মৌর্য সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা প্রসঙ্গে তার জন্ম, পাটলিপুত্রে আগমন, সংঘমিত্রার পিতা অশোকের বৌদ্ধ ধর্ম গ্ৰহণ, ধর্ম প্রচার , বৌদ্ধগাথা সম্বন্ধে সংঘমিত্রার জ্ঞান লাভ, ত্যাগ ও সংযমী সংঘমিত্রা, ধর্মানুরাগী, বৌদ্ধ ধর্মের জন্য মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রাকে উৎসর্গ, রাজপ্রাসাদ পরিত্যাগ সম্পর্কে জানবো।
সম্রাট অশোক ও তার বৌদ্ধ রাণী দেবীর কন্যা সংঘমিত্রা প্রসঙ্গে সংঘমিত্রার জন্ম কাহিনী, সংঘমিত্রার যমজ ভাই মহেন্দ্র, বৌদ্ধগাথা সম্বন্ধে সংঘমিত্রার জ্ঞান লাভ, ধর্মানুরাগী সংঘমিত্রা, বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারে সংঘমিত্রার সিংহল যাত্রা সম্পর্কে জানব।
অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা
ঐতিহাসিক চরিত্র | সংঘমিত্রা |
পরিচিতি | বৌদ্ধ ভিক্ষুণী |
পিতা | সম্রাট অশোক |
জন্ম | উজ্জয়িনী |
ধর্ম | বৌদ্ধ ধর্ম |
ধর্ম প্রচারে গমন | সিংহল |
ভূমিকা :- মহানুভব মহারাজ অশোকের নাম জগৎপ্রসিদ্ধ। মৌর্য সাম্রাজ্য-এর শ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোকের কন্যা ছিলেন সংঘমিত্রা।
সংঘমিত্রার জন্ম কাহিনী
সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রার জন্মের একটু ইতিহাস আছে। পিতা বিন্দুসার-এর রাজত্বকালে অশোক উজ্জয়িনীর শাসনকর্তারূপে সেখানে বাস করতেন। সে সময়ে পিতার অজ্ঞাতে তিনি সেখানকার এক সুন্দরী শ্রেষ্ঠি কন্যাকে বিবাহ করেন। একথা বিন্দুসার পাটলিপুত্র-এ থেকে কিছুই জানতে পারলেন না। এই পত্নীর গর্ভে মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রার জন্ম হয়।
সংঘমিত্রার পাটলিপুত্রে আগমন
পিতার মৃত্যুর পর অশোক যখন সম্রাট হলেন তখন মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রা কিছুদিন পরে পত্নীর সাথে পাটলিপুত্রে আগমন করেন।
সংঘমিত্রার পিতা অশোকের বৌদ্ধ ধর্ম গ্ৰহণ
উপগুপ্ত নামে একজন প্রসিদ্ধ বৌদ্ধসন্ন্যাসীর নিকট বৌদ্ধধর্মের বিবিধ উপদেশ শুনে রাজা অশোক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হলেন। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা লাভ করবার পর তিনি রাজধানীতে এক বৌদ্ধ মহাসভা আহ্বান করলেন এবং বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের পরামর্শ মত এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের নানা স্থানে বৌদ্ধ প্রচারক প্রেরণ করলেন।
ধর্মপ্রচারে সংঘমিত্রা
এবার অস্ত্রশস্ত্রের পরিবর্তে তাঁর প্রেরিত অনুচররা ধর্মের বিজয়-বার্তা বহন করে পৃথিবী জয়ে বার হলেন। এমন কি সমদর্শী অশোক তাঁর পুত্র মহেন্দ্র এবং কন্যা সংঘমিত্রাকে পর্যন্ত সিংহলে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য প্রেরণ করেছিলেন।
বৌদ্ধগাথা সম্বন্ধে সংঘমিত্রার জ্ঞান লাভ
অশোক পুত্র ও কন্যাকে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কিত বিবিধ নীতিকথা সম্বন্ধে শিক্ষাদান করলেন। সংঘমিত্রা সমস্ত বৌদ্ধগাথা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেছিলেন।
ত্যাগ ও সংযমী সংঘমিত্রা
সংঘমিত্রা বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করবার সঙ্গে সঙ্গে সংসার বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়লেন। রাজকন্যা হয়েও তাঁর কোন গর্ব ছিল না, বিলাস ছিল না। কি বসনভূষণে, কি সাজলজ্জায় – সব বিষয়েই ছিল তাঁর ত্যাগ ও সংযম। রাজকুমারী হয়েও সংঘমিত্রা ভিক্ষুণীদের সাথে মিশতেন। মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রা উভয়েই সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা ও প্রীতি লাভ করেছিলেন।
ধর্মানুরাগিনী সংঘমিত্রা
সংঘমিত্রা এইরূপ ভাবে ধর্মালোচনা করতে করতে সম্পূর্ণভাবে ধর্মানুরাগিনী হয়ে পড়লেন।
অশোকের বিরাট দান সভার আয়োজন
সম্রাট অশোকের দানসভায় উপস্থিত ভিক্ষুসঙ্ঘের প্রধান নেতা মহাস্থবির তিস্য বললেন, “যিনি পুত্র বা কন্যাকে ধর্মের জন্য উৎসর্গ করতে পারেন বা করতে পেরেছেন, তিনিই বৌদ্ধর্মের প্রধান ও প্রকৃত পোষক।”
বৌদ্ধ ধর্মের জন্য মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রাকে উৎসর্গ
সেই সভাস্থলে সংঘমিত্রা ও মহেন্দ্ৰ উপস্থিত ছিলেন। সম্রাট মহাস্থবিরকে বললেন, “তাই হোক। আমি আমার পুত্র মহেন্দ্র এবং কন্যা সংঘমিত্রাকে বৌদ্ধধর্মের জন্য উৎসর্গ করলাম।”
সহস্র নরনারী কণ্ঠধ্বনি
তখন সহস্র সহস্র নরনারীর কণ্ঠে ধ্বনিত হল –
“বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।
ধর্ম্মং শরণং গচ্ছামি ।
সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি ॥
সংঘমিত্রার রাজপ্রাসাদ পরিত্যাগ
বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণের নাম উপসম্পদা। সংঘমিত্র এই উপসম্পদা গ্রহণ করলেন। সংঘমিত্রা রাজপ্রাসাদ পরিত্যাগ করে মঠে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। তাঁহার ধর্মনিষ্ঠা, ইন্দ্রিয় সংযম, ধর্মোপদেশ এবং মহৎ আদর্শে বহু ধনী ব্যক্তির কন্যাও তাঁর পদানুসরণ করতে লাগলেন।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারে সংঘমিত্রার সিংহল গমন
অবশেষে মহাস্থবির তিষ্যের আদেশে সংঘমিত্রা ভ্রাতা মহেন্দ্রের সাথে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য সিংহল গমন করলেন।
সিংহলের রাজপ্রাসাদে সংঘমিত্রার উপস্থিতি
সিংহলের নৃপতি যখন জানতে পারলেন যে, মহারাজ অশোক তাঁর পুত্র ও কন্যাকে সিংহলে বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য প্রেরণ করেছেন, তখন তিনি তাঁদেকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেলেন।
সিংহলে সংঘমিত্রার সুমধুর উপদেশ
তাঁদের আগমনবার্তা সিংহলে সর্বত্র প্রচারিত হলে সিংহলের নরনারীগণ তাঁদেরকে দেখবার জন্য এবং তাঁদের উপদেশ শুনবার জন্য রাজপ্রাসাদে এসে উপস্থিত হতে লাগল। সংঘমিত্রার সুমধুর উপদেশ শ্রবণ করে সিংহলের মহিলাগণ দলে দলে এসে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা লাভ করতে লাগলেন।
সংঘমিত্রার আদর্শে সিংহল রাজকন্যা ও অন্যান্যদের বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা
- (১) তাঁদের অসাধারণ শক্তিপ্রভাবে সিংহলের প্রত্যেক নগরে ও গ্রামে বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠিত হল। সিংহলরাজ্যের সর্বত্র ধর্মের স্রোত প্রবাহিত হল। সিংহল-রাজকুমারী অনুলা এবং তাঁর পাচশ সহচরী সংঘমিত্রার আদর্শে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষালাভ করে ভিক্ষুণীব্রত গ্রহণ করলেন এবং রাজপ্রাসাদ পরিত্যাগ করে মহামেঘ নামক উদ্যানে গিয়ে বাস করতে লাগলেন।
- (২) অনুলার আদর্শে সিংহলের সম্ভ্রান্তবংশীয় মহিলারাও দলে দলে এসে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিতা হলেন। এইভাবে সংঘমিত্রার চেষ্টা-যত্নে এবং অনুলার সহায়তায় সিংহলে ভিক্ষুণী সংঘ গঠিত হল। এইভাবে সিংহলে বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠিত হইষবার পর সিংহলের অধিপতিও বৌদ্ধধর্ম অবলম্বন করলেন। সিংহল-নৃপতি অশোকের আদর্শ অনুসরণ করে রাজ্যমধ্যে ধর্মনীতি ও সুশিক্ষা প্রদানের জন্য ব্যাকুল হলেন।
সংঘমিত্রার কাছে বোধিবৃক্ষের শাখা প্রার্থনা
একদিন সিংহল-নৃপতি ও তাঁর কন্যা সংঘমিত্রাকে বললেন, “দেবি! যে বোধিবৃক্ষের শান্তশীতল ছায়াতলে বসিয়া ভগবান বুদ্ধদেব দিব্যজ্ঞান লাভ করিয়াছিলেন এবং নির্বাণমুক্তি লাভ করিয়াছিলেন, আপনি যদি সেই পবিত্ৰ বৃক্ষের একটি শাখা সিংহলে আনিয়া রোপণ করিবার ব্যবস্থা করেন, তাহা হইলে এদেশের পরম কল্যাণ সাধিত হয়।”
সংঘমিত্রা কর্তৃক সিংহলে বোধিবৃক্ষের শাখা রোপন
ধর্মানুরাগিনী সংঘমিত্রা ভারতবর্ষ থেকে বোধিবৃক্ষের একটি শাখা সিংহলে নিয়ে এলে পর, মহাউৎসব-এর সাথে সেটি সিংহলে রোপিত হয়েছিল।
উপসংহার :- একজন রাজকুমারীর পক্ষে ধর্মের জন্য ভিক্ষুণীব্রত গ্রহণ, ধর্মনীতি ও ধর্মশিক্ষাব ভিতর দিয়ে জীবন যাপন এবং দ্বারে দ্বারে ঘুরে ধর্ম প্রচার করা একমাত্র ভারত মহিলার পক্ষেই সম্ভবপর। সংঘমিত্রার নাম জগতের ইতিহাসে স্বর্ণ অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে, তাঁর নাম কেউ কোনো দিন ভুলতে পারবে না।
(FAQ) মৌর্য সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মৌর্য সম্রাট অশোকের কন্যা।
সিংহলে।
উজ্জয়িনীতে।
অশোকের পুত্র মহেন্দ্র।