সামন্ত প্রভুর ক্ষমতা ও কার্যাবলী

সামন্ত প্রভুর ক্ষমতা ও কার্যাবলী প্রসঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামন্তপ্রভুর ক্ষমতা হিসেবে আভিজাত্য প্রকাশ, স্বাধীন প্রশাসনিক প্রধান, কর আদায়, যুদ্ধ, জনকল্যাণ, বিলাসিতা, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামন্তপ্রভুর কার্যাবলি হিসেবে শাসন ও আইন সংক্রান্ত কাজ, বিচার করা, সৈন্য সহায়তা ও সামন্ত প্রভুর প্রতি আনুগত্য সম্পর্কে জানবো।

ভূমির মালিক সামন্ত প্রভুর ক্ষমতা ও কার্যাবলী প্রসঙ্গে সামন্তপ্রভুর আভিজাত্য প্রকাশ, স্বাধীন প্রশাসনিক প্রধান সামন্তপ্রভু, সামন্তপ্রভুর কর আদায়, সামন্তপ্রভুর যুদ্ধ, সামন্তপ্রভুর কাজ জনকল্যাণ, সামন্তপ্রভুর আইন সংক্রান্ত কাজ ও সামন্তপ্রভুর আভিজাত্য প্রকাশ সম্পর্কে জানব।

সামন্ত প্রভুর ক্ষমতা ও কার্যাবলী

ঐতিহাসিক ঘটনাসামন্তপ্রভুর ক্ষমতা ও কার্যাবলী
বেগার শ্রমকর্ভি
প্রশাসনিক কাজআইন প্রণয়ন, বিচার
জনকল্যাণরাস্তাঘাট, জলাশয় নির্মাণ
দুজন সামন্তপ্রভুর যুদ্ধডুয়েল
দুটি দলের যুদ্ধটুর্নামেন্ট
সামন্ত প্রভুর ক্ষমতা ও কার্যাবলী

ভূমিকা :- সামন্তপ্রভুরা কৃষকের শ্রম শোষণ করে উৎপাদন কার্য সচল রাখতেন। কৃষকের শ্রমে প্রভু বিপুল সম্পত্তির মালিক হতেন এবং বিলাস-বৈভবে জীবন কাটাতেন। তাঁরা দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত বিশাল প্রাসাদোপম বাসভবনে বসবাস করতেন।

সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামন্তপ্রভুর ক্ষমতা

সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তরের সামন্তপ্রভু সামন্ততন্ত্র-এর পিরামিড-কাঠামের বিভিন্ন স্তরে অবস্থান করতেন। এই ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হওয়ায় বিভিন্ন স্থানীয় সামন্তপ্রভু প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হতেন। সামন্তপ্রভুরা দেশের সর্বোচ্চ শাসক অর্থাৎ সম্রাটের প্রতি নামে মাত্র আনুগত্য জানিয়ে নিজ নিজ এলাকায় কার্যত স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করতেন। সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা নীচে আলোচনা করা হল –

(ক) আভিজাত্য প্রকাশ

সামন্তপ্রভুরা ছিলেন সমাজের উচ্চবিত্ত ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ। যে কেউ ইচ্ছা করলেই এই অভিজাত শ্রেণির সদস্য হতে পারত না। রাজা কখনও কাউকে আভিজাত্যের পদবি দান করলে তবেই একমাত্র কোনো ব্যক্তি অভিজাত গোষ্ঠীর সদস্য হতে পারত। সামন্তপ্রভুর পরিবারের সামাজিক সম্পর্ক একমাত্র অভিজাত পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত।

(খ) স্বাধীন প্রশাসনিক প্রধান

সামন্তপ্রভুরা নিজ নিজ এলাকায় প্রায় স্বাধীনভাবে প্রশাসন পরিচালনা করতেন। স্থানীয় অঞ্চলের অধীনস্থ প্রজাদের ওপর তাদের সীমাহীন আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। তারা নিজ নিজ শাসনাঞ্চলে দুর্গ নির্মাণ করতেন, আইন প্রণয়ন করতেন এবং বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। কোনো কোনো সামন্তপ্রভু দুর্বল কেন্দ্রীয় শাসন উপেক্ষা করে নিজ জমিদারি অঞ্চলে পৃথক মুদ্রার প্রচলন করতেন। এই ভাবে সামন্তপ্রভু রাষ্ট্রের ভেতর অপর একটি ক্ষুদ্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি করে ফেলতেন ৷

(গ) কর আদায়

সামন্তপ্রভু তাঁর নিজ শাসনাঞ্চলের প্রজাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর আদায় করতেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ভূমিকর, উৎপাদন কর, সম্পত্তি কর, বিবাহ কর প্রভৃতি। এ ছাড়াও সামন্তপ্রভুর নির্মিত রাস্তাঘাট, পশুচারণভূমি, জলাশয়, বন প্রভৃতি ব্যবহারের জন্য প্রজাকে কর দিতে হত। প্রভু তাঁর অধীনস্থ প্রজাদের কাছ থেকে কর্ভি নামে বেগার শ্রম আদায় করতেন এবং নিয়মিত নতুন নতুন কর আরোপ করতেন।

(ঘ) জনকল্যাণ

  • (১) সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রজারা তাদের ঊর্ধ্বতন সামন্তপ্রভুর হাতে নিজের সম্পত্তি সমর্পণ করত এবং তাঁর প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য জানাত। এর বিনিময়ে প্রভু তাঁর অধীনস্থ প্রজার জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন। সামন্তপ্রভু বেশ কিছু জনকল্যাণমূলক কাজও করতেন।
  • (২) তিনি নিজ এলাকায় পুরোনো রাস্তাঘাট, সাঁকো, খাল প্রভৃতি মেরামত করতেন এবং নতুন রাস্তাঘাট, সাঁকো, খাল, জলাশয় প্রভৃতি নির্মাণ করতেন। তিনি, নিজ এলাকায় কৃষকের পণ্য ক্রয়বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে বাজার বসাতেন এবং কৃষকের পশুচারণের সুবিধার্থে ভূমি প্রদান করতেন।

(ঙ) যুদ্ধ

  • (১) নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সামন্তপ্রভু প্রায়ই নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তেন। ভূসম্পত্তি ও ভূমিদাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করাই ছিল এই যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য। যুদ্ধে জয়লাভ করে কোনো সামন্তপ্রভু পরাজিত সামন্তের ভূখণ্ড ও তাঁর অধীনস্থ প্রজাদের ওপর নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতেন।
  • (২) এভাবে কোনো কোনো সামন্তপ্রভুর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেত এবং তাঁর শাসনাঞ্চলের প্রসার ঘটত। কোনো কোনো শক্তিশালী সামন্তপ্রভুর ক্ষমতা এতটাই বৃদ্ধি পেত যে তিনি অনেক সময় রাজাকেও উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ এলাকায় শাসন পরিচালনা করতেন।

(চ) বিলাসিতা

  • (১) সামন্তপ্রভুরা নিজেরা প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁরা কৃষকের শ্রম শোষণ করে উৎপাদন কার্য সচল রাখতেন। কৃষকের শ্রমে প্রভু বিপুল সম্পত্তির মালিক হতেন এবং বিলাস-বৈভবে জীবন কাটাতেন। তাঁরা দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত বিশাল প্রাসাদোপম বাসভবনে বসবাস করতেন।
  • (২) প্রভুদের কোনো শ্রম দিতে হত না বলে তাঁদের জীবনে সীমাহীন অবসর ছিল। আমোদ-প্রমোদ, যুদ্ধ, শিকার প্রভৃতিতে যুক্ত থেকে তাঁরা তাদের অবসর সময় কাটাতেন। তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ ছিল তাঁদের অবসর বিনোদনের অন্যতম খেলা। দুজনের মধ্যে তলোয়ার-যুদ্ধকে ‘ডুয়েল’ এবং দুটি দলের মধ্যে তলোয়ার-যুদ্ধকে ‘টুর্নামেন্ট’ বলা হত।

সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামন্তপ্রভুর কার্যাবলি

ইউরোপের সামন্তপ্রভুরা নিজেদের শাসনতান্ত্রিক অঞ্চলের যাবতীয় ক্ষমতা ভোগ করতেন। যেমন –

(১) শাসন ও আইন-সংক্রান্ত কাজ

তাঁরা ছিলেন নিজ শাসনাধীন অঞ্চলের প্রধান শাসক। নিজ এলাকায় দুর্গ নির্মাণ করে সামন্তপ্রভু তাঁর শাসনাধীন এলাকার শাসন পরিচালনা করতেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতেন।

(২) জনকল্যাণের কাজ

সামন্তপ্রভু তাঁর শাসন এলাকার রাস্তাঘাট, খাল, সাঁকো প্রভৃতি নির্মাণ ও সংস্কার করতেন।

(৩) বিচার করা

তিনি তাঁর অধীনস্থ এলাকায় বসবাসকারী প্রজাদের অন্যায়-অবিচারের প্রতিকার করতেন এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি নিজ এলাকায় একটি বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করতেন।

(৪) কর আদায়

নিজ এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে সামন্তপ্রভু কর বা খাজনা আদায় করতেন, এমনকি কখনো-কখনো নিজ নামে মুদ্রাও প্রচলন করতেন। তিনি উৎপাদন কর, সম্পত্তি কর-সহ বিভিন্ন ধরনের কর আদায় করতেন।

(৫) সৈন্য সহায়তা

বহিরাগত শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে তিনি রাজাকে প্রয়োজনের সময় সৈন্য দিয়ে সহায়তা করতেন।

সামন্ততন্ত্রে প্রভুর প্রতি আনুগত্য

ঊর্ধ্বতন সামন্তপ্রভুর কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা লাভ করার বিনিময়ে অধস্তন সামন্ত তাঁর ঊর্ধ্বতন প্রভুর প্রতি বিভিন্ন ধরনের আনুগত্য প্রদর্শন করতেন। যেমন –

  • (১) একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কোনো অধস্তন সামন্ত তাঁর ঊর্ধ্বতন সামন্তপ্রভুর প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করতেন এবং এরপর ঊর্ধ্বতন প্রভুর কাছ থেকে সে তার ‘ফিফ’ বা জমি লাভ করতেন।
  • (২) অধীনস্থ সামন্ত তাঁর ঊর্ধ্বতন প্রভুর কাছ থেকে জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা লাভ করতেন এবং এর বিনিময়ে প্রভুকে বিভিন্ন ধরনের কর প্রদান করতেন।
  • (৩) সামন্তপ্রভু তাঁর অধীনস্থ সামন্তের অঞ্চলের ওপর দিয়ে ভ্রমণ করলে প্রভু ও তাঁর সঙ্গীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হত সেখানকার অধস্তন সামন্ত বা প্রজাকে।
  • (৪) বৈদেশিক আক্রমণ বা অন্য কোনো প্রয়োজনে অধস্তন সামন্ত তার ঊর্ধ্বতন সামন্তপ্রভুকে সৈন্য সরবরাহ করে সহায়তা করতেন। অধস্তনের কাছ থেকে প্রাপ্ত সামরিক সহায়তাই ছিল ঊর্ধ্বতন প্রভুর শক্তির প্রধান উৎস।
  • (৫) অধস্তন সামন্তদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল তাঁর ঊর্ধ্বতন সামন্তপ্রভুর আদালতে উপস্থিত হওয়া।
  • (৬) প্রভুর সংকটকালে অধস্তন সামন্ত সংকট কাটানোর দায়িত্ব নিতেন এবং এই উদ্দেশ্যে উর্ধ্বতন প্রভুকে ‘স্কুটেজ’ নামে এক প্রকার কর দিতে বাধ্য হতেন।
  • (৭) সামন্তপ্রভুর কন্যার বিবাহ উপলক্ষ্যে, পুত্রের নাইট হওয়ার সময় এবং প্রভু কখনও বন্দি হলে তাঁর মুক্তির জন্য অধীনস্থ সামন্ত বা প্রজাকে কর দিতে হত।

উপসংহার :- ইউরোপের ইতিহাসে সামন্ততন্ত্র এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে অনেক সময় মধ্যযুগকেই সামন্ততান্ত্রিক যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

(FAQ) সামন্ত প্রভুর ক্ষমতা ও কার্যাবলী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সামন্তপ্রভুরা সমাজের কোন সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন?

উচ্চবিত্ত ও অভিজাত।

২. সামন্ততান্ত্রিক অঞ্চলের আইন প্রণয়ন ও বিচারকার্য পরিচালনা করতেন কারা?

সামন্তপ্রভুরা।

৩. সামন্তপ্রভুরা কৃষকদের কাছ থেকে যে বেগার শ্রম আদায় করতেন তার নাম কি?

কর্ভি।

৪. দুজন সামন্তপ্রভুর মধ্যে তলোয়ার যুদ্ধকে কি বলা হয়

ডুয়েল।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment