ভারতে রাজত্বকারী মোঘল সাম্রাজ্যের সম্রাটদের অন্দরমহল প্রসঙ্গে মোগল সম্রাটদের অন্দরমহল হারেম, অন্দরমহলের পত্নী, উপপত্নী, অন্দরমহলের পরিচারিকা, অন্দরমহলের প্রহরী, অন্দরমহলের ভৃত্য ও অন্দরমহলের ইতিহাস সম্পর্কে জানব।
মোঘল সম্রাটের অন্দরমহল
ঐতিহাসিক বিষয় | মোঘল সম্রাটের অন্দরমহল |
সাম্রাজ্য | মোঘল সাম্রাজ্য |
রাজধানী | আগ্রা ও দিল্লি |
প্রতিষ্ঠাতা | বাবর |
শ্রেষ্ঠ সম্রাট | আকবর |
শেষ সম্রাট | দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ |
মোগল সম্রাটদের অন্দরমহল, তাদের ভাষায় যার নাম হারেম। সে ছিল এক অভূতপূৰ্ব স্বশাসিত সমাজ বিশেষ৷ হারেম চিরকাল আমাদের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করে এসেছে। কিন্তু অজস্ৰ প্ৰহরী, খোজা ভৃত্য, রূপসী পরিচারিকার দুর্ভেদ্য প্রহরাকে অতিক্ৰম করে কারও পক্ষে সেখানের পুরোপুরি ইতিহাস তুলে ধরা সম্ভব হয় নি ৷ বাবরের পিতা ওমর শেখ মির্জা থেকে শুরু করে এখনও হায়দ্রাবাদের নবাবদের হারেম নিতান্ত গবেষণার বিষয়। কারও হারেম ছিল রাজপ্রাসাদের নিদিষ্ট এক অন্তঃপুরে, কারও হারেম কোনো প্রাসাদের কোনো ক্ষুদ্ৰ অংশ নয়, ছিল একটা গোটা শহর। কারও হারেমে ছিলেন হয়তো দশটি বা তার কাছাকাছি নারী, আবার শোনা যায় আকবরের হারেমে পাঁচ হাজার মহিলা ছিলেন। মনে রাখতে হবে এরা সকলেই বিবাহিত পাত্রী ছিলেন না। বেশির ভাগই ছিলেন উপপত্নী শ্রেণীর উপভোগের পাত্ৰী ৷ তার বিস্তারিত বিবরণ স্বয়ং সমাটগণই দিতে পারতেন কিনা সন্দেহ।
মোগল সাম্ৰাজ্যের বিস্তার বাবরকে দিয়ে শুরু হয়ে ঔরঙ্গজেবের পরেও কিছুকাল বিস্তারিত ছিল। কিন্তু সত্যি কথা বলতে বাবরকে দিয়ে এই সাম্রাজ্যের প্রবেশ এবং ঔরঙ্গজেবকে দিয়েই এর যথার্থ প্রস্থান ঘটে। এর পরেও যারা ছিলেন ( বাহাদুরশাহ থেকে ) তারা এই বিশাল নাটকের উল্লেখযোগ্য কুশীলব ছিলেন না। সেজন্য বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান আর ঔরঙ্গজেবকে নিয়েই আমাদের অন্দরমহলের আসর বসিয়েছি ৷ এঁদের বিবাহিত স্ত্রী এবং উপপত্নীদের বিস্তারিত বিবরণ কোথাও পাওয়া যায় না। কল্পনাশক্তিকে প্রখর করে আমরা অনৈতিহাসিক কিছু লেখার ব্যাপারে উৎসাহও খুব একটা পাই নি ৷ ইতিহাসে যাদের বিশ্বাসযোগ্য উল্লেখ আছে, তাঁদেরই আমরা উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। এসব বিবরণ বলা বাহুল্য মুসলমান ঐতিহাসিকগণ যেমন কিছু পরিমাণে লিখে গেছেন, তেমনি সম্ৰাটগণ বা সম্ৰাট পরিবারের কোনো কোনো ব্যক্তিরাও লিখে গেছেন ৷ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বিভিন্ন বিদেশী পরিব্ৰাজক, দূত বা তথাকথিত ইতিহাস ব্যবসায়ীদের কিছু রচনাও। সবটাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ফলে বিচারবুদ্ধিকে জাগ্রত রেখে তবেই তথ্যকে গ্রহণ করতে হয়েছে। পারতপক্ষে ইতিহাস বহির্ভূত কোনো বিষয়কে আমরা গ্রহণ করতে নারাজ হয়েছি।
সম্রাটদের পত্নী-উপপত্নী-রক্ষিতাদের কথা ছাড়াও অন্দরমহলের চারটি কন্যার কথাও আমরা আলোচনা করব। কারণ এরা অন্দরমহলের চিত্রটিকে বহুলাংশে সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করেছেন। এরা হলেন বাবর-কন্যা গুলবদন বেগম, শাহজাহান-কন্যা জাহানারা ও রোশনারা বেগম এবং ঔরঙ্গজেব-কন্যা জেবউন্নিসা বেগম। আসলে এতেও চিত্র সম্পূর্ণ হয় না। প্রত্যেক মোগল সম্রাট মানুষ হয়েছিলেন তাদের গর্ভধারিণীর লালনে নয়, বরং ধাত্রীমাতাদের স্নেহে। এই ধাইমা এবং দুধমায়েরা মোগল অন্দরমহলের এক বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণকারিণী ছিলেন। আকবরের ধাত্রীমাতা মাহম অনগা তো রাজ্যশাসনেও গৌণভাবে অংশ গ্রহণ করতেন। তেমনি ছিলেন কয়েকজন বিখ্যাত পরিচারিকা বা সঙ্গিনী। যেমন সতী-উন্নিসা। এই সতী-উন্নিসা ছিলেন মমতাজমহলের সঙ্গিনী – অভিজাতবংশের কন্যা। জাহাঙ্গীর তাকে Prince of poets উপাধি দেন। কবিতা, ভেষজবিদ্যা, কোরাণ ধর্মশাস্ত্রে ছিল তার আশ্চর্য অধিকার ৷ মমতাজের দেহাবসান হলে তিনি তার মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যাবার সম্মান পান। সমস্ত রাজকীয় বিবাহে তিনি কনের বাড়িতে উপহার বয়ে নিয়ে যেতেন। আবার বিয়েতে সম্ৰাট বা সম্ৰাটপুত্ৰরা যা পেতেন, যেমন দারার বিয়েতে – সেই সব উপহার সব গুছিয়ে রাখতেন তিনিই। আসলে তিনিই ছিলেন হারেমের অধ্যক্ষা
নিজের কোনো সন্তান না থাকায় ভাই তালিবার দুটি মেয়েকে পোষ্য হিসাবে মানুষ করেন। ভালবেসে তাদের বিবাহ দেন। এই সতী-উন্নিসার মতো কতো পরিচারিকারাই এই অন্দরমহলের প্রতি পরতে সংযুক্ত। তেমনি ছিল
অজস্র খোজা আর হাবশী প্রহরীরা। এদের সকলের কথা বললেই হয়তো ছবিটি আরও পূর্ণাঙ্গ হত।
ছবি আরও পূর্ণাঙ্গ হত যদি মোগল অন্তঃপুরিকাদের জীবনের আরও খুঁটিনাটি দেওয়া যেত ৷ কেমন করে ঘোড়ায় চড়ে তারা পোলো খেলতেন, কেমন করে তারা সাজপোশাক পরতেন (নূরজাহান তো নতুন পোশাকই
বানাতেন ), কেমন করে আকবর জীবন্ত উলঙ্গ ক্রীতদাসীদের ছকে বসিয়ে ঘুটি খেলতেন, সে সব উদ্দামতার ছবি দিতে পারলে বেশ ভাল হত। সব কথা তো সব জায়গায় দেওয়া যায় না। আমার মূল লক্ষ্য হল মোগল সম্রাটদের পত্নী-উপপত্নীদের – তাদের প্রেম-ভালবাসা-অবহেলা-রাজনীতি নিয়ে একটা বিশ্বাসযোগ্য চিত্র রচনা করা। তথ্যের অপ্রতুলতা এই চিত্ৰকে পূর্ণরূপ দিতে দেয় নি সত্য, কিন্তু একটা জীবনধারা তাতে ধরা পড়ে গেছে।
ঔরঙ্গজেবের প্রতিদিনের যে রুটিন ছিল তার মধ্যে হারেমেরও একট নির্দিষ্ট স্থান ছিল। শাহজাহান হারেমে যেতেন দুপুর বারোটায় এবং রাত সাড়ে আটটায়। রাতে গিয়ে প্রথমে শুনতেন গানবাজনা, তারপর পত্নীদের কাছে । মোটামুটি রাত সাড়ে দশটা থেকে ভোর সাড়ে চারটে ছিল পত্নীদের সান্নিধ্যে তার নিদ্রার সময়। রাত্রে ঘুমোবার আগে তিনি নিয়মিত পড়াশুনো করতেন ৷ ভারী পর্দার আড়ালে বসে অন্য মেয়েরা তার উচ্চৈঃস্বরে পাঠ শুনতেন। তিনি পড়ে শোনাতেন ভ্রমণকাহিনী, সন্তকাহিনী বা কখনও তৈমুর বা বাবরের আত্মজীবনীর অংশ। ঔরঙ্গজেবও হারেমে যেতেন দুপুর পৌনে বারোটা নাগাদ। খাওয়াদাওয়ার পর ঘণ্টাখানেক ঘুমোতেন৷ আবার রাত্রি আটটায় হারেমে গিয়ে প্রার্থনা ও ধ্যান করার পর তবে আহার-শয়নাদি করতেন। বাবর-আকবরের সময়ের কোনো ঠিকই ছিল না ।
এই প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে আমি অনেক বই-ই দেখেছি। Dowson & Elliot সম্পাদিত মোগল ঐতিহাসিকদের বিবরণী আমার খুব কাজে লেগেছে। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত তারিক-ই আকবরী গ্রন্থ অনেক
সাহায্য করেছে। প্রেমময় দাশগুপ্ত অনূদিত গুলবদনের বিবরণ থেকে আমি উদ্ধৃতি দিয়েছি। যদুনাথ সরকার, কালিদাস নাগের যথোচিত সাহায্য গ্রহণ করেছি। তাছাড়া বাবর-জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী, বার্ণিয়ার, টমাস রো, মানুচি, তাভারনিয়ার সকলের কাছে আমি বিপুল পরিমানে ঋণী।
(FAQ) মোঘল সম্রাটের অন্দরমহল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য
১। ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে?
বাবর।
২। মোঘল সম্রাটের অন্দরমহল তাদের ভাষায় কী নামে পরিচিত?
হারেম।
৩। আকবরের হারেমে কতজন মহিলা ছিলেন বলে সোনা যায়?
পাঁচ হাজার
৪। মোঘল সম্রাটের অন্দরমহলে করা থাকত?
অজস্ৰ প্ৰহরী, খোজা ভৃত্য, রূপসী পরিচারিকা, পত্নী, উপপত্নী প্রমুখ।