রাজ্যচ্যুত হুমায়ুনের পুনরায় সিংহাসন লাভ প্রসঙ্গে আফগান অভিজাতদের অনৈক্য, হুমায়ুনের সুযোগ পেশোয়ারে উপস্থিত, গক্কর নেতার সাহায্য বঞ্চিত, সেনাবাহিনীর বিভাজন, লাহোর দখল, হরিয়ানা দখল, মাছিয়ারার যুদ্ধ, সমগ্র পাঞ্জাব দখল, সিরহিন্দের যুদ্ধ ও সিংহাসন পুনর্দখল সম্পর্কে জানবো।
রাজ্যচ্যুত হুমায়ুনের পুনরায় সিংহাসন লাভ
বিষয় | হুমায়ুনের পুনরায় সিংহাসন লাভ |
সম্রাট | হুমায়ুন |
রাজ্যহারা | ১৫৪০ খ্রি: |
পুনরায় রাজ্য লাভ | ১৫৫৫ খ্রি: |
যুদ্ধ | সিরহিন্দের যুদ্ধ |
পরাজিত রাজা | সিকান্দার শূর |
ভূমিকা :- হুমায়ুনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শেরশাহ হুমায়ুনকে ভারত থেকে বহিষ্কার করেছিলেন এবং হুমায়ুনের নির্বাসনকালীন সময়ে ভারতবর্ষে বিশাল ও শক্তিশালী এক সুশাসিত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আফগান অভিজাতদের অনৈক্য
১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে শের শাহের মৃত্যু ঘটায় এই সুশাসিত আফগান সাম্রাজ্যের অবনতি ঘটে। এরপর শের শাহের পুত্র ইসলাম শাহ-এর মৃত্যু ঘটলে, আফগান অভিজাতদের মধ্যে তীব্র অনৈক্য দেখা দেয়।
সম্রাট হুমায়ুনের সুযোগ
হুমায়ুন এই সময় ভারতীয় আফগান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখেন এবং ভারতীয় হৃত-সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য অপেক্ষাও করতে থাকেন। অতঃপর ইসলাম শাহের মৃত্যুর প্রায় একবছরের মধ্যেই হুমায়ুন সেই সুযোগ পেয়ে যান।
পেশোয়ারে হুমায়ুনের উপস্থিত
১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে হুমায়ুন তিন হাজার সেনা নিয়ে পেশোয়ারে উপস্থিত হন। পেশোয়ারে যাবার সময় তিনি যখন সিন্ধু অতিক্রম করছিলেন, তখন তাঁর অতি বিশ্বস্ত বৈরাম খান ও অন্যান্য আরও অনেক কান্দাহারের সামরিক নেতা তাঁর সঙ্গে যোগদান করেন।
গক্কর নেতার সাহায্য বঞ্চিত হুমায়ুন
বৈরাম খান গক্কর নেতা সুলতান আদমের সাহায্যের জন্য তাঁর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু সুলতান আদম ইতিপূর্বেই সিকন্দার শাহ শূরের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন, যার জন্য তিনি হুমায়ুনকে সাহায্য করতে রাজি হন না।
হুমায়ুনের সেনাবাহিনীর বিভাজন
এরপর হুমায়ুন পূর্ব পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলায় অবস্থিত কালানুরে উপস্থিত হন। সেখানে গিয়ে হুমায়ুন তাঁর বাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করেন। প্রথম বাহিনীর নেতৃত্বের ভার দেন সিহাবউদ্দিন খানকে এবং তাকে লাহোরে পাঠান। দ্বিতীয় বাহিনীর নেতৃত্বের ভার দেন বৈরাম খান এবং অন্যান্য সামরিক প্রধানদের ওপর। তৃতীয় বাহিনীর নেতৃত্বের ভার তিনি নিজেই নেন।
হুমায়ুনের লাহোর দখল
লাহোর বিনা বাধায় দখল হয় এবং হুমায়ুন কিছুদিন পর লাহোরে পৌঁছোন। হুমায়ুন লাহোরে মুঘল শাসনব্যবস্থার বন্দোবস্ত করেন।
হুমায়ুনের হরিয়ানা দখল
বৈরাম খান এবং অন্যান্য সামরিক প্রধানরা হরিয়ানার আফগান শাসক নাসিব খানের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। এরপরই আফগান নেতা শাহবাজ খানের বিরুদ্ধে লড়াই করে দীপালপুর দখল করেন এবং এই সময়েই বৈরাম খান নাসিব খানকে বিতাড়িত করে হরিয়ানা দখল করেন।
মাছিয়ারার যুদ্ধে হুমায়ুনের জয়লাভ
- (১) এরপর বৈরাম খান জলন্ধরের দিকে অগ্রসর হন। তারপর জলন্ধর থেকে বৈরাম খান লুধিয়ানার ঊনিশ মাইল পূর্বে অবস্থিত মাছিয়ারাতে উপস্থিত হন। মাছিয়ারাতে মুঘল ও আফগান শক্তির মধ্যে এক বিরাট যুদ্ধ হয়।
- (২) এই যুদ্ধে আফগান শক্তির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নাসির খান, তাতার খান এবং অন্যান্য আরও গুরুত্বপূর্ণ আফগান নেতা। ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে মাছিয়ারার যুদ্ধ প্রায় মধ্যরাত্রি পর্যন্ত চলে। সৌভাগ্যবশত নিকটবর্তী একটি আফগান ঘাঁটিতে আগুন লেগে যায়।
- (৩) সেই আগুনের শিখায় মুঘল বাহিনীর পক্ষে আফগান সৈন্যের অবস্থান দেখতে সুবিধা হয়। মুঘল বাহিনী সেইমতো অব্যর্থ লক্ষ্যে কামানের গোলা ছুঁড়ে আফগান বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করতে সমর্থ হয়। সেই সময় বৈরাম খান ক্ষিপ্রগতিতে সিরহিন্দ দখল করে নেন।
হুমায়ুনের সমগ্ৰ পাঞ্জাব দখল
১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের মাছিয়ারার যুদ্ধ মুঘল ও আফগানদের শক্তিপরীক্ষার যুদ্ধ হিসেবে ভারত-ইতিহাসে বিবেচিত। মাছিয়ারার যুদ্ধে জয়লাভের ফলেই হুমায়ুন প্রায় সমগ্র পাঞ্জাব দখল করতে সমর্থ হন।
সিরহিন্দে হুমায়ুনের অগ্ৰসর
মাছিয়ারার যুদ্ধের ফলেই সিকন্দার শূর ভীত হয়ে প্রায় আশি হাজার সৈন্য সংগ্রহ করে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে দিল্লি হতে সিরহিন্দের দিকে অগ্রসর হন।
হুমায়ুনের প্রতি বৈরাম খাঁর অনুরোধ
এই সংঘর্ষ হুমায়ুনের ভাগ্যপরীক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভেবে বৈরাম খান হুমায়ুনকে সৈন্যবাহিনী নিয়ে সিরহিন্দে তাঁর সঙ্গে যোগদান করতে অনুরোধ করেন। হুমায়ুন সেইমতো লাহোর থেকে সিরহিন্দে হাজির হন। অবশ্য হুমায়ুন অসুস্থতার জন্য ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মের আগে সেখানে হাজির হতে পারেন নি।
বৈরাম খাঁর ভীতি
প্রথমদিকে বৈরাম খান সিকন্দার শূরের বিরাট বাহিনী দেখে ভীত হন। কারণ, জৌহরের সাক্ষ্য অনুযায়ী বৈরাম খানের মাত্র সাত অথবা আটশত সৈন্য ছিল। মুঘল ও আফগান বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি হয়ে প্রায় পঁচিশ দিন কোনো যুদ্ধ না করে শুধুমাত্র দাঁড়িয়েছিল।
সিরহিন্দের যুদ্ধে হুমায়ুনের জয়লাভ
বৈরাম খানের দক্ষ রণনৈপুণ্যে সিরহিন্দের যুদ্ধেও মুঘলরা আফগানদের পরাজিত করতে সমর্থ হয়। সিকন্দার শূর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শিবালিক পার্বত্য অঞ্চলে পালিয়ে যান। সিরহিন্দের যুদ্ধে জয়লাভ করে হুমায়ুন দিল্লি অভিমুখে অগ্রসর হন এবং সামানায় প্রবেশ করেন।
হুমায়ুনের সিংহাসন পুনর্দখল
সামানায় কিছুদিন থেকে হুমায়ুন দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন। ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই দিল্লিতে প্রবেশ করে প্রায় দীর্ঘ পনেরো বছর পর তিনি দিল্লির সিংহাসন পুনর্দখল করেন।
হুমায়ুনের শাসনকার্যের ভার বন্টন
তাঁর অনুগতদের মধ্যে তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং অধিকৃত অঞ্চলগুলির শাসনকার্যের ভার বণ্টন করে দেন।
আফগান সাম্রাজ্যের অবসান
প্রকৃতপক্ষে মাছিয়ারা ও সিরহিন্দের যুদ্ধে হুমায়ুনের জয়লাভই আফগান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিয়েছিল, ঠিক যেমনটি চৌসার যুদ্ধ ও কনৌজের যুদ্ধ-এ বাবর-এর প্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটেছিল। তাই বলা যায়, হুমায়ুন মাছিয়ারা ও সিরহিন্দের যুদ্ধে জয়লাভ করে চৌসা ও কনৌজের যুদ্ধের অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করেছিলেন।
উপসংহার :- দিল্লির সিংহাসন পুনরুদ্ধার ভারতবর্ষের মুঘল ইতিহাসে হুমায়ুনের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা।
(FAQ) রাজ্যচ্যুত হুমায়ুনের পুনরায় সিংহাসন লাভ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে।
শেরশাহ।
১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে।
সিরহিন্দের যুদ্ধ।
সিকান্দার শাহ শূর।