মহীশূর রাজ্যের পতনের কারণ হিসেবে কূটনীতি প্রয়োগে ব্যর্থতা, উপযুক্ত পর্যবেক্ষণের অভাব, দেশীয় শক্তির সাহায্য লাভে ব্যর্থ, মনরোর অভিমত, সামগ্রিক নিরাপত্তার প্রতি অবহেলা, অশ্বারোহী বাহিনী হ্রাস, ইংরেজদের উন্নত রণকৌশল ও সামরিক দক্ষতা, অপরাজেয় ইংরেজ শক্তি, টিপুর আত্মরক্ষামূলক নীতি, ত্রুটিপূর্ণ যুদ্ধ নীতি, মহীবুল হাসানের অভিমত ও কর্মচারীদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানবো।
মহীশূর রাজ্যের পতনের কারণ
ঐতিহাসিক ঘটনা | মহীশূর রাজ্যের পতনের কারণ |
সময়কাল | ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ |
যুদ্ধ | চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ |
বিবাদমান পক্ষ | মহীশূরের টিপু সুলতান ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি |
ফলাফল | ইংরেজদের সাফল্য |
ভূমিকা:- ঐতিহাসিক উইলকস্ মন্তব্য করেছেন যে, মহীশূর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য হায়দার আলি এবং তা ধ্বংস করার জন্য টিপু সুলতান জন্মগ্রহণ করেন। এই ধরনের মন্তব্যে কিছুটা সত্যতা থাকলেও তা সম্পূর্ণভাবে মেনে নেওয়া যায় না।
মহীশূর রাজ্যের পতনের কারণ
টিপু সুলতান বা মহীশূর রাজ্যের পতনের পশ্চাতে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল। যেমন –
(১) কূটনীতি প্রয়োগে ব্যর্থতা
দেশপ্রেমিক ও বীর যোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও পিতা হায়দার আলির বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি, কূটকৌশল ও বিচক্ষণতা পুত্র টিপু সুলতানের ছিল না। ইংরেজদের প্রতিরোধ করার জন্য দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য শক্তিগুলি থেকে ইংরেজদের বিচ্ছিন্ন করা অপরিহার্য ছিল। টিপু সুলতান এই ধরনের কূটনীতি প্রয়োগের কথা চিন্তা করেন নি।
(২) উপযুক্ত পর্যবেক্ষণের অভাব
টিপু সুলতান যুদ্ধ ও শাসন ব্যবস্থার সব দিকে নিজেই নজর দিতেন। খুঁটিনাটি সব বিষয়ে নজর দিতে গিয়ে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি উপযুক্তভাবে নজর দিতে পারেন নি। এর ফল রাষ্ট্রের পক্ষে মঙ্গলজনক হয় নি।
(৩) দেশীয় শক্তির সাহায্য লাভে ব্যর্থ
ইংরেজরা টিপুর বিরুদ্ধে মারাঠা ও নিজামের সাহায্য পেয়েছিল। টিপু কিন্তু কোনও দেশীয় শক্তির সাহায্য পান নি। বলা হয় যে, টিপু যদি মারাঠা সাহায্য পেতেন, তাহলে যুদ্ধের ইতিহাস অন্যরকম হত। টিপু নির্ভর করেছিলেন ফরাসি সাহায্যের ওপর, যা বস্তুত কোনও উপকারেই আসেনি।
(৪) মনরোর অভিমত
ইংরেজ সেনাপতি মনরো বলেন যে, তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ -এর সময় লর্ড কর্ণওয়ালিস মারাঠা সাহায্য না পেলে যুদ্ধের ইতিহাস অন্যরকম হত।
(৫) সামগ্রিক নিরাপত্তার প্রতি অবহেলা
টিপু রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তমের নিরাপত্তার ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে তিনি রাজধানী অবরোধ হওয়া সম্পর্কে অতিরিক্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন। এর জন্য প্রয়োজনীয় সব মালপত্র তিনি রাজধানীতে গুদামজাত করেন। রাজধানীর নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে তিনি রাজ্যের সামগ্রিক নিরাপত্তার প্রতি অবহেলা করেন।
(৬) অশ্বারোহী বাহিনী হ্রাস
ইংরেজদের বিরুদ্ধে হায়দার আলির সাফল্যের মূলে ছিল তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী। টিপু সুলতান অশ্বারোহী বাহিনীর সংখ্যা হ্রাস করে পদাতিক বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। এর ফল ভালো হয় নি। টিপুর আমলে ইংরেজরা একটি সুদক্ষ অশ্বারোহী বাহিনী গড়ে তুলে তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে এবং অপরপক্ষে, টিপুর পদাতিক বাহিনীও বন্দুক ও কামানে সজ্জিত ইংরেজ পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে পেরে ওঠে নি।
(৭) ইংরেজদের উন্নত রণকৌশল ও সামরিক দক্ষতা
সামগ্রিকভাবে ব্রিটিশ বাহিনীর রণকৌশল ও সামরিক দক্ষতা মহীশূরের বাহিনী অপেক্ষা অনেক উন্নত ছিল।
(৮) অপরাজেয় ইংরেজ শক্তি
ভারত-এর বৃহত্তর অংশ জয় করে ইংরেজ সেনাদল তখন একরকম অপরাজেয় হয়ে ওঠে। এই রকম একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেশি দিন কারও পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। টিপুর ক্ষেত্রেও অস্বাভাবিক কিছু হয় নি।
(৯) টিপুর আত্মরক্ষামূলক নীতি
হায়দার আলির নীতি ছিল আক্রমণাত্মক—তিনি সর্বদা ইংরেজদের চাপের মধ্যে রাখতেন। অপরপক্ষে, টিপুর নীতি ছিল আত্মরক্ষামূলক। এর ফলে ইংরেজরা সুবিধাজনক নীতি গ্রহণ করার সময় পেয়ে যেত।
(১০) যুদ্ধ নীতিতে ত্রুটি
চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধকালে তিনি যদি শ্রীরঙ্গপত্তম রক্ষার জন্য বসে না থেকে বরামহলের ওপর আক্রমণ হানতেন, তাহলে ইংরেজদের যাবতীয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত, কিন্তু তিনি তা করেন নি।
(১১) মহীবুল হাসানের অভিমত
ঐতিহাসিক ডঃ মহীবুল হাসান বলেন যে, টিপু সুলতান যুদ্ধ অপেক্ষা শান্তির কৌশলেই অধিক উৎসাহী ছিলেন।
(১২) কর্মচারীদের ষড়যন্ত্র
সর্বশেষে বলা যায় যে, টিপুর কর্মচারীদের একটি অংশ তাঁর বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এই সব কারণে মহীশূর রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী ছিল।
উপসংহার:- হায়দার আলি যে শক্তিশালী মহীশূর রাজ্য গঠন করেছিলেন ইংরেজরা চারটি যুদ্ধের (প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ, দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ, তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ ও চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ) মাধ্যমে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে তার পতন ঘটায়।
(FAQ) মহীশূর রাজ্যের পতনের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
হায়দার আলি।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সময় ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে।
শ্রীরঙ্গপত্তম।
চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ বা শ্রীরঙ্গপত্তমের যুদ্ধের সময় ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে।