মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা প্রসঙ্গে জর্জ এবেলের অভিমত, ১৩৩ টি বৈঠক, গান্ধী ও জিন্নার দাবি, গান্ধীর অভিমত, মানসিক বিকারগ্ৰস্ত জিন্না, ভারত বিভাগ ছাড়া উপায় নেই, হিংসার চাপ, ভারত বিভাগ সম্পর্কে গান্ধীর উক্তি, নেতাদের সঙ্গে আলোচনা, মাউন্টব্যাটেন ঘোষণা, মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার মূল কথা, প্রস্তাবে গান্ধীর সম্মতি, জিন্নার সম্মতি, ভারতের স্বাধীনতা আইন, ভারত ও পাকিস্তান গঠন ও ভারতের সংবিধান রচনা সম্পর্কে জানবো।

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা

ঐতিহাসিক ঘটনামাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা
সময়কাল৩ জুন, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ
ঘোষণা করেনলর্ড মাউন্টব্যাটেন
উদ্দেশ্যক্ষমতা হস্তান্তর
ফলাফলভারত ভাগ
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা

ভূমিকা:- ১৯৪৭ সালের ২২শে মার্চ নতুন গভর্নর মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসেন। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য যত শীঘ্র সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তর করা। সারা ভারত সেদিন অগ্নিগর্ভ।

জর্জ এবেলের অভিমত

মাউন্টব্যাটেনের একান্ত সচিব জর্জ এবেল তাঁকে জানান যে, ভারতবর্ষ গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে।

ইসমেও গ্ল্যানসির অভিমত

লর্ড ইসমে বলেন, “ভারতবর্ষ মাঝ সমুদ্রে আগুন লাগা জাহাজ, যার নীচের খোল বারুদে ভর্তি।” পাঞ্জাবের গভর্নর গ্ল্যানসি বলেন, “সারা প্রদেশে গৃহযুদ্ধের হাওয়া বইছে।”

১৩৩ টি বৈঠক

১৯৪৭ সালের ২৪শে মার্চ থেকে ৬ই মে-র মধ্যে মাউন্টব্যাটেন বিভিন্ন ভারতীয় নেতৃমণ্ডলী ও রাজন্যবর্গের সঙ্গে ১৩৩টি বৈঠক করেন।

গান্ধী ও জিন্নার দাবি

মাউন্টব্যাটেনের লক্ষ্য ছিল অখণ্ড ভারত। কিন্তু জিন্না তাঁর দাবিতে অনড়। গান্ধী ভারত-বিভাগের ঘোরতর বিরোধী। বড়লাটের সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্বে তিনি মৌলানা আজাদকে জানান যে, তিনি তাঁর জীবদ্দশায় পাকিস্তান প্রস্তাব মানবেন না।

গান্ধীর অভিমত

গান্ধীজী বড়লাটকে বলেন যে, প্রয়োজনে জিন্নার হাতে সরকারের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হোক, কিন্তু ভারত-বিভাগ চলবে না। নেহরু গান্ধীর এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান।

মানসিক বিকারগ্রস্থ জিন্না

মহম্মদ আলি জিন্নার সঙ্গে কথা বলে বড়লাটের ধারণা হয় যে তিনি ‘মানসিক বিকারগ্রস্থ।

ভারত বিভাগ ছাড়া উপায় নেই

মাউন্টব্যাটেন উপলব্ধি করেন যে, ভারত বিভাগ ছাড়া উপায় নেই, এবং এ ব্যাপারে বিলম্ব করার অর্থই হল পাঞ্জাব, বাংলা ও অন্যান্য স্থানে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে তা দীর্ঘস্থায়ী করে মানুষের জীবন ও সম্পত্তি বিনাশে সাহায্য করা।

হিংসার চাপ

ক্রমবর্ধমান হিংসার চাপে নেহরু, প্যাটেল ও অন্যান্যরা দেশবিভাগ মানসিকভাবে মেনে নিতে বাধ্য হন। ভারত ভাগ নিয়ে তখন জোর তৎপরতা চলছে— জুনের মধ্যে এই কাজ শেষ করতে হবে।

গান্ধীজি ও আজাদের বিরোধিতা

গান্ধীজি ও আজাদ তখনও দেশভাগের বিরোধিতা করছেন। ৪ই মে ১৯৪৭ সালে গান্ধীজি, বড়লাটকে লিখেন যে, ইংরেজদের পক্ষে দেশভাগের শরিক হওয়া একটি বিশাল ভ্রান্তি হবে।

ভারত ভাগ সম্পর্কে গান্ধীর উক্তি

১লা জুন তিনি বলছেন, “সর্দার ও জওহরলাল মনে করে যে পরিস্থিতি বুঝতে আমার ভুল হচ্ছে।… দেশভাগ হলে নাকি শান্তি ফিরবে।..ওরা মনে করে বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমার ভীমরতি ধরেছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা ভুল পথে যাচ্ছি। আমরা হয়তো এখনই এই ঘটনার পুরো অভিঘাত বুঝতে পারব না, কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, দেশভাগের মূল্যে আমরা যে স্বাধীনতা পাচ্ছি তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার ।…আমি হয়তো এ সব দেখবার জন্য বাঁচব না, কিন্তু ভাবী প্রজন্ম জানুক যে এই দুঃসহ চিন্তায় এই বৃদ্ধ কি যন্ত্রণাই না ভোগ করেছে। তারা যেন কখনো না বলে যে গান্ধী ভারতের অঙ্গচ্ছেদের একজন অংশীদার ছিলেন।”

নেতাদের সাথে আলোচনা

২রা জুন ভারত ভাগের পরিকল্পনা নিয়ে মাউন্টব্যাটেন বিভিন্ন দলের সাতজন নেতার সঙ্গে আলোচনায় বসেন। ৩রা জুন গান্ধীজি বলেন যে, “আমি আবার বলছি যে ভারত ভাগ আমাদের দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে ক্ষতিকারক।

মাউন্টব্যাটেনের ঘোষণা

ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদনের পর মাউন্টব্যাটেন ৩রা জুন ভারত বিভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণা বা পরিকল্পনা ‘মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব’ বা ‘মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ’ (‘Mountbatten Award’) নামে পরিচিত।

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার মূল কথা

এই প্রস্তাবে বলা হয় যে,

  • (১) সমগ্র ভারতকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি পৃথক ডোমিনিয়নে বিভক্ত করা হবে এবং এই দুই ডোমিনিয়ন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়সমূহ পরিচালনা করবে।
  • (২) মুসলিম-প্রধান প্রদেশ সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বাংলা নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হবে।
  • (৩) পাঞ্জাব ও বাংলাকে বিভক্ত করা হবে এবং এই দুই প্রদেশের কোন্ কোন্ অঞ্চল কোন্ ডোমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হবে তা নির্ধারণের জন্য একটি সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠিত হবে।
  • (৪) উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও আসামের শ্রীহট্ট জেলা কোন্ ডোমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হবে তা গণভোট দ্বারা স্থির করা হবে।
  • (৫) দেশীয় রাজ্যগুলি নিজ নিজ রাজ্যে সার্বভৌম ক্ষমতা পাবে এবং ইচ্ছে করলে তারা যে-কোনো ডোমিনিয়নে যোগ দিতে পারবে।
  • (৬) প্রত্যেক ডোমিনিয়নের নিজস্ব গণ-পরিষদ বা আইনসভা নিজ ডোমিনিয়নের সংবিধান রচনা করবে।

প্রস্তাবে গান্ধীর সম্মতি

গান্ধীজি, আজাদ প্রমুখ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ দেশবিভাগের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন, কিন্তু দাঙ্গার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য গান্ধীজি শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাবে সম্মত হন এবং ১৪ই জুন ওয়ার্কিং কমিটিতে দেশভাগের পক্ষে সওয়াল করেন।

আজাদের অভিমত

দেশপ্রেমিক আজাদের মতে দেশভাগ হল এক দৈবদুর্বিপাক’ (Partition was a tragedy for India’)। তাঁর মতে ভারত বিভাগ হল কংগ্রেসের রাজনৈতিক পরাজয়ের সামিল।

প্যাটেলের অভিমত

এই ব্যাপারে প্যাটেল ভিন্ন কথা বলেন। তাঁর মতে ভারত বিভাগ কংগ্রেসের পরাজয় বা নতিস্বীকার নয়—তৎকালীন অবস্থায় দেশবিভাগই ছিল সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।

আধুনিক ঐতিহাসিকদের অভিমত

আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে কংগ্রেস কর্তৃক ভারত বিভাগ সমর্থন ‘বাস্তবসম্মত’। বস্তুত অন্তবর্তী সরকারের দৈনন্দিন কলহে ক্লান্ত প্যাটেল একটা মন্তব্য করেন, “There is no alternative to divide”।

মেহরোত্রার অভিমত

ডঃ এস. আর. মেহরোত্র বলেন যে, ভারত বিভাগে সম্মত হয়ে কংগ্রেস অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকারক বিকল্পটি গ্রহণ করেছিল, অন্যথায় গৃহযুদ্ধ, নৈরাজ্য ও চরমতম বিশৃঙ্খলা ভারতভূমিকে গ্রাস করত। ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ-ও মনে করেন যে গৃহযুদ্ধের চেয়ে দেশভাগ ভাল।

জিন্নার সম্মতি

পাকিস্তান রাষ্ট্র হলেও জিন্না সম্পূর্ণ খুশি হতে পারেন নি, কারণ তিনি সমগ্র বাংলা ও পাঞ্জাবকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। মাউন্টব্যাটেন ঘোষিত পাকিস্তানকে ‘বিকলাঙ্গ ও কীটদগ্ধ’ (‘truncated and moth-eaten) বলে আখ্যায়িত করেও তিনি এই প্রস্তাব মেনে নেন।

ভারতীয় স্বাধীনতা আইন

৪ ঠা জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন’ বিনা বাধায় পাশ হয় এবং ১৮ই জুলাই তা রাজকীয় সম্মতি লাভ করে। এই আইনের বলে ১৫ই আগস্ট ভারত বিভক্ত হল এবং ভারত ও পাকিস্তান ডোমিনিয়নের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হল।

ভারত ও পাকিস্তান গঠন

বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু, পশ্চিম পাঞ্জাব, পূর্ব বাংলা এবং আসামের শ্রীহট্ট জেলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হল পাকিস্তান। বাকি অংশ নিয়ে গঠিত হল ভারত। দেশীয় রাজ্যগুলিকে যে-কোন একটি ডোমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হবার অধিকার দেওয়া হল।

পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী

১৯৪৭-এর ১১ই আগস্ট জিন্না পাকিস্তান গণ-পরিষদের সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৫ই আগস্ট তিনি পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল এবং লিয়াকত আলি খান প্রধানমন্ত্রী রূপে শপথ গ্রহণ করেন।

ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী

১৪-১৫ ই আগস্ট মধ্যরাত্রে ভারতীয় গণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশন বসে। মাউন্টব্যাটেন স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল এবং জওহরলাল স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। মাউন্টব্যাটেনের ভারত ত্যাগের পর ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল হলেন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী।

জওহরলাল নেহেরুর ভাষণ

নবীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এক আবেগদীপ্ত ভাষণে বলেন – “মধ্যরাত্রির ঘণ্টা যখন বাজবে, সমগ্র বিশ্ব যখন গভীর নিদ্রামগ্ন, ভারত জেগে উঠবে জীবন ও স্বাধীনতার চেতনায়।”স্বাধীনতা লাভের দিনটি ভারতে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে চিহ্নিত।

সংবিধান রচনা

এরপর গণ-পরিষদের সভাপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ -এর নেতৃত্বে চলল ভারতের সংবিধান রচনার কাজ। সংবিধান মুসাবিদা কমিটি বা Drafting Committee-র সভাপতি ছিলেন ডঃ বি. আর. আম্বেদকর। দীর্ঘ ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিনের চেষ্টায় সংবিধান রচিত হয়।

উপসংহার:- ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর গণপরিষদ-এর সভাপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ এই সংবিধানে স্বাক্ষর করেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি থেকে এই সংবিধান চালু হয় এবং ভারত একটি ‘সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ রূপে ঘোষিত হয়। এই দিনটি ভারতে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত।

(FAQ) মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা কবে ঘোষিত হয়?

৩ জুন, ১৯৪৭ সালে।

২. স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল কে ছিলেন?

লর্ড মাউন্টব্যাটেন।

৩. স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন?

জওহরলাল নেহেরু।

৪. ভারতে কবে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়?

১৫ আগস্ট।

৫. ভারতের স্বাধীনতা আইন কবে পাস হয় এবং কবে রাজকীয় সম্মতি লাভ করে?

৪ জুলাই ১৯৪৭ সালে, ১৮ জুলাই ১৯৪৭ সালে।

Leave a Comment