জাহাঙ্গীরের দাক্ষিণাত্য নীতি

জাহাঙ্গীরের দাক্ষিণাত্য নীতি প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরের সামনে পথ, আহম্মদ নগরের উজির, মালিক অম্বরের লক্ষ্য, মুঘলদের দাক্ষিণাত্য অভিযান, মুঘলদের ব্যর্থ অভিযান, মেবার যুদ্ধে ব্যস্ততা, যুবরাজ খুররমের অভিযান, সন্ধি স্থাপন, সন্ধি শর্ত, খুররমের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি, সন্ধি ভঙ্গ, পুনরায় সন্ধি স্থাপন ও দাক্ষিণাত্য নীতির ফল সম্পর্কে জানবো।

জাহাঙ্গীরের দাক্ষিণাত্য নীতি

ঐতিহাসিক ঘটনাজাহাঙ্গীরের দাক্ষিণাত্য নীতি
সম্রাটজাহাঙ্গীর
সময়কাল১৬০৫-১৬২৭ খ্রি
পূর্বসূরিআকবর
উত্তরসূরিশাহজাহান
জাহাঙ্গীরের দাক্ষিণাত্য নীতি

ভূমিকা :- জাহাঙ্গীর দাক্ষিণাত্যে তার পিতার আরদ্ধ কাজকে সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করেন। আকবরের আমলে দাক্ষিণাত্যের খান্দেশ ও আহমদ নগরের একাংশ মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।

আকবরের দাক্ষিণাত্য নীতির ফল

আকবরের দাক্ষিণাত্য নীতির ফলাফল হল –

  •  (১) দক্ষিণে মুঘল সাম্রাজ্য সীমা সুরক্ষিত ছিল না। বালাঘাট ও তেলেঙ্গানা অঞ্চল জয় না করলে, আহমদনগরের সঙ্গে বিরোধ এড়ান যেত না।
  • (২) দক্ষিণে যতটুকু স্থান মুঘলের হাতে ছিল তার আয়ের দ্বারা দক্ষিণী সুবার ব্যয় সঙ্কলন হত না।
  • (৩) আহম্মদ নগরের মন্ত্রী ও সেনাপতি মালিক অম্বর ছিলেন ভয়ানক কৌশলী ও চতুর। তিনি মুঘল সীমান্তকে ঘন ঘন আক্রমণ দ্বারা বিপন্ন করেন।

জাহাঙ্গীরের সামনে পথ

এই অবস্থায় জাহাঙ্গীরের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। যথা,

  • (১) আকবরের আমলের সীমান্তকে ধরে রাখা বা স্থিতাবস্থা বজায় রাখা।
  • (২) দাক্ষিণাত্যের রাজ্যবিস্তার দ্বারা মুঘলের সার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠা। জাহাঙ্গীর শেষের পথটিই বেছে নেন।

জাহাঙ্গীরের সময় আহমদ নগরের উজীর

জাহাঙ্গীরের লক্ষ্য পূরণের পথে বাধাস্বরূপ দাঁড়ান আহমদ নগরের নিজাম শাহী বংশের উজীর মালিক অম্বর। এই ব্যক্তি ছিলেন আবিসিনীয় বা হাবসী ক্রীতদাস। তিনি প্রথম জীবনে বিজাপুর ও মুঘলের অধীনে চাকুরী করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আহমদ নগরের নিজাম শাহী সুলতান মুর্তজা আলী শাহের উজীর নিযুক্ত হন।

মালিক অম্বরের লক্ষ্য

উজীর মালিক অম্বরের লক্ষ্য ছিল আহমদ নগরকে বিভিন্ন সংস্কার দ্বারা শক্তিশালী করা এবং আহমদ নগরের অবশিষ্ট অংশ মুঘলের হাত থেকে মুক্ত করা। এজন্য তিনি আহমদ নগরে বহুবিধ সংস্কার প্রবর্তন করেন।

জাহাঙ্গীরের সময় মুঘলদের দাক্ষিণাত্য অভিযান

জাহাঙ্গীর ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে আহমদ নগরের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম খান-ই-খানানকে পাঠান। তিনি বিফল হলে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে খান-ই-জাহানকে নিয়োগ করা হয়।

দাক্ষিনাত্যে মুঘলদের ব্যর্থ অভিযান

১৬১১ খ্রিস্টাব্দে খান-ই-জাহান ও মান সিংহ একদিক থেকে এবং আবদুল্লা খাঁ অপর দিক থেকে আহমদ নগর আক্রমণ করেন। কিন্তু আবদুল্লা খাঁর হঠকারিতার ফলে এই অভিযান বিফল হয়।

মেবার যুদ্ধে ব্যস্ত জাহাঙ্গীর

ইতিমধ্যে জাহাঙ্গীর মেবার যুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই সুযোগে মালিক অম্বর মুঘলের অধিকৃত স্থান আক্রমণ করে অধিকার করতে থাকেন।

জাহাঙ্গীরের আমলে যুবরাজ খুররমের দাক্ষিনাত্য অভিযান

মেবারের যুদ্ধ শেষ হলে জাহাঙ্গীর যুবরাজ খুররমকে দাক্ষিণাত্যে পাঠান এবং তিনি নিজে মাণ্ডু পর্যন্ত এসে শিবির স্থাপন করেন। খুররম ব্যাপক আক্রমণ দ্বারা আহমদ নগরকে কোনঠাসা করে ফেলেন।

আহমদ নগর ও জাহাঙ্গীরের বাহিনীর মধ্য়ে সন্ধি স্থাপন

খান-ই-খানান প্রমুখ বিজ্ঞ সেনাপতিদের পরামর্শে যুবরাজ খুররম আহমদ নগরের সুলতানের প্রতি মৈত্রীর মনোভাব দেখান। শেষ পর্যন্ত ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে উভয় পক্ষের মধ্যে এক সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়।

আহমদ নগর ও মোঘলদের মধ্যে সন্ধির শর্ত

দুই পক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত সন্ধির দ্বারা বালাঘাট অঞ্চল ও আহমদ নগর দুর্গ মুঘলকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বিজাপুর সুলতান আহমদ নগরের পক্ষ নেওয়ার জন্য কয়েক লক্ষ টাকা জরিমানা দেন। এই সন্ধির দ্বারা মুঘল ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণে তার যে সীমা ছিল তা ফিরে পায়। নতুন কোনো স্থান পায় নি।

জাহাঙ্গীরের দাক্ষিনাত্য নীতির ফলে খুররমের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি

খুররমের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ে। জাহাঙ্গীর তাকে শাহজাহান উপাধিতে ভূষিত করেন এবং তার সিংহাসনের ডান দিকে বসার স্থান নির্দেশ করেন।

আহমদ নগর ও মোঘলদের সন্ধি ভঙ্গ

  • (১) দুই পক্ষের সন্ধি স্থায়ী হয়নি। আহমদ নগরের মন্ত্রী মালিক অম্বর এই সন্ধিটিকে সাময়িক যুদ্ধ বিরতি বলে গণ্য করেন। যেহেতু বিজাপুর মুঘল মিত্রতা লাভে ব্যগ্র হয় এজন্য মালিক অম্বর বিজাপুরের অধিকৃত শোলাপুর জেলা আক্রমণ করেন।
  • (২) শেষ পর্যন্ত তিনি বিজাপুর ও গোলকুন্ডার সঙ্গে জোট বেঁধে মুঘলের হাত থেকে আহমদ নগর দুর্গ দখলের জন্য আক্রমণ করেন। তিনি বেরার ও সংলগ্ন স্থান অধিকার করেন।

আহমদ নগর ও মোঘলদের মধ্যে পুনরায় সন্ধি স্থাপন

জাহাঙ্গীর দক্ষিণে মুঘল আধিপত্য রক্ষার জন্য পুনরায় খুররমকে দক্ষিণে পাঠান। খুররম দৌলতাবাদ অবরোধ করেন এবং কিকী অধিকার করেন। মুঘল অভিযানের সামনে আহমদ নগরের বাহিনী বিধ্বস্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৬২১ খ্রিস্টাব্দে মালিক অম্বর পুনরