ইসলাম শাহ

সুলতান ইসলাম শাহ সুরি প্রসঙ্গে সিংহাসনে আরোহন, পিতার মত জাত সৈনিক, সামরিক দক্ষতা, ভাইয়ের সাথে বিরোধ, অভিজাতদের নির্মম শাস্তি প্রদান, খান নিয়াজির বিদ্রোহ, অভিজাতদের ওপর ক্রুদ্ধ ও সন্দিগ্ধ, মুঘলদের গতিবিধির ওপর নজর, শাসনতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা, শক্তিশালী শাসক, সেনাবাহিনী সংগঠন, প্রচণ্ড পরিশ্রম ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা সম্পর্কে জানবো।

সুলতান ইসলাম শাহ সুরি

সুলতানইসলাম শাহ
রাজত্বকাল১৫৪৫-১৫৫৩ খ্রি:
বংশশূর বংশ
পূর্বসূরিশেরশাহ
উত্তরসূরিফিরোজ শাহ
সুলতান ইসলাম শাহ সুরি

ভূমিকা :- ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে শের শাহের মৃত্যুর সময় তাঁর দুই পুত্র আদিল ও জালাল বর্তমান ছিলেন। দুই পুত্রের মধ্যে আদিল ছিলেন জ্যেষ্ঠ পুত্র। কিন্তু শের শাহের মৃত্যুর সময় দুই পুত্রই উপস্থিত ছিলেন না।

জালালকে নরপতি ঘোষণা

আদিল রণথম্বোর ও দ্বিতীয় পুত্র জালাল রেওয়া-তে ছিলেন। তবে মৃত্যু সংবাদ শুনে জালালই প্রথম কালিঞ্জরে উপস্থিত হন এবং অভিজাতরা ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মে জালালকেই নরপতি হিসাবে ঘোষণা করেন। সঙ্গে সঙ্গে জালাল আগ্রাতে গিয়ে সৈন্যদের সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য প্রত্যেক সৈন্যকে দু’মাসের মাইনে দিয়ে দেন।

ইসলাম শাহর সিংহাসনে আরোহণ

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আদিলকে বঞ্চিত করে জালাল খান ‘ইসলাম শাহ’ অথবা ‘সলিম শাহ’ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।

উত্তরাধিকার নির্বাচন

  • (১) ইসলামিক উত্তরাধিকার আইনে জ্যেষ্ঠপুত্রের সিংহাসনের দাবির অগ্রাধিকার স্বীকৃত নয়। জালাল খান ইতিপূর্বেই তাঁর সাহসিকতা, অধ্যবসায় এবং সামরিক দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছিলেন।
  • (২) এই জন্যই অভিজাতরা শের শাহ কর্তৃক আদিল খান উত্তরাধিকারী মনোনীত হওয়া সত্ত্বেও, আদিল খানের থেকে জালাল খানকে তাঁর পিতার উত্তরাধিকার নির্বাচনে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। আদিল খানের অন্যান্য গুণ থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অলস প্রকৃতির।

পিতার মত জাত সৈনিক ইসলাম শাহ

জালাল খান ছিলেন সুশিক্ষিত এবং পারসিক ভাষার একজন কবি। স্বভাবতই বলা যায়, তিনি প্রথম জীবনে তাঁর পিতার মতোই উচ্চশিক্ষা পেয়েছিলেন। তাঁর পিতার সহযোগী হিসাবে সব অভিযানেই অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর পিতার মতোই এক জাত সৈনিক।

ইসলাম শাহর সামরিক দক্ষতা

  • (১) ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে চুনারগড় দুর্গ রক্ষায় তিনি চরম কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন এবং হুমায়ুনও এই আফগান তরুণের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে ফিরে আসেন। ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে গৌড় দখল করেন এবং বঙ্গদেশের প্রবেশদ্বার নামে খ্যাত তেলিরগড় দুর্গ দখলের সময় তিনি মুঘল বাহিনীকে প্রথম পরাজিত করে চরম কৃতিত্ব দেখান।
  • (২) তিনি ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে চৌসার যুদ্ধ ও ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে কনৌজের যুদ্ধ-এর দায়িত্বে ছিলেন এবং চৌসা ও কনৌজ-এর যুদ্ধে তিনি মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে চরম সাহসিকতার ও সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেন।
  • (৩) যোধপুর ও রাইসিন অভিযানের সময় তাঁর পিতার সঙ্গে চরম সহযোগিতা করেন। পিতা শের শাহ যখন কালিঞ্জর দুর্গ দখলে ব্যস্ত ছিলেন, তখন জালাল খান রেওয়া দখলে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাঁর পিতার অসময়ের মৃত্যুর জন্য এই কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়।

ভাইয়ের সাথে ইসলাম শাহর বিরোধ

  • (১) সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বড়ো ভাই আদিল খান এবং কিছু আফগান অভিজাতর সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাধে। আদিল খান রণথম্বোর দুর্গ ইসলাম শাহকে প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকার করেন এবং রাজধানীতে গিয়ে তিনি ভাইয়ের সঙ্গে আপস করতে অসন্তুষ্ট ছিলেন।
  • (২) তবে বিশিষ্ট আফগান অভিজাতরা, বিশেষ করে কুতুব খান নায়েব, খাবাস খান, ইশা খান নিয়াজি এবং জালাল খান বিন জালু তাকে আগ্রা থেকে নিরাপদে ফিরে যাওয়ার আশ্বাস দেওয়ায় তিনি রাজধানীর দিকে যাত্রা করেন।
  • (৩) ইত্যবসরে ইসলাম শাহ তাঁকে হত্যা করার এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, কিন্তু এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। যাইহোক, সুলতান ইসলাম শাহ আগ্রার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ‘বেয়ানা’ নামক স্থানটি আদিলকে দিতে স্বীকৃত হন ; কিন্তু পরক্ষণেই সুলতান আবার তাঁর মত পরিবর্তন করে আপস ভেস্তে দেন।
  • (৪) ইসলাম শাহ তাঁর ভাইকে বন্দি করার পরিকল্পনা করেন, অপরদিকে যে অভিজাতরা আদিলকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাঁরা সম্রাটকে সিংহাসনচ্যুত করতে বদ্ধপরিকর হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আদিল আগ্রার কাছে এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বুন্দেলখণ্ডের দিকে পলায়ন করেন।
  • (৫) তারপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। খাবাস খান ও ইশা খান নিয়াজি মেওয়াটের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন এবং মেওয়াটের ফিরোজপুরে তাঁদের কাছে সুলতানের বাহিনী পরাজিত হয়। কিন্তু রাজকীয় বাহিনী তৎক্ষণাৎ তাঁদের পরাজিত করে তাঁদেরকে কুমায়ুন পর্বতমালার দিকে চলে যেতে বাধ্য করে।

ইসলাম শাহ কর্তৃক অভিজাতদের নির্মম শাস্তি প্রদান

  • (১) সুলতানের বিরুদ্ধে আদিল খান-এর এই ষড়যন্ত্রই অধিকাংশ অভিজাতদের প্রতি সুলতানকে চরম সন্দিগ্ধ করে তোলে। এরই ফলে জালাল খান বিন জালু এবং তাঁর ভাইকে সুলতান হত্যা করেন। কুতুব খানকে আরও অনেক অভিজাতদের সঙ্গে গোয়ালিয়রে বন্দি করে রাখেন।
  • (২) অভিজাতদের প্রতি এই নির্মম শাস্তি প্রদানে আফগান অভিজাতদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। অথচ তাঁর পিতা এই অভিজাতদের নিজের বশে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে আফগান জাতিকে বশীভূত করে রাখার ক্ষমতা ইসলাম শাহের ছিল না। সুতরাং, তিনি স্বীয়-ক্ষমতা রক্ষার জন্য কঠোর নীতি অনুসরণ করতে আরম্ভ করেন।

সুলতান ইসলাম শাহর সময় খান নিয়াজির বিদ্রোহ

  • (১) নিয়াজি গোষ্ঠীর নেতা হায়বৎ খান নিয়াজি ছিলেন শের শাহের আমলের বিখ্যাত সেনাপতি। তিনি এই সুযোগে উচ্চাকাঙ্ক্ষাবশত সিংহাসন অধিকারের উদ্দেশ্যে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে আম্বালার দিকে যাত্রা করেন।
  • (২) তাঁর সঙ্গে খাবাস খানও যোগদান করেন। কিন্তু খাবাস খান যখন দেখেন যে যুদ্ধশেষে হায়বৎ খান সিংহাসন অধিকার করতে চান, তখন তাঁর নিজের লক্ষ্য পূরণ হবে না জেনে তিনি আম্বালার যুদ্ধের দিনেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেন এবং তার ফলে এই যুদ্ধে হায়বৎ খান পরাজিত হন।
  • (৩) অতঃপর তিনি পরাজিত হয়ে একস্থান থেকে অন্যস্থানে আশ্রয়ের জন্য ঘোরেন। পরিশেষে তিনি কাশ্মীরে আশ্রয় গ্রহণ করলে, তাঁর মা ও কন্যারা রাজকীয় বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং তাদের প্রতি অমানুষিক ব্যবহার করা হয় এবং তাদের হত্যা করা হয়। খাবাস খান পরে সুলতানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

ইসলাম শাহর নিকট সুজাত খানের বশ্যতা স্বীকার

এরপর তাঁর রোষদৃষ্টি পড়ে মালবের শাসনকর্তা সুজাত খান-এর ওপর। সুজাত খান প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করেছেন, এটাই ছিল তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ। সুজাত খান বশ্যতা স্বীকার করে নিষ্কৃতি লাভ করেন। পাঞ্জাবের শাসনকর্তা আজিম হুমায়ুনকে বিতাড়িত করে পাঞ্জাবের অধিকার গ্রহণ করেন।

অভিজাতদের ওপর ক্রুদ্ধ ও সন্দিগ্ধ ইসলাম শাহ

  • (১) ইসলাম শাহ সবচেয়ে ক্রুদ্ধ ও সন্দিগ্ধ হয়েছিলেন তাঁর পিতার সময়ের আফগান অভিজাতদের ওপর। অথচ তিনি তাঁর পিতার মতো দূরদৃষ্টি ও কূটকৌশল অবলম্বন করে এই আফগান অভিজাতদের কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্য-এর মঙ্গলসাধন করতে পারতেন।
  • (২) কিন্তু তিনি তা না করে ইব্রাহিম লোদীর মতো এই অভিজাতদের প্রতি নির্মম ব্যবহার করে তাদেরকে শূরবংশের বিরুদ্ধে চরম বিদ্রোহী করে তোলেন। কিন্তু তিনি পুরাতন অভিজাতদের সম্পর্কে মনে করেন, তাঁরা এত ক্ষমতাশালী হয়ে পড়েছে যে তার সিংহাসনের দ্যুতি তাদের কাছে যেন ম্লান হয়ে পড়েছে।
  • (৩) আফগান অভিজাতদের ওপর তাঁর কঠোরতা ও নির্মমতা তাঁর প্রতি আফগান অভিজাতদের বিশ্বাসকে বিনষ্ট করে। পুরাতন অভিজাতদের মর্যাদাতে আঘাত দিতেও তিনি কুণ্ঠাবোধ করেন নি। তাদের পরিবর্তে তিনি নিজের শূর বংশের মনোমত লোককে রাষ্ট্রের বিভিন্ন উচ্চপদে ক্ষমতায় বসান।
  • (৪) আহম্মদ খান শূরকে লাহোরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ইশা খান শূরকে মালবে সুজাত খানের স্থলে নিয়োগ করেন। কাজি ফজিলাকে বঙ্গদেশ থেকে সরিয়ে তাঁর স্থলে মহম্মদ খান শূরকে নিয়োগ করেন। খাজি খান শূরকে বেয়ানার দায়িত্ব দেন এবং তাঁর পুত্র ইব্রাহিম খান শূর আগ্রার দায়িত্ব পান।
  • (৫) সুলতানের নিকট-আত্মীয় মুবারিজ খানকে ২০,০০০ সৈন্যবাহিনীর এক উচ্চপদে নিয়োগ করে ‘সরকার’ সম্ভল-এর দায়িত্ব দেন। পরে এই মুবারিজ খান-ই রাজদরবারের রাজনীতিতে শান্তির পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন। এইভাবে পুরাতন বিশিষ্ট অভিজাতদের স্থলে তিনি তাঁর শূরবংশের অনুগত অভিজাতদের বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন।

মুঘলদের গতিবিধির ওপর ইসলাম শাহর নজর

  • (১) সুলতান মুঘলদের গতিবিধির দিকে যথেষ্ট নজর রেখেছিলেন। যখন তিনি জানতে পারেন যে হুমায়ুন সিন্ধু অতিক্রম করেছেন, তখন তিনি অসুস্থতা সত্ত্বেও শত্রুর বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং তার ফলে হুমায়ুন কাবুল ফিরে যান।
  • (২) ইসলাম শাহ তারপর তাঁর অতি প্রিয় স্থান গোয়ালিয়রে ফিরে যান। এখানে অসন্তুষ্ট কিছু অভিজাত তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করলে, তা ব্যর্থ হয়। এই ষড়যন্ত্রের প্রধান নায়কদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তিনি তাঁর জীবনের প্রথমদিকেও এইরকম এক হত্যার ষড়যন্ত্র থেকে কোনোক্রমে বেঁচে যান।

ইসলাম শাহর শাসনতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা

  • (১) সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে জালাল খানের শাসনতান্ত্রিক দক্ষতার পরিচয়ের ঐতিহাসিক তথ্য আমরা যৎসামান্যই পেয়েছি। তবে তাঁর পিতা যেভাবে জালালকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন সামরিক অভিযানে সহযোগিতার জন্য নিয়োগ করেছিলেন, তাতে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, সিংহাসনে আরোহণের পূর্বেই তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে শাসনতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন।
  • (২) সম্ভবত তাঁর পিতার অনুসৃত শাসনব্যবস্থাকেই তিনি দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করতেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি সুন্নি মুসলমান হলেও রাজনীতি ও শাসনের ক্ষেত্রে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন।

শক্তিশালী শাসক ইসলাম শাহ

  • (১) তাঁর পিতার মতোই তিনি একজন শক্তিশালী শাসক ও নিয়মনিষ্ঠ ছিলেন। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যে অভিজাতদের নির্মমভাবে দমন করতেও তিনি কুণ্ঠাবোধ করেন নি। অবাধ্যতা তিনি কোনোক্রমেই সহ্য করতে পারতেন না।
  • (২) যে যেখানে যে পদেই থাকুন, প্রত্যেককেই তাঁকে মান্য করতে তিনি বাধ্য করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে যে-কোনো তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাকেও তিনি অত্যন্ত কঠোর দৃষ্টিতে দেখতেন। সমগ্র সাম্রাজ্যে তাঁর কর্তৃত্ব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • (৩) দক্ষ গুপ্তচর ব্যবস্থা ও ডাক-চৌকি ব্যবস্থা তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। নরপতির সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে তিনি পূর্ণ সচেতন ছিলেন। উজ্জ্বল লাল রং তিনিই একমাত্র ব্যবহারের অধিকারী ছিলেন। যে-কোনো অভিজাতের পক্ষেও উজ্জ্বল লাল রং ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল।

সুলতান ইসলাম শাহর নরপতিত্বের আদর্শ

তাঁর নরপতিত্বের আদর্শ পিতা শের শাহের থেকে স্বতন্ত্র ছিল। বরং তাঁর নরপতিত্বের আদর্শ মুঘলদের ভগবান প্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাসের নিকটবর্তী ছিল। তিনি তাঁর পিতার অনুসৃত শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু যেখানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করলে উন্নতি ঘটবে বলে মনে করতেন, তা তিনি করতে দ্বিধা বোধ করতেন না।

ইসলাম শাহ সম্পর্কে বদায়ুনির মন্তব্য

বদাউনি বলেছেন, সরকারের প্রতিটি বিভাগের, এমনকি রাজস্ব ও ধর্মীয় ক্ষেত্রের সবরকম আইন রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জারি করতেন, তা শরিয়ৎ-আইনের বিরুদ্ধে অথবা সপক্ষে গেলেও তিনি পিছিয়ে আসতেন না।

সুলতান ইসলাম শাহর লিখিত আদেশ

  • (১) ইসলাম শাহ তাঁর আদেশগুলি লিখিতভাবে তাঁর কর্মচারীদের কাছে পাঠাবার নিয়ম চালু করেন। তিনি উদ্বিগ্ন থাকতেন রাষ্ট্রের অভিজাত ও প্রজাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে। প্রতিটি জেলায় দরবার বসত প্রতি শুক্রবার।
  • (২) এই দরবারে সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের শ্রদ্ধাবনতচিত্তে সুলতানকে প্রণিপাত করতে হত। ঐতিহাসিক বদায়ুনি যখন বালক ছিলেন, তখন তিনি এইরকম একটি দরবার বসতে স্বচক্ষে দেখেছিলেন।

ইসলাম শাহর সেনাবাহিনী সংগঠন

বদায়ুনির মতে, সেনাবাহিনীকে দক্ষতা ও সাংগঠনিক উন্নতির জন্য তাদের দশমিক প্রথায় বিভাজন করেন। পরবর্তী সময়ে আকবর এই দশমিক প্রথায় তাঁর মনসবদারি ব্যবস্থায় সেনার সংখ্যা নির্ধারণ করেন। এই সৈন্যবিভাজনের সবচেয়ে কম সংখ্যা ছিল ৫০, আর বেশি সংখ্যা ছিল ২০,০০০।

সুলতান ইসলাম শাহ কর্তৃক সরাই নির্মান

  • (১) শের শাহ রাস্তার ধারে প্রতি চার মাইল অন্তর একটি ‘সরাই’ নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু ইসলাম শাহ তাঁর পিতার তৈরি সরাইগুলির উন্নতি ও কাজের সুবিধার জন্য প্রতি দু মাইল অন্তর আর একটি করে নতুন ‘সরাই’ নির্মাণ করেন।
  • (২) এই সরাইগুলিতে রান্না করা ও রান্না না-করা দ্রব্যসামগ্রী পোস্টাল বিভাগের মুসলিম ও অমুসলিম কর্মচারীদের ও পথিকদের জন্য মজুত রাখা হত। তবে উলসি হেগ Cambridge History of India গ্রন্থে প্রতি দু’মাইল অন্তর এই সরাইগুলির পিছনে অজস্র খরচকে অপচয় বলে মন্তব্য করেছেন।

ইসলাম শাহর প্রচণ্ড পরিশ্রম

  • (১) সাম্রাজ্য রক্ষার্থে তিনি যেমন একদিকে যোগ্য সেনাপতি ছিলেন, আবার অপরদিকে যোগ্য শাসক হিসাবে সাম্রাজ্যের স্বার্থে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর সাম্রাজ্য ছিল তাঁর পিতার সাম্রাজ্যের সম্প্রসারিত রূপ।
  • (২) সিংহাসনে আরোহণের পর তাঁর ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ দিনগুলিতেও সাম্রাজ্যের শান্তি ও সমৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তাঁর পিতার মতোই কৃষির উন্নতির জন্য এবং কৃষকের কল্যাণের জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন।

সুলতান ইসলাম শাহর নিষ্ঠুরতা

  • (১) শাসক হিসাবে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও মানুষ চেনার ক্ষমতা তাঁর ছিল না এবং আফগান অভিজাতদের প্রতি যে নির্মমতা ও নৃশংসতা দেখিয়েছেন, তাতে তিনি যে নিষ্ঠুর ছিলেন তা বলা যায়। এক্ষেত্রে তাঁর রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। নিজে আফগান জাতি সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও আফগান জাতির মানসিকতা চিনতে ভুল করেছিলেন।
  • (২) রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা হেতু ইব্রাহিম লোদির আফগান জাতির প্রতি এই নিষ্ঠুর ব্যবহারই যেমন প্রথম আফগান সাম্রাজ্যের পতন ঘটাতে সাহায্য করেছিল। এক্ষেত্রেও বলা যায়, ইসলাম শাহের আফগান জাতির প্রতি এই নিষ্ঠুর ব্যবহারই তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত আফগান সাম্রাজ্যকে দ্বিতীয়বার টুকরো টুকরো করতে সাহায্য করে।
  • (৩) অথচ তাঁর পিতা এই আফগান জাতিকেই জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে নবজাগরিত মুঘলশক্তির পতন ঘটিয়ে দ্বিতীয়বার আফগান সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ইসলাম শাহর রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাব

  • (১) মনুষ্য-চরিত্র সম্পর্কে তিনি যে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন তিনি মুবারিজ খানের মতো এক অযোগ্য নিকট আত্মীয়কে ‘সরকার’ সম্ভল-এর দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং সামরিক বিভাগের এক উচ্চপদে তাঁকে নিয়োগ করেন।
  • (২) পরবর্তীকালে এই মুবারিজ খান-ই তাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারী ফিরোজ খানকে হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। স্বভাবতই বলা যায়, তাঁর রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার অভাবের জন্যই তাঁর পুত্রকে প্রাণ দিয়ে পিতার ভুলের মাশুল দিতে হয়।

উপসংহার :- এইভাবে ন’বছর ছ’মাস রাজত্ব করার পর ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ নভেম্বর সুলতান ইসলাম শাহ দেহত্যাগ করেন।

(FAQ) সুলতান ইসলাম শাহ সুরি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. শেরশাহের পর কে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন?

ইসলাম শাহ সুরী।

২. ইসলাম শাহের প্রকৃত নাম কি?

জালাল খান।

৩. ইসলাম শাহের রাজত্বকাল কত?

১৫৪৫-১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দ।

৪. ইসলাম শাহের পর কে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন?

ফিরোজ শাহ।

Leave a Comment