিলেন পরম ব্রহ্ম, যিনি এক, অভ্রান্ত, সর্বব্যাপ্ত।
  • (৩) শঙ্করের নামে প্রচারিত তাঁর দার্শনিক তত্ত্ব সম্বলিত অতি সুললিত ভাষায় সংস্কৃত স্ত্রোত্র আছে, যা পড়লে শঙ্করের অদ্বৈতবাদী দর্শনের মূল সূত্র ও মায়াবাদ বুঝা যায়। শঙ্কর ছিলেন জ্ঞানযোগের পূজারী। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জ্ঞানই হল মুক্তির প্রধান সোপান।
  • (৪) শঙ্কর বলেছেন যে, পৃথিবীতে সকল কিছুই অনিত্য, সকল কিছুই মায়া, একমাত্র ব্রহ্ম সত্য। একথা জেনেও আশ্চর্যের বিষয় যে, কেহ পরম ব্রহ্মে লীন হতে চায় না। তিনি ভোগবাদকে ত্যাগ করে, মায়া ত্যাগ করে জ্ঞান ও সন্ন্যাসের কথা বলেছেন।

উপসংহার :- পল্লব সংস্কৃতি কেবল গ্রামীণ ছিল না। কাঞ্চী ও মহাবলীপুরমকে কেন্দ্র করে পল্লবরা নাগরিক সংস্কৃতির বিকাশ করে। কাঞ্চী ছিল ভারতের একটি বিশিষ্ট নগরী; হর্ম্যমালা, মন্দির, ঘেটিকার দ্বারা সজ্জিত। মহাবলীপুরম ছিল বন্দর নগরী।

(FAQ) পল্লব যুগে ধর্ম আন্দোলন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. পল্লব বংশের প্রথম রাজা কে ছিলেন?

শিবস্কন্দ বর্মন।

২. পল্লব বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কে ছিলেন?

প্রথম নরসিংহ বর্মন।

৩. পল্লব বংশের শেষ স্বাধীন রাজা কে ছিলেন?

অপরাজিত বর্মন।

৪. পল্লব বংশের রাজধানী কোথায় ছিল?

কাঞ্চী।

৫. কোন পল্লব রাজা রাজসিংহ শৈলী তৈরি করেন?

দ্বিতীয় নরসিংহ বর্মন বা রাজসিংহ বর্মন।

Leave a Comment