দিল্লি সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রসঙ্গে সুলতানী শাসন ব্যবস্থা, ইসলামীয় রাষ্ট্রের প্রকৃতি, দিল্লি সুলতানীর ওপর ইসলামীয় রাষ্ট্রের প্রভাব, ধর্ম নিরপেক্ষ নয়, উলেমা শ্রেণির প্রভাব, উলেমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা, সমন্বয়বাদী রাষ্ট্রাদর্শ, খলিফাবাদের তাত্ত্বিক প্রয়োগ, শরিয়তি বিধানের বিচ্যুতি, ধর্মাশ্রিত রাজতন্ত্র নয়, পুলিশি শাসন ও প্রজাকল্যাণকামী রাষ্ট্র সম্পর্কে জানবো।
দিল্লি সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি
ঐতিহাসিক ঘটনা | দিল্লি সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি |
ইসলামীয় রাষ্ট্রের প্রভূ | আল্লাহ |
উলেমা | শরিয়তের ব্যাখ্যাকার |
খলিফার ফর্মান ত্যাগ | আলাউদ্দিন খলজি |
ভূমিকা :- পয়গম্বর হজরত মহম্মদ-এর আবির্ভাবের পর থেকে খলিফাদের আমল পর্যন্ত বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে ইসলামীয় রাষ্ট্র সম্পর্কে একটি বিশেষ ধ্যান-ধারণা গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত ইসলামীয় রাষ্ট্রগুলিতে সেই চিন্তাধারার প্রভাব পড়ে।
সুলতানী শাসন ব্যবস্থা
দিল্লীর সুলতানি শাসন ব্যবস্থাও তার বাইরে ছিল না। সুতরাং দিল্লীর সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিচার করতে হলে, আগে ইসলামীয় রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলি কি তা জানা দরকার।
ইসলামীয় রাষ্ট্রের প্রকৃতি
ডঃ মহম্মদ কুরেশি প্রমুখ গবেষক ইসলামীয় রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে বলেছেন যে,
(১) ইসলামীয় চিন্তাধারা অনুযায়ী ‘আল্লাহ’ হলেন রাষ্ট্রের প্রভু ও প্রকৃত মালিক। ইসলামীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ইসলামে প্রথম ধর্মের চিন্তাধারা রূপ নেয়, পরে রাষ্ট্রের ধারণা দেখা দেয়। ধর্মকে বাদ দিয়ে ইসলামে রাষ্ট্র চিন্তা করা সম্ভব নয়।
(২) ইসলামীয় রাষ্ট্র চিন্তা তিনটি মৌলিক বিষয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যথা –
- (ক) ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরাণের বিধি ও আদেশ রাষ্ট্র মেনে চলতে বাধ্য। কোরাণ হল আল্লাহর বাণী। এই কোরাণের ভিত্তিতে যে আইন বিধি রচিত হয় তা হল শরিয়ৎ। আল্লাহর নির্দেশের ভিত্তিতেই শরিয়তের বিধান রচিত হয়। সুতরাং প্রকৃত ইসলামীয় রাষ্ট্র কোরাণ শরীফ ও শরিয়ত মানতে বাধ্য।
- (খ) ইসলামীয় রাষ্ট্র চিন্তায় বিশ্বের সকল মুসলিম রাষ্ট্র কেবলমাত্র এক সার্বভৌম শাসকের অধীন। আদিতে তিনি ছিলেন পয়গম্বর। তাঁর তিরোধানের পর খলিফাগণই সকল ইসলামীয় রাষ্ট্রের অধিপতি। ঈশ্বরের তরফে পয়গম্বর এবং তাঁর তরফে খলিফাগণই সকল ইসলামীয় রাষ্ট্রের ওপর সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতীক। কাজেই ইসলামে আর কোনো দ্বিতীয় sovereign বা সার্বভৌম শাসক নেই। ইসলামীয় রাষ্ট্রের শাসনকর্তারা সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না। তাঁরা হলেন খলিফাদের নায়েব।
- (গ) ইসলামীয় রাষ্ট্রে মিল্লাত হল রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি। মিল্লাত হল ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগণের ভ্রাতৃত্ব।
(৩) ইসলামীয় রাষ্ট্র চিন্তায় রাষ্ট্রের এই তিনটি বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক এবং অভিন্ন বলে মনে করা হয়। ইসলামীয় রাষ্ট্রের আইন বিধিগুলি শরিয়ত অনুযায়ী রচিত হয়। সাধারণত উলেমাশ্রেণীই ছিলেন শরিয়তের ব্যাখ্যাকারী।
(৪) মুসলিম ধর্মীয় আইন অনুসারে রাষ্ট্রের প্রজাদের তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা –
- (ক) মিল্লাত অর্থাৎ ইসলাম ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়,
- (খ) আইন-ই-কিতাব অর্থাৎ ধর্মশাস্ত্রে অন্য যে সকল সম্প্রদায়ের নাম পাওয়া যায় (ইহুদি, খ্রিষ্টান প্রভৃতি) তারা হল জিম্মি।
- (গ) বাকি অন্যান্য সম্প্রদায় যারা ছিল পৌত্তলিক। এই শেষোক্ত সম্প্রদায়ের কোনো অধিকার ধর্মশাস্ত্রে নেই।
দিল্লি সুলতানীর ওপর ইসলামীয় রাষ্ট্রের প্রভাব
- (১) আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় যে, দিল্লীর সুলতানরাও ইসলামীয় বিধি অনুসারে খলিফাকে তাদের প্রভু বলে গণ্য করতেন। একমাত্র আলাউদ্দিন খলজি ব্যতীত সকল সুলতান খলিফার ফর্মান সমাদরের সঙ্গে গ্রহণ করেন। তারা এই ফর্মান পেয়ে, নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করতেন।
- (২) গিয়াসউদ্দিন বলবন-এর মত আত্মগর্বী সুলতানও নিজেকে খলিফার নায়েব বলে ঘোষণা করেন। তারা “নাসির-ই-আমির-উল-মোমিনিন” বা খলিফার সহকারী উপাধি নেন। অথবা তাঁরা “ইয়ামিন-উল-খলিফা” বা খলিফার সহকারী বলে নিজেদের গণ্য করতেন।
সুলতানী রাষ্ট্রে উলেমাদের পরামর্শ
দিল্লী সুলতানরা তাদের রাষ্ট্রের আইনবিধি রচনার সময়ে উলেমাদের পরামর্শ নিতেন। শরিয়ত-সম্মত আইনবিধি রচনার জন্য তাঁরা সর্বদা যত্ন নিতেন। মুসলিম ধর্মগুরু ও পণ্ডিতরা শরিয়ত অনুযায়ী সুলতানের ১২টি কর্তব্য নির্ধারণ করেন। একমাত্র মহম্মদ বিন তুঘলক ছাড়া সকল সুলতান এই ১২টি কার্যবিধির মধ্যেই নিজেদের আবদ্ধ রাখেন।”
ত্রিপাঠীর অভিমত
ডঃ আর. পি. ত্রিপাঠীর মতে, “মুসলিম রাষ্ট্র ছিল ধর্ম ও পুরোহিত নিয়ন্ত্রিত।” মুসলিম রাষ্ট্রে সকল আইন বিধিগুলি ধর্মের স্বার্থে রচিত হয়।
ঈশ্বরীপ্রসাদের অভিমত
ডঃ ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, “মধ্যযুগের ভারত-এ রাষ্ট্র ছিল ধর্মাশ্রিত। সুলতান ছিলেন একাধারে সিজার এবং পোপ (Caesar and Pope)। তার আধিপত্য শরিয়ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। এই রাষ্ট্রে উলেমাশ্রেণী উচ্চ ক্ষমতা ভোগ করতেন”।
সুলতানী রাষ্ট্র ধর্ম নিরপেক্ষ নয়
- (১) সুলতানী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য ছিল যে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ছিল মিল্লাত অর্থাৎ মুসলিম ভ্রাতৃত্বের হাতে। তাদের পক্ষে খলিফা তা ভোগ করতেন। যেহেতু দিল্লী সুলতানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজারা ছিল অ-মুসলিম, সেহেতু সুলতান নিজেকে খলিফার প্রতিনিধি বলে গণ্য করতেন।
- (২) যদি তারা প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ সুলতান হতেন তবে খলিফাতন্ত্রের ধোঁয়াটে ও শিথিল সার্বভৌমত্ব তারা বরণ করতেন না। সুলতানগণ নিজেদের ইসলামের ভারপ্রাপ্ত রক্ষক রূপে গণ্য করতেন না। উলেমা নাসিরুদ্দিন গজনভী সুলতান ইলতুৎমিস-এর দরবারে সুলতানি রাষ্ট্রের যে ৪টি প্রধান কর্তব্য নির্দেশ করেন তা ছিল শরিয়ত নির্ধারিত নিয়মবিধি।।
দিল্লি সুলতানী রাষ্ট্রে উলেমা শ্রেণীর প্রভাব
- (১) সুলতানি আমলে উলেমাগণ ছিলেন রাষ্ট্রে বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। যদিও উলেমাতন্ত্র কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র পায়নি এবং উলেমাগণ বংশানুক্রমিকভাবে পদ ভোগ করতেন না, তথাপি তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের প্রভাব যথেষ্ট খাটাতেন।
- (২) তারা শরিয়তী আইনের ব্যাখ্যাকার ছিলেন। কোনো সুলতান (আলাউদ্দিন ছাড়া) শরিয়ত অগ্রাহ্য করে আইনবিধি রচনা ও রাষ্ট্র পরিচালনা করতে সাহস করতেন না। সুতরাং এক শ্রেণীর গবেষক বলেন যে, সুলতানি রাষ্ট্র ছিল ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্র (Theocracy)।
সুলতানী রাষ্ট্রে উলেমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা
- (১) সুলতানি রাষ্ট্রের উপরোক্ত ব্যাখা হল নিতান্ত তাত্ত্বিক। গভীরভাবে বিচার করলে দেখা যাবে যে বাস্তব ক্ষেত্রে দিল্লি সুলতানি ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্র (Theocracy) ছিল না। ডঃ আই এইচ কুরেশীর মতে, “শরিয়তের প্রাধান্যবশত অনেকে সুলতানিকে ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্র হিসেবে ভুল করেন।”
- (২) এই রাষ্ট্রে উলেমাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠন ছিল না। উলেমাগণ প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিতেন না। উলেমা বা ধর্মীয় আইনের ব্যাখ্যাকারীরা ধর্মশাস্ত্রের নিয়ম বিধির উর্দ্ধে ছিলেন না।
হাবিবের অভিমত
ডঃ মহম্মদ হাবিবের মতে, “মধ্য যুগের ভারতের রাষ্ট্রকে কোনো অর্থে ‘ধর্মাশ্রিত পুরোহিত তন্ত্র বলা যায় না। এই রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা”।”
দিল্লী সুলতানীর সমন্বয়বাদী রাষ্ট্রাদর্শ
সুলতানরা যে শাসনব্যবস্থা ভারতে প্রবর্তন করেন তা ছিল একটি সমন্বয়বাদী মিশ্রিত শাসনব্যবস্থা কট্টর ইসলামীয় শরীয়তী শাসন তাঁরা ভারতে কখনও চালু করেন নি। এই শাসনব্যবস্থা আরবীয়-পারসিক এবং ভারতীয় ভাবধারার সমন্বয়ে গঠিত হয়। আরবীয় খলিফাবাদ, পারসিক রাজতন্ত্রবাদ এবং ভারতীয় গ্রামীণ স্বায়ত্বশাসনের সমন্বয়ে এই শাসনব্যবস্থা গঠিত হয়।
সুলতানী রাষ্ট্রে খলিফাবাদের তাত্ত্বিক প্রয়োগ
- (১) সুলতানগণ যদিও খলিফার প্রতি তাদের আনুগত্য জানাতেন, তা ছিল তাত্ত্বিক। সুলতানগণ সিংহাসনে তাদের ক্ষমতাকে দৃঢ় করার জন্য এবং মুসলিম অভিজাতদের সাংবিধানিক আগ্রাসন থেকে সুলতানি সিংহাসনকে সুরক্ষিত করার জন্যই, খলিফার ফর্মানকে উচ্চ স্থান দিতেন।
- (২) এই আনুগত্য ছিল উপযোগবাদী। ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আন্তরিক ভক্তি থেকে খলিফার প্রতি এই আনুগত্য দেওয়া হয়নি। সুলতানি সিংহাসনের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্যই খলিফার ফর্মানকে ব্যবহার করা হয়
সুলতানী রাষ্ট্রে শরিয়তী বিধানের বিচ্যুতি
ডঃ মুজিবের মতে, দিল্লীর সুলতানি বহু ক্ষেত্রে শরিয়তী বিধান থেকে বিচ্যুত হয়। যেমন –
- (১) শরিয়তের বিধানে যে সকল প্রজা “ধর্মশাস্ত্র অনুমোদিত নয়” অর্থাৎ পৌত্তলিক তাদের কোনো অধিকার স্বীকার করা হয় নি। দিল্লীর সুলতানরা ভারতের অমুসলিম প্রজাদের প্রতি শরিয়তের এই নীতি প্রয়োগ করেন নি।
- (২) তাঁরা জানতেন যে, পৌত্তলিক অ-মুসলিমদের প্রতি নিরন্তর বৈষম্যমূলক আচরণ ও নিপীড়ন করা সম্ভব ছিল না। বৃহত্তর অ-মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস ও জীবনধারায় তাঁরা হস্তক্ষেপ করা থেকে মোটামুটি বিরত থাকেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক-এর মত ধর্মভীরু সুলতান স্বীকার করেন যে, ভারতে অ-মুসলিমদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ করা আদপেই সম্ভব নয়।
- (৩) অ-মুসলিমদের মধ্যে সম্পতি-ঘটিত ও বিভিন্ন বিবাদ হিন্দু পণ্ডিতদের সহায়তায়, হিন্দু আইন অনুযায়ী নিস্পত্তি করা হত।
- (৪) সুলতানি যুগে গ্রামগুলির দৈনন্দিন কাজকর্ম ও শাসন স্থানীয় গ্রাম সভাগুলিই করত। সুলতানরা তাতে বিশেষ হস্তক্ষেপ করতেন না।
- (৫) আলাউদ্দিন খলজি ও সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক রাষ্ট্র শাসনের জন্য উলেমাদের পরামর্শ দানের অধিকার অগ্রাহ্য করেন।
- (৬) দিল্লীর সুলতানদের ক্ষমতা উলেমা, মিল্লাত বা খলিফার ওপর প্রকৃতপক্ষে নির্ভরশীল ছিল না। ফিরোজ তুঘলক ব্যতীত অন্যান্য সুলতানরা নিজ ব্যক্তিত্ব ও সামরিক ক্ষমতার দ্বারা এই সিংহাসন লাভ ও তা রক্ষা করেন।
- (৭) তারা উলেমাদের কাছ থেকে ততটা সাহায্য নেন, যতটা সাহায্য তাদের রাজনৈতিক প্রয়োজনকে সিদ্ধ করে। তাঁরা তত্ত্বগত দিক থেকে ইসলামীয় আচরণবিধি ও শরিয়তী নির্দেশ মানার কথা বললেও হাতে কলমে বহু ক্ষেত্রে তা মানেন নি।
সুলতানী রাষ্ট্রে বল প্রয়োগ ও সুবিধাবাদ
সুলতানি যুগের ইতিহাসকাররা দিল্লীর সুলতানি রাষ্ট্রকে ইসলামিক রাষ্ট্র বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে সুলতানি শাসন তা ছিল না। কারণ,
- (১) খাঁটি ইসলামে রাজতান্ত্রিক আদর্শ বলে কিছু নেই। কারণ, আল্লাহ হলেন রাষ্ট্রের প্রভু। ইসলামীয় রাষ্ট্রে এই কারণে কোনো ও রাজার স্থান ছিল না। কিন্তু পারসিক প্রভাবে ভারতীয় সুলতানগণ শক্তির গুরুত্ব এবং রাজতান্ত্রিক আদর্শ গ্রহণ করেন। উলেমাগণ এই বিচ্যুতির কথা জানতেন। এজন্য তাঁরা বলতে থাকেন যে ইসলামের রক্ষার জন্যই সুলতানি রাজপদ গঠন করা হয়েছে।
- (২) কিন্তু সুলতানি যুগের ইতিহাস একথা প্রমাণ করে যে, সুলতান বলপ্রয়োগ এবং সুযোগবাদকে (force and expediency) তাদের একমাত্র কর্মপন্থা ও নীতি হিসেবে নেন। ইসলামের স্থাপন ও বিস্তৃতি তাদের নীতি ছিল না।
- (৩) শরিয়তকে তাঁরা রাষ্ট্রের আর পাঁচটা আইনের মতই গণ্য করতেন। ইসলামে মুসলমানের প্রাণদণ্ড নিষিদ্ধ হলেও, ফিরোজ শাহ ব্যতীত অন্যান্য সুলতানরা এই দণ্ড দিতেন। রাষ্ট্রের স্বার্থে তারা এই কাজ করতেন।
- (৪) শরিয়তে সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ হলেও সুলতানি যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সুদে টাকা লেনদেন হত। আমীর খসরুর মতে, টঙ্কা-পিছু এক জিতল সুদ সরকারী আইন বৈধ ছিল। উলেমাগণও বৈষয়িক লোভ ও ক্ষমতার লোভের উর্দ্ধে ছিলেন না। তাদের মধ্যে অনেকেই পদের লোভে শরিয়তের কথা ভুলতেন।
সুলতানী রাষ্ট্র ধর্মাশ্রিত রাজতন্ত্র নয়
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, ভারতে সুলতানি রাষ্ট্র ইসলামীয় ও ভারতীয় ভাবধারার সমন্বয়ের ওপর স্থাপিত ছিল। তাত্বিক দিক থেকে সুলতানিকে ইসলামীয় রাষ্ট্র বলে মনে হলেও বাস্তবে তা কখনও উলেমা নিয়ন্ত্রিত ধর্মাশ্রিত রাজতন্ত্র ছিল না।
সুলতানী রাষ্ট্রে পুলিশি শাসন
- (১) এখন প্রশ্ন আসে যে, যদি সুলতানি শাসন ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্রের ধারণার ওপর স্থাপিত না হয়, তবে এই রাষ্ট্রের প্রকৃতি কি ছিল? এ বিষয়ে কোনো কোনো গবেষকদের মতে, সুলতানি রাষ্ট্র ছিল আসলে পুলিশ রাষ্ট্র (A police state)।
- (২) দেশরক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও রাজস্ব আদায় ছিল এই রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য। অন্যান্য ক্ষেত্রে যথা সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই রাষ্ট্র কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে, হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে (Laissez faire)।
প্রাজাকল্যাণকামী সুলতানী রাষ্ট্র
- (১) একশ্রেণীর গবেষকের মতে সুলতানি শাসন ছিল সংস্কৃতি ও সৃজনধর্মী শাসন। প্রজাদের মঙ্গল সাধন এই রাষ্ট্রের কখনও প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল না। সুলতানগণ এতই ক্ষমতালোভী ছিলেন যে, তাদের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খার জন্য দরকার হলে তাঁরা ধর্মীয় নির্দেশাবলীও ভাঙ্গতেন।
- (২) তাদের নীতি এই ছিল যে, জনগণই রাষ্ট্রের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করতে বাধ্য, রাষ্ট্র জনগণের জন্য কোনো ধ্রুব লক্ষ্য নিতে বাধ্য নয়। মুসলিম প্রজাদের জন্য কোনো কোনো সুলতান কিছু জনহিতকর ব্যবস্থা অনিচ্ছাকৃতভাবে নিলেও, অ-মুসলিম প্রজাদের জন্য তাদের বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না।
- (৩) ফিরোজ তুঘলকের মত কোনো কোনো সুলতান মুসলিম প্রজা হিতকর কিছু কাজ নিজ সুখ্যাতি ও বিবেকের জন্য করেন। সুলতান আলাউদ্দিন তাঁর মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি সংস্কারগুলি সামরিক স্বার্থেই করেন।
- (৪) সুলতানগণ স্থাপত্য ও সংস্কৃতির যে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন তা জাতীয় সংস্কৃতির অগ্রগতির জন্য করা হয়নি। সুলতানদের নিজ নিজ খ্যাতি ও মহিমা প্রচারের জন্যই তা করা হয়।
ভারতের মত বিশাল দেশে জনজীবনের বিভিন্ন দিকে সৃজনমূলক প্রেরণাদানের ক্ষমতা তাদের ছিল না। কাজেই এই সকল দিকের দায়িত্ব স্থানীয় জনগণের হাতেই ন্যস্ত ছিল। কাজেই মুঘল যুগের আগে Culture State অর্থাৎ সৃজনধর্মী, সংস্কৃতিবান ও প্রজা কল্যাণকামী রাষ্ট্র বলতে যা বুঝায় তা সুলতানি যুগে গড়ে ওঠেনি।
উপসংহার :- ডঃ মুজিবের মতে, “দিল্লীর সুলতানি শাসন ছিল প্রকৃতিতে একটি এককেন্দ্রিক সরকার। বাস্তব ক্ষেত্রে তা ছিল কতকগুলি সামরিক শাসনকর্তাদের দ্বারা শাসিত অর্ধ স্বাধীন ভৌগোলিক অঞ্চলের দ্বারা গঠিত রাষ্ট্রমণ্ডল”।
(FAQ) দিল্লি সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ডঃ মুজিব।
হজরত মহম্মদ।
আল্লাহ।
আলাউদ্দিন খলজি ও মহম্মদ বিন তুঘলক।