বর্তমান ভারত

বর্তমান ভারত গ্ৰন্থের লেখক, প্রকাশকাল ও পত্রিকা, ভূমিকা রচনা, লেখার উদ্দেশ্য, গ্ৰন্থের মূল বিষয়, ভারতের মাটির প্রতি প্রেম, ভারতীয় নারীর আদর্শ, মানবতার সেবা, সংক্ষিপ্ত কাহিনী ও জাতীয়তাবাদের বিকাশে ভূমিকা সম্পর্কে জানবো।

স্বামী বিবেকানন্দ রচিত বর্তমান ভারত প্রসঙ্গে বর্তমান ভারত গ্ৰন্থের রচনাকাল, বর্তমান ভারত গ্ৰন্থের প্রকাশকাল, উদ্বোধন পত্রিকায় বর্তমান ভারত গ্ৰন্থের প্রথম প্রকাশ, বর্তমান ভারত গ্ৰন্থ রচনায় বিবেকানন্দের মুখ্য উদ্দেশ্য, বর্তমান ভারত গ্ৰন্থের মূল বিষয়, বর্তমান ভারত গ্ৰন্থে শূদ্র জাগরণের বর্ণনা, বর্তমান ভারত গ্ৰন্থের সংক্ষিপ্ত কাহিনী ও ভারতের জাতীয়তাবাদের বিকাশে বর্তমান ভারত গ্ৰন্থের অবদান।

বর্তমান ভারত গ্রন্থ

লেখকস্বামী বিবেকানন্দ
ভাষাবাংলা
বিষয়দর্শন
প্রকাশ১৮৯৯ (প্রবন্ধ), ১৯০৫ (বই)
বর্তমান ভারত

ভূমিকা :- যে কোনো দেশের পরাধীনতার গ্লানি মোচনে এবং জাতিকে আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে সাহিত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশ ভারতবর্ষও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল না। স্বামী বিবেকানন্দ রচিত ‘বর্তমান ভারত’ ছিল এমনই একটি গ্রন্থ, যা ‘জাতি’ হিসাবে ভারতীয়দের হীনমন্যতা কাটিয়ে তাদের প্রবলভাবে আত্মশক্তিতে উজ্জীবিত করে তোলে।

বিবেকানন্দের ভারত ভ্রমণ

১৮৯৭ সালে পাশ্চাত্য থেকে ফিরে আসার পর বিবেকানন্দ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ভ্রমণ করেন।

বিবেকানন্দের সম্পাদনায় উদ্বোধন পত্রিকা প্রকাশ

তিনি ১৮৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বাংলা মুখপত্র উদ্বোধন পত্রিকা চালু করেন।

পত্রিকার জন্য বিবেকানন্দের লেখা গ্রন্থ

এই উদ্বোধন পত্রিকার জন্য তিনি ভাববার কথা, বর্তমান ভারত, পরিব্রাজক এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য প্রবন্ধগুলি রচনা করেন।

বর্তমান ভারত গ্রন্থের প্রকাশ

এই প্রবন্ধটি রামকৃষ্ণ মিশন ও রামকৃষ্ণ মঠের একমাত্র বাংলা মুখপত্র উদ্বোধন পত্রিকার মার্চ ১৮৯৯ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ১৯০৫ সালে প্রবন্ধটি বই আকারে প্রকাশিত হয়।

বর্তমান ভারত গ্রন্থের অন্তর্ভুক্তি

পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা সংকলনের ষষ্ঠ খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হয় এই প্রবন্ধটি।

বর্তমান ভারত বইটির ভূমিকা রচনা

স্বামী সারদানন্দ এই বইয়ের ভূমিকা লিখে দেন।

বর্তমান ভারত প্রবন্ধটি রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য

স্বামী বিবেকানন্দের বর্তমান ভারত প্রবন্ধ রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সমসাময়িক ভারতের কথা বলা।

বর্তমান ভারত প্রবন্ধের মূল বিষয়

এই প্রবন্ধে বিবেকানন্দ ভারত -এর সম্পূর্ণ ইতিহাস আলোচনা ও ব্যাখ্যা করেছেন এবং শূদ্র অংশের অভ্যুত্থানের ভবিষ্যৎ ‌বাণী করেছেন। ভারতের দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষের জন্য তিনি এই প্রবন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।

বর্তমান ভারত গ্রন্থে ভারতবাসীকে ভাই সম্বোধন

এই প্রবন্ধেই তিনি ভারতবাসীকে বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে ভাই মনে করার আহ্বান জানান।

বর্তমান ভারত গ্রন্থে মর্যাদাপূর্ণ আচরণের নির্দেশ

এই প্রবন্ধে তিনি ভারতবাসীদের বলেন সকল ভারতবাসীর সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করতে এবং আর্থিক অসংগতির জন্য কাউকে হেয় না করতে।

ভারতীয় নারীর আদর্শ

বিবেকানন্দের মতে সীতা, সাবিত্রী ও দময়ন্তী হলেন ভারতীয় নারীর আদর্শ।

ভারতের মাটির প্রতি প্রেম

তিনি ভারতবাসীকে ভারতের মাটিকে স্বর্গ মনে করতে এবং ভারতের কল্যাণকে নিজের কল্যাণ ভাবতে বলেন এবং পাশ্চাত্যের অনুকরণ না করার কথা বলেন।

স্কুল ও কলেজের পাঠ্য বর্তমান ভারত

বর্তমান ভারত প্রবন্ধের শেষাংশটি এখন স্কুল কলেজের পাঠ্য।

বর্তমান ভারত গ্রন্থে ভারত সংস্কারের ইচ্ছা প্রকাশ

স্বামী জিতাত্মানন্দের মতে বিবেকানন্দ এই প্রবন্ধে ভারত সংস্কারের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

বর্তমান ভারত গ্রন্থে মানবতার সেবার উল্লেখ

টিচার ইন এমার্জিং ইন্ডিয়ান সোসাইটি বইয়ের লেখক শ্রীবাস্তব বলেছেন যে, এই প্রবন্ধে বিবেকানন্দ উল্লেখ করেন যে, আমাদের শিক্ষাব্যাবস্থার একটি উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মানবতার সেবা করা।

বর্তমান ভারত গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত কাহিনী

  • (১) স্বামী বিবেকানন্দ এই প্রবন্ধে সংক্ষেপে বৈদিক সভ্যতা -র পুরোহিত সমাজপতিদের যুগ থেকে ব্রিটিশ শাসন পর্যন্ত ভারতের সমগ্র ইতিহাসের স্মৃতিচারণা ও ব্যাখ্যা করেছেন।
  • (২) প্রথম দিকে বৈদিক ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা সমাজকে কিভাবে শাসন করতেন, তারপর কিভাবে ক্ষমতাশালী যোদ্ধারা সমাজের নেতৃস্থানে এলেন এবং কিভাবে বৈশ্যদের ক্ষমতা বাড়ল তা আলোচনা করেছেন।
  • (৩) শেষে লেখক বলেছেন যে, চক্রাকার পথে বৈশ্যের পর ভারতীয় সমাজ শূদ্রের অধীনে আসতে বাধ্য।

বর্তমান ভারত গ্রন্থে সমসাময়িক ভারতকে বিশ্লেষণ

বর্তমান ভারত গ্রন্থে বিবেকানন্দ সমসাময়িক ভারতকে বিশ্লেষণ করেছেন দশ হাজার বছর পুরনো ভারতের ইতিহাসের নিরিখে।

বর্তমান ভারত গ্রন্থে পুরোহিতের শাসনের উল্লেখ

উর্বর মস্তিষ্ক ও জ্ঞানে বলীয়ান পুরোহিতরা রাজশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করত। রাজারাও পুরোহিতদের খুশি করতেন। তখন বৈশ্য ও সাধারণ প্রজার বিশেষ গুরুত্ব ছিল না ।

বর্তমান ভারত গ্রন্থে ক্ষত্রিয় শাসনের উল্লেখ

বৌদ্ধযুগ থেকে মুঘল যুগ পর্যন্ত ক্ষত্রিয় শাসন চলেছিল। বৌদ্ধ ও জৈন যুগে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, রাজর্ষি অশোক প্রমুখ রাজার উত্থানে ক্ষত্রিয় শক্তির কাছে ব্রাহ্মণ শক্তি পরাভূত হয়।

বর্তমান ভারত গ্রন্থে বৈশ্য শাসনের বর্ণনা

ভারতে মুঘল রাজশক্তিকে পরাভূত করে বৈশ্যশক্তি হিসেবে ইংরেজরা ভারতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। বাণিজ্যই তাদের মূল শক্তি ছিল।

বর্তমান ভারত গ্রন্থে শূদ্র জাগরণের বর্ণনা

শূদ্ররা ‘ভারবাহী পশু’ হিসেবে বিবেচিত হলেও পৃথিবীর অন্যত্র শূদ্ররা জেগে উঠেছে। ভারতেও শূদ্রদের অবস্থার পরিবর্তন হবে। বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন এর পরেই পৃথিবীতে শূদ্র যুগ আসছে।

জাতীয়তাবাদ বিকাশে বর্তমান ভারত গ্রন্থের ভূমিকা

স্বামী বিবেকানন্দের এই বর্তমান ভারত গ্রন্থটি আমাদের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

(১) গৌরবোজ্জ্বল অতীত

স্বামী বিবেকানন্দ তার বর্তমান ভারত গ্রন্থে বৈদিক যুগ থেকে ব্রিটিশ শাসন কাল পর্যন্ত ভারতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করেছেন।

(২) ঐক্য স্থাপন

বিবেকানন্দ উপলব্ধি করতেন যে, পরাধীন ভারতের মুক্তির জন্য সবথেকে বেশি প্রয়োজন ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্য। তাই তিনি ভারতীয় সমাজের বর্ণ বৈষম্য ও দলিত শূদ্রদের প্রতি বঞ্চনার তীব্র নিন্দা করে সকল ভারতীয়দের ঐক্যের কথা বলেছেন।

(৩) শূদ্র জাগরণ

তিনি বলেছেন বৈদিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত শূদ্রদের দমিয়ে রাখা হয়েছে। তাই এবার ভারতে শূদ্র জাগরণ ঘটবে এবং সমাজের সমস্ত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হবে। এইভাবে সাধারন মানুষের অধিকার সু-প্রতিষ্ঠিত হলেই প্রকৃত স্বাধীনতার মূল্য থাকবে।

(৪) দেশপ্রেমের আদর্শ

বিবেকানন্দ এই প্রবন্ধে ভারতবাসীকে স্বদেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। তিনি বলেন – “ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর …… ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ।’ তার আকুল আহ্বানে যুবসমাজের মনে স্বদেশপ্রেমের ঝড় বয়ে যায়।

(৫) নারীর মর্যাদা

বিবেকানন্দ বর্তমান ভারত গ্রন্থে নারীর মর্যাদার কথা তুলে ধরে, নারী সমাজের উন্নতি সাধন করতে চেয়েছেন। তিনি সীতা সাবিত্রী ও দয়মন্তী প্রমূখ ঐতিহাসিক নারী চরিত্রের উদাহরণ দিয়ে ভারতীয় নারীর আদর্শ তুলে ধরেছিলেন।

(৬) দেশমাতার মুক্তি

বর্তমান ভারত গ্রন্থে বিবেকানন্দ বলেছেন যে, মানুষ জন্ম থেকেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত। তাই তিনি পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ছেড়ে ভারতমাতার মুক্তির জন্য দেশবাসীকে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানান। দেশ মাতার কাছে তিনি আবেদন জানান “আমায় মানুষ কর।”

বর্তমান ভারত গ্রন্থের মূল্যায়ণ

বর্তমান ভারত গ্রন্থের মুখবন্ধে স্বামী সারদানন্দ বলেছেন “স্বামী বিবেকানন্দের সর্বতোমুখী প্রতিভা প্রসূত ‘বর্তমান ভারত’ বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ”। ঋষি অরবিন্দ ঘোষ বলেছেন “বিবেকানন্দ আমাদের জাতীয় জীবনের গঠনকর্তা” বিপিনচন্দ্র পাল বিবেকানন্দকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত’ বলে উল্লেখ করেছেন।

উপসংহার :- সবশেষে ‘বর্তমান ভারত’ প্রবন্ধে হীনমন্যতা ও পরাধীনতার গ্লানি তে মূহ্যমান দেশবাসীর কানে গনজাগরনের মন্ত্র দিয়ে স্বামীজি বলেছেন – “ওঠো, জাগো। তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত”। ভুলিও না, নীচ জাতি, মুর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই।”


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “বর্তমান ভারত” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) বর্তমান ভারত গ্রন্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বর্তমান ভারত প্রথম প্রকাশিত হয় কোন পত্রিকায়?

উদ্বোধন পত্রিকায়, ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে।

২. বর্তমান ভারত প্রবন্ধে বিবেকানন্দ কিসের কথা বলেছেন?

শূদ্র জাগরণের কথা।

৩. স্বামী বিবেকানন্দ বর্তমান ভারত গ্রন্থটি রচনা করেন কেন?

সমসাময়িক ভারতের কথা বলার জন্য।

৪. বর্তমান ভারত কে রচনা করেন?

স্বামী বিবেকানন্দ।

Leave a Comment