দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভার্সাই সন্ধির দায়িত্ব প্রসঙ্গে জবরদস্তিমূলক সন্ধি, ভীতি প্রদর্শন, অমর্যাদাকর চুক্তি, ক্ষতিপূরণের বোঝা, সামরিক শক্তি হ্রাস, উপনিবেশ দখল, শিল্প সমৃদ্ধ অঞ্চল দখল ও জার্মান জনগণের বিরোধিতা সম্পর্কে জানবো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভার্সাই সন্ধির দায়িত্ব
ঐতিহাসিক ঘটনা | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভার্সাই সন্ধির দায়িত্ব |
ভার্সাই সন্ধি | ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ |
প্রেক্ষাপট | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ |
চোদ্দো দফা শর্ত | উড্রো উইলসন |
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ | ১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ |
ভূমিকা :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যেই ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। এই বিশ্বযুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অপেক্ষা অনেক বেশি বিধ্বংসী ও ভয়াবহ ছিল। এই যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ কোটি, আহত প্রায় চার কোটি এবং বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই কোনও-না-কোনও ভাবে এই মহাযুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভার্সাই সন্ধির দায়িত্ব
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য অনেকেই ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভার্সাই সন্ধিকে দায়ী করে থাকেন। তাঁদের মতে, ভার্সাই সন্ধির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল। যেমন –
(১) জবরদস্তিমূলক সন্ধি
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ভার্সাইয়ে সমবেত নেতৃমণ্ডলী নিছক প্রতিশোধ-স্পৃহা দ্বারা পরিচালিত হয়ে পরাজিত জার্মানির উপর এই অপমানজনক, প্রতিশোধমূলক, স্বার্থপর ও সর্বনাশা ভার্সাই চুক্তি বলপূর্বক চাপিয়ে দেন। ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার এই চুক্তিকে বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া ‘জবরদস্তিমূলক চুক্তি’ বলে অভিহিত করেছেন।”
(২) ভীতি প্রদর্শন
চুক্তি স্বাক্ষরকালে জার্মান প্রতিনিধিদের কোনোরকম মতামত প্রকাশের সুযোগ না দিয়ে সম্পূর্ণ ভীতির পরিবেশে তাদের এই চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করা হয়।
(৩) লয়েড জর্জের মন্তব্য
ইংল্যান্ড -এর প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ বলেছিলেন যে, “শহিদের রক্তে এই চুক্তি লেখা হয়েছে। জার্মানি যদি এখানে চুক্তি স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে, তাহলে জার্মানিতে বসিয়ে তাদের এই চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হবে।”
(৪) একতরফা চুক্তি
এই ‘একতরফা চুক্তি’ পালন করার কোনও নৈতিক দায়িত্ব জার্মানি বোধ করে নি। এছাড়া, এই চুক্তি স্বাক্ষরকালে জার্মান প্রতিনিধিদের সামরিক প্রহরাধীনে রেখে যেভাবে কয়েদির মতো ব্যবহার করা হয়, তা জার্মান জাতির মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে এবং তারা এই চুক্তি নস্যাৎ করতে বদ্ধপরিকর হয়।
(৫) অমর্যাদাকর চুক্তি
এই চুক্তির ৪৪০টি ধারার অধিকাংশ শর্তই ছিল জার্মানির পক্ষে অতি অমর্যাদাকর এবং সেগুলির মূল উদ্দেশ্য ছিল জার্মানিকে স্থায়ীভাবে হীনবল ও পঙ্গু করে রাখা।
(৬) ক্ষতিপূরণের বোঝা
একতরফাভাবে জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী বলে ঘোষণা করে যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মান জাতির উপর যে বিশাল পরিমাণ ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তা দেওয়ার ক্ষমতা জার্মানির ছিল না। এই ক্ষতিপূরণের বোঝা জার্মানির বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দেয়।
(৭) শিল্প সমৃদ্ধ অঞ্চল দখল
ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ ছাড়াও, জার্মানি মিত্রপক্ষকে লোহা, কয়লা, রবার প্রভৃতি কাঁচামাল সরবরাহ করতে বাধ্য হয় এবং তার শিল্পসমৃদ্ধ সার অঞ্চলের উপর ফ্রান্সের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
(৮) জার্মানির উপনিবেশ দখল
জার্মানির উপনিবেশগুলি কেড়ে নিয়ে, সেগুলিকে স্বাধীনতা দেওয়ার পরিবর্তে মিত্রপক্ষীয়রা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।
(৯) সামরিক শক্তি হ্রাস
জার্মানির সামরিক শক্তি হ্রাস করে জার্মানিকে ক্ষুদ্র দেশ বেলজিয়ামের চেয়েও হীনবল করা হয়।
(১০) আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার থেকে বঞ্চিত
আমেরিকার রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের চোদ্দো দফা শর্তে যে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা জার্মানির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় নি, বরং বহু জার্মান ভাষাভাষী অঞ্চলকে জার্মানি থেকে বিচ্ছিন্ন করে চেকোশ্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড প্রভৃতি রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
(১১) ভার্সাই সন্ধি দ্বারা জার্মানি প্রায় ২৫ হাজার বর্গমাইল এলাকা, ৭০ লক্ষ অধিবাসী, শতকরা ১৫ ভাগ কর্ষণযোগ্য ভূমি এবং শতকরা ১২ ভাগ শিল্পকেন্দ্র থেকে বঞ্চিত হয়।
(১২) জার্মান জনগণের বিরোধিতা
জার্মানির পক্ষে এই অসম্মানজনক ও মর্যাদাহানিকর চুক্তি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। জার্মান জনমানস তাই শুরু থেকেই এই চুক্তির বিরোধিতা করতে থাকে।
(১৩) হিটলারের যুদ্ধ
হিটলার ও নাৎসি দল এই চুক্তির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং একের পর এক এর শর্তাদি লঙ্ঘন করতে থাকেন। অনেকে তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ‘হিটলারের যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেন।
উডওয়ার্ডের মন্তব্য
ই. এল. উডওয়ার্ড বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হল হিটলারের যুদ্ধ। তিনি এই যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন, তিনিই যুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত তিনিই পরাজিত হয়েছিলেন।”
উপসংহার :- অধ্যাপক এ. জে. পি. টেলর বলেন যে, হিটলারের অনেকগুলি দাবিই ছিল ন্যায্য। জার্মানির ন্যায্য দাবিগুলি পূরণ করে জার্মানিকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের সীমানায় ফিরিয়ে দিলেই জার্মানি সন্তুষ্ট হত – যুদ্ধের পরিস্থিতি বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সৃষ্টি হত না।
(FAQ) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভার্সাই সন্ধির দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মিত্রপক্ষ ও জার্মানির মধ্যে।
ভার্সাই সন্ধি।
১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ।