ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রনীতি

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক ম্যাকিয়াভেলি, গ্রন্থ রচনা, মানব প্রকৃতি, ধর্ম ও নীতিবোধ , রাষ্ট্র ক্ষমতা তত্ত্ব, রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য, রাষ্ট্র ও সরকারের স্বরূপ, রাজতন্ত্রের স্বরূপ, প্রজাতন্ত্রের স্বরূপ, তার ত্রুটি ও সাফল্য সম্পর্কে জানবো।

ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তার জগতে ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে ম্যাকিয়াভেলির দর্শনের সুনির্দিষ্ট প্রকৃতি, রাজনীতি সম্পর্কে ম্যাকিয়াভেলির চিন্তা, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক ম্যাকিয়াভেলি, ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রদর্শনে রাজতন্ত্রের স্বরূপ, ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রদর্শনে প্রজাতন্ত্রের স্বরূপ, ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রনীতির ত্রুটি ও ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রনীতির সাফল্য সম্পর্কে জানবো।

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রনীতি

ঐতিহাসিক ঘটনাম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা
দেশইতালি
গ্ৰন্থThe Prince
সার্বভৌমত্বের ধারণানিকলো ম্যাকিয়াভেলি
শ্রেষ্ঠতর শাসনপ্রজাতন্ত্র
রাষ্ট্রের চরিত্রধর্মনিরপেক্ষ
ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রনীতি

ভূমিকা :- যে সকল রাষ্ট্রচিন্তাবিদ প্রথম পর্বের আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের বিকাশের রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে চর্চা করেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি।

আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক ম্যাকিয়াভেলি

ইতালির বিখ্যাত রাষ্ট্রচিন্তাবিদ নিকোলো ডি বার্নাডো ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭ খ্রি.) আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক’ নামে পরিচিত। সমকালীন ইতালির রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রাচীন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ প্লেটো, অ্যারিস্টটল, পলিবিয়াস প্রমুখের মতবাদের ভিত্তিতে ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রনৈতিক দর্শন গড়ে উঠেছিল।

ম্যাকিয়াভেলির বিভিন্ন রচনা

রাষ্ট্রচিন্তা বিষয়ে তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল ‘The Prince’। ম্যাকিয়াভেলির অন্যান্য গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘The Discourses on the First Ten Books of Titus Livius’, ‘Mandragola’, ‘Art of Way’, ‘History of Florence’ প্রভৃতি।

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা

শুধু অনুমানের ভিত্তিতে নয়, তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তিতে ম্যাকিয়াভেলি তাঁর রাষ্ট্রদর্শনের সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করেন। ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি নীচে উল্লেখ করা হল –

(ক) মানবপ্রকৃতি

ম্যাকিয়াভেলির মতে, মানুষ সহজাতভাবে আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, লোভী, সুবিধাবাদী ও ন্যায়নীতিবোধহীন চরিত্রবিশিষ্ট। যা কিছু আছে তা রক্ষা করা এবং আরও বেশি কিছু অর্জন করার উদ্দেশ্যে মানুষের নীতিবোধ বিসর্জন দিতে কোনো আপত্তি থাকে না। এর ফলে মানুষে মানুষে বিবাদ ও সংঘর্ষ দেখা দেয় এবং রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

(খ) ধর্ম ও নীতিবোধ

ম্যাকিয়াভেলি ধর্ম ও নীতিবোধের সঙ্গে রাষ্ট্রনীতির পার্থক্য সুস্পষ্ট করেন। তিনি ব্যক্তিজীবনে ধর্মের ভূমিকা স্বীকার করলেও রাষ্ট্রীয় জীবনে তা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, রাষ্ট্রশক্তি কখনোই যাজক বা চার্চের শক্তির অধীনস্থ থাকতে পারে না। রাষ্ট্র হবে ধর্ম ও নীতিবোধ থেকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন। তাঁর মতে, শাসককে তাঁর ব্যক্তিগত ধর্ম ও নীতিবোধের ঊর্ধ্বে উঠে কঠোরভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।

(গ) রাষ্ট্র-ক্ষমতা তত্ত্ব

আধুনিক চিন্তাবিদদের মধ্যে ম্যাকিয়াভেলিই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণা দেন এবং আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের তত্ত্ব পেশ করেন। তাঁর রাষ্ট্রদর্শনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল রাষ্ট্র ক্ষমতা। ‘দ্য প্রিন্স’ গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল, সংরক্ষণ এবং তা প্রয়োগের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে, মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি সংরক্ষণ ও জীবনের নিরাপত্তার প্রয়োজনেই রাষ্ট্র ও সরকারের উদ্ভব ঘটে। ম্যাকিয়াভেলির মতে, মানুষের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের হাতে অসীম ক্ষমতা থাকা দরকার।

(ঘ) রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রতত্ত্ব থেকে রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন –

(১) ধর্মনিরপেক্ষতা

তিনি চার্চ ও ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কহীন সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন।

(২) মানুষের গুরুত্ব

মানুষ নিজের স্বার্থসিদ্ধি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে স্বাগত জানায়।

(৩) ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা

প্রতিটি রাষ্ট্র সর্বদা নিজ ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালায়।

(৪) সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি

মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দিয়ে নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়াই হবে রাষ্ট্রের সরকারের লক্ষ্য।

(৫) প্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণ

যে রাষ্ট্রের প্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে তা ম্যাকিয়াভেলির বিচারে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র।

