পাবনা বিদ্রোহ

পাবনা কৃষক বিদ্রোহ -এর সময়কাল, স্থান, বিদ্রোহের কারণ, নেতৃত্ব, প্রধান কেন্দ্র, বিস্তার, কৃষক সমিতি গঠন, বিদ্রোহের অবসান, পত্রিকায় প্রকাশ, চরিত্র ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানবো।

পাবনা বিদ্রোহ প্রসঙ্গে পাবনা বিদ্রোহের সময়কাল, পাবনা বিদ্রোহের স্থান বা এলাকা, পাবনা বিদ্রোহের নেতা, পাবনা কৃষক বিদ্রোহের কারণ, পাবনা কৃষক বিদ্রোহের দুজন নেতা ঈশানচন্দ্র, ক্ষুদি মোল্লা, দি পাবনা রায়ত লিগ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য, পাবনা বিদ্রোহের সূচনা, পাবনা বিদ্রোহের বিস্তার, পাবনা বিদ্রোহের চরিত্র, পাবনা বিদ্রোহের তাৎপর্য, গুরুত্ব ও ফলাফল

১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে পাবনা কৃষক বিদ্রোহ

ঐতিহাসিক ঘটনাপাবনা বিদ্রোহ
সময়কাল১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ
স্থানইউসুফশাহী পরগণা
নেতৃত্বঈশান চন্দ্র রায়, শম্ভুনাথ পাল, ক্ষুদিমোল্লা
ফলাফলব্যর্থতা
পাবনা বিদ্রোহ

ভূমিকা :- পাবনা কৃষক বিদ্রোহ জমিদারদের বিরুদ্ধে ১৮৭৩ সালে জেগে ওঠা একটি উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহ। বাংলাদেশ -এর ইউসুফশাহী পরগনায় এই বিদ্রোহের সূচনা হয়।

নব্য জমিদার

সিরাজগঞ্জের ইউসুফশাহী পরাগনায় নাটোর জমিদারির অংশ ক্রয়কারী নব্য জমিদারগণ বর্ধিত হারে কর আদায় এবং বিভিন্ন নামে আরোপিত অবৈধ কর আদায়ের জন্য নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকেন।

১৮৫৯ সালের আইন

১৮৫৯ সালের Act X-এর আওতায় তিনটি সুনির্দিষ্ট কারণে জমিদারগণ জমির খাজনা বৃদ্ধি করতে পারতেন। যথা –

  • (১) যদি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের একই ধরনের জমির খাজনার তুলনায় রায়ত কম খাজনা প্রদান করে।
  • (২) যদি উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।
  • (৩) যদি রায়ত তার জমির যথার্থ পরিমাণের চেয়ে কম পরিমাণ জমির খাজনা প্রদান করে। জমিদারগণ এতটাই শক্তিধর ছিল যে, তারা এই সকল বিধিকে গুরুত্ব না দিয়ে জমির খাজনা বৃদ্ধি করতে পারত।

পাবনা বিদ্রোহের কারণ

পাবনা বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার কারণগুলি হল –

(১) ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি

১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী জমিদাররা তিনটি কারণ দেখিয়ে ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধি করে এবং সরকারি রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি পাবনার কৃষকের কাছ থেকে বিভিন্ন রকমের অবৈধ খাজনা আদায় করা শুরু করে।

(২) প্রতিকারের চেষ্টার ব্যর্থতা

১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পর পাবনার কৃষকরা আইনসম্মত উপায়ে এই শােষণ ও অত্যাচারের প্রতিকার করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

(৩) জোটবদ্ধতা

আইনানুগ পথে কৃষকদের সমস্যার প্রতিকার না হলে ঈশানচন্দ্র রায় নামে এক সম্পন্ন কৃষকের নেতৃত্বে কৃষকেরা জোটবদ্ধ হয়ে পাবনা বিদ্রোহ শুরু করে।

পাবনা বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ

উরকান্দি গ্রামের ৪৩ জন নেতৃস্থানীয় রায়তের বিরুদ্ধে দমনমূলক মোকদ্দমা দায়েরের ঘটনাই ছিল পাবনা কৃষক বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ।

পাবনা বিদ্রোহের নেতৃত্ব

এই বিদ্রোহে স্থায়ী রায়তদের ভুস্বামী ঈশানচন্দ্র রায়, মেঘুল্লা গ্রামের মোড়ল শম্ভুনাথ পাল, ক্ষুদিমোল্লা প্রমুখ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

পাবনা বিদ্রোহের আগুন

জমিদাররা খাজনা বৃদ্ধি করায় ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বিক্ষোভের আগুন একটু একটু করে ছড়াতে থাকে।

পাবনা বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র

পাবনা কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল সর্বপ্রথম পাবনার ইউসুফশাহী পরগনায়। পাবনা কৃষক বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র ছিল ইউসুফশাহী পরগণা।

পাবনা বিদ্রোহের বিস্তার

ইউসুফশাহী পরগনা থেকে শুরু হওয়ার পর সমগ্র পাবনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ, রাজশাহী প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। পাবনা কৃষক বিদ্রোহ অল্প সময়ের মধ্যেই খুব তীব্র হয়ে উঠেছিল।

পাবনায় কৃষক সমিতি গঠন

১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে পাবনার ইউসুফজাই পরগনার কৃষকরা একটি কৃষক সমিতি গঠন করে, যার উদ্দেশ্য ছিল খাজনা বৃদ্ধি প্রতিরােধ করা। এরা বিভিন্নভাবে খাজনা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করার পাশাপাশি মাঝে মাঝে খাজনা দেওয়াও বন্ধ করে দেয়।

দি পাবনা রায়ত লীগ

  • (১) ১৮৭৩ সালের মে মাসে ‘দি পাবনা রায়ত লীগ‘ গঠিত হয় এবং দিনে দিনে তার কার্যক্রম জেলার বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এই লীগের অন্যতম নেতা ছিলেন ঈশানচন্দ্র রায়।
  • (২) সাধারণত তিনি ‘ঈশান রাজা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন ক্ষুদি মোল্লা ও শম্ভুনাথ পাল।
  • (৩) তাঁরা তাদের পরগণাকে জমিদার নিয়ন্ত্রণ-মুক্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেন এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেন।
  • (৪) তাঁরা জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর মোকাবেলার জন্য একটি বিদ্রোহী বাহিনী গঠন করেন। বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বে বিশ্বস্ত নায়েব নিয়োগ করা হয়।
  • (৫) কিছুসংখ্যক লোককে বিদ্রোহী বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া হয় এবং জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাদের মোতায়েন করা হয়।

পাবনা বিদ্রোহের অবসান

বিদ্রোহীদের ওপর পুলিশি অত্যাচার এবং ১৮৭৩-৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ফলে এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।  

পাবনা বিদ্রোহে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

পাবনার অধিকাংশ কৃষক মুসলিম এবং জমিদাররা হিন্দু হলেও এই আন্দোলনে কোনােরকম সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব ছিল না।

পত্র-পত্রিকায় পাবনা বিদ্রোহের ঘটনা প্রকাশ

পাবনা কৃষক বিদ্রোহের নানা ঘটনার কথা, সেই সময়ের গ্রামবার্তা প্রকাশিকা, হিন্দু হিতৈষণী, সহচর প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

পাবনা বিদ্রোহে মধ্যবিত্ত বাঙালির অসহযোগিতা

পাবনা বিদ্রোহ মূলত জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হওয়ায় বিদ্রোহীরা মধ্যবিত্ত বাঙালিদের একাংশের সমর্থন পায়নি।

পাবনা বিদ্রোহের চরিত্র

পাবনা বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র নিয়ে পণ্ডিতগণ একমত নন। যেমন –

(১) অসাম্প্রদায়িক বিদ্রোহ

পাবনা বিদ্রোহ একটি অসাম্প্রদায়িক বিদ্রোহ ছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন। কারণ, জমিদাররা হিন্দু বলে কৃষকেরা তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি, জমিদাররা অত্যাচারী ও শোষক ছিল বলে কৃষকরা বিদ্রোহ করেছিল।

(২) বিদ্রোহের পন্থা

পাবনা বিদ্রোহে কৃষকরা কোনো চরমপন্থী বা বৈপ্লবিক দাবি করেনি। খাজনা বন্ধ ছাড়া কৃষকরা অন্য কোনো প্রতিরোধের পথেও যায়নি। তারা জমিদারদের মিথ্যা মামলা লড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য কেউ কেউ মনে করেন যে, পাবনা বিদ্রোহ ছিল একটি আইন-মাফিক বিদ্রোহ।

(৩) জমিদার-বিরোধিতা

পাবনা বিদ্রোহে অত্যাচারিত কৃষকরা মূলত জমিদারদের বিরোধিতা করে। কারণ, বিদ্রোহীরা জমিদারদের দ্বারাই প্রত্যক্ষ শোষণ ও অত্যাচারের শিকার হয়।

(৪) সীমাবদ্ধ বিদ্রোহ

পাবনা বিদ্রোহ জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হলেও বিদ্রোহীদের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা বিশেষ দেখা যায়নি। বরং বিদ্রোহীরা সরকারকে খাজনা দিতে চায় এবং সরাসরি মহারানির প্রজা হওয়ার দাবি জানায়। এজন্য কেউ কেউ একে সীমাবদ্ধ বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেন।

(৫) রাজনৈতিক চেতনার অভাব

পাবনা বিদ্রোহে ব্রিটিশ বিরোধিতার অভাব লক্ষ্য করে কেউ কেউ মনে করেন যে, বিদ্রোহে রাজনৈতিক চেতনার অভাব ছিল। কারণ, ব্রিটিশ শক্তিই ছিল এদেশে কৃষকদের দুর্দশার মূল কারণ — এই কথা বিদ্রোহীরা বুঝতে পারেনি।

পাবনা বিদ্রোহের তাৎপর্য

১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে বেআইনি খাজনা ও খাজনাবৃদ্ধির কারণে সংঘটিত পাবনা বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কিন্তু এই বিদ্রোহের তাৎপর্য ছিল সুদূর প্রসারী। যেমন –

(১) ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন

পাবনার অধিকাংশ কৃষক মুসলিম এবং জমিদার হিন্দু হলেও এই আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটেনি বা সংঘাতের বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি।

(২) জমিদার বিরােধিতা

পাবনা বিদ্রোহ ছিল জমিদার বিরােধী কিন্তু তা ইংরেজ বিরােধী ছিল না। তাই এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের অবসান নয়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রজাস্বার্থ রক্ষার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

(৩) রায়ত সভা গঠন

পাবনার কৃষক বিদ্রোহের মাধ্যমে বাংলার কৃষকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠার প্রেরণা লাভ করে এবং রায়ত সভা গঠনের মাধ্যমে কৃষক সংগঠন গড়ে ওঠে।

(৪) বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন প্রবর্তন

পাবনা বিদ্রোহের অন্যতম দাবি ছিল ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত প্রজাস্বত্ব অক্ষুন্ন রাখা। তাই প্রজাস্বত্ব রক্ষার জন্য ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন পাস করা হয়।

উপসংহার :- ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের মতে, পাবনার কৃষকদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার অভাব ছিল। নীল বিদ্রোহ -এর তুলনায় পাবনার কৃষক বিদ্রোহ ছিল আদর্শগত ভাবে সীমাবদ্ধ।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “পাবনা বিদ্রোহ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) পাবনা বিদ্রোহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. পাবনা বিদ্রোহ কখন হয়েছিল?

১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে।

২. পাবনা বিদ্রোহ কোথায় হয়েছিল?

পাবনা জেলা-সহ ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজশাহি প্রভৃতি জেলায়।

৩. পাবনা বিদ্রোহের নেতা কে ছিলেন?

ঈশান চন্দ্র রায়।

৪. পাবনা বিদ্রোহের খবর কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়?

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকায়।

অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি

Leave a Comment