(ঙ) রাষ্ট্র ও সরকারের স্বরূপ

অ্যারিস্টলের অনুসরণে ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্র ও সরকারকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করেছেন – রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্র। তিনি ‘The Prince’ গ্রন্থে রাজতন্ত্র এবং ‘The Discourses on the First Ten Books of Titus Livius’ গ্রন্থে প্রজাতন্ত্রের স্বরূপ সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি পরিস্থিতি অনুসারে রাজতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছেন।

(চ) রাজতন্ত্রের স্বরূপ

ম্যাকিয়াভেলি রাজতন্ত্রকে এক সাহসী, দৃঢ় ও শৌর্যবীর্যসম্পন্ন বীরত্বের মূর্ত প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি রাজতন্ত্রের স্বরূপ সম্পর্কে বলেছেন যে, রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখাই হল রাজার প্রধান দায়িত্ব। এ ছাড়া রাজাকে রাষ্ট্রের জনগণের কাছে নিজের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ রাখতে হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রয়োজনে রাজা অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করবেন, নিজে সুদক্ষ যোদ্ধা হবেন, সকল বিরোধী শক্তিকে কঠোর হাতে দমন করবেন এবং জনগণের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

(ছ) প্রজাতন্ত্রের স্বরূপ

ম্যাকিয়াভেলি প্রজাতান্ত্রিক শাসনকে মুক্ত রাষ্ট্র বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যে, রোমান প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতা বিরাজমান ছিল। কিন্তু জুলিয়াস সিজার ও অন্যান্য সম্রাটগণ প্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস করে সকল রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে কেন্দ্রীভূত করলে সেখানে স্বাধীনতা ধ্বংস হয়। তিনি প্রজাতন্ত্রকে অন্য সব ধরনের শাসনের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর বলে স্বীকার করেছেন। ম্যাকিয়াভেলির মতে, “জনগণের কণ্ঠই হল ঈশ্বরের কণ্ঠ।”

(জ) ভালোমন্দের বিশ্লেষণ

ম্যাকিয়াভেলি প্রাচীন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ সিসেরোর প্রাকৃতিক আইনের বৈধতাকে অস্বীকার করে রাষ্ট্রের ভালো ও মন্দ-এর ধারণা বিশ্লেষণ করেন। তাঁর মতে, যে বিষয়গুলি রাষ্ট্র বা সমাজের স্বার্থ রক্ষা করে সেগুলি হল ‘ভালো’ আর যে বিষয়গুলি রাষ্ট্র বা সমাজের স্বার্থহানি করে সেগুলি হল ‘মন্দ’।

ম্যাকিয়াভেলির ত্রুটি

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা বিষয়ক মতবাদের বিভিন্ন ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। যেমন –

(১) অগভীর রাষ্ট্রচিন্তা

কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন যে, ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা ছিল খুবই অগভীর এবং সুনির্দিষ্ট দার্শনিক কাঠামোহীন।

(২) মহানুভবতা উপেক্ষিত

তিনি মানব চরিত্রের শুধু কুৎসিত দিকগুলিই লক্ষ্য করেছেন। মানুষের মহানুভবতা তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।

(৩) সমাজের পরে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা

তিনি বলেছেন যে, আগে রাষ্ট্র এবং পরে সমাজ গঠিত হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ চিন্তাবিদ মনে করেন যে, আগে সমাজ এবং পরে রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে।

(৪) রাষ্ট্র বিষয়ক বহু আলোচনা উপেক্ষিত

তিনি রাষ্ট্রনীতি ও যুদ্ধকৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেও রাষ্ট্র বিষয়ক অন্যান্য আলোচনায় বিশেষ আলোকপাত করেন নি।

(৫) বলপ্রয়োগকে গুরুত্ব

জনগণের সহযোগিতার ওপর ভরসা না করে তিনি রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য বলপ্রয়োগকেই অযথা গুরুত্ব দিয়েছেন।

ম্যাকিয়াভেলির সাফল্য

অবশ্য এসব ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় তাঁর অবদানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। তিনি ছিলেন আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম পথপ্রদর্শক।

(১) সমকালীন ইতালির পরিস্থিতি উপলব্ধি

সমকালীন সে সময়ে ইতালিতে যে অরাজকতা চলছিল তা দূর করার উদ্দেশ্যেই ম্যাকিয়াভেলি শক্তিশালী জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সপক্ষে মত প্রকাশ করেন।

(২) অভিজ্ঞতার ক্ষমতার গুরুত্ব উপলব্ধি

ম্যাকিয়াভেলি ‘সার্বভৌম’ শব্দটি সুস্পষ্টভাবে ব্যবহার না করলেও আধুনিক রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার গুরুত্ব তিনিই প্রথম তুলে ধরেন।

(৩) বুর্জোয়া শ্রেণির গুরুত্ব উপলব্ধি

ম্যাকিয়াভেলির অন্তর্দৃষ্টিতে উদীয়মান বুর্জোয়া সমাজের অফুরন্ত সম্ভাবনার বিষয়টি প্রথম ধরা পড়েছিল।

উপসংহার :- ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই ‘A child of his times’। তাঁর কৃতিত্বের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডানিং A History of Political Theories‘ গ্রন্থে বলেছেন যে “ম্যাকিয়াভেলি হলেন প্রথম আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ যিনি মধ্যযুগীয় সময়কালের অন্তিমলগ্ন ঘোষণা করেছিলেন এবং আধুনিক সময়কালের সূচনা করেছিলেন।”

(FAQ) ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক কাকে বলা হয়?

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি।

২. নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি কোন দেশের নাগরিক?

ইতালি।

৩. নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির বিখ্যাত গ্রন্থের নাম কি?

The Prince

৪. সর্বপ্রথম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণা দিয়েছিলেন কে?

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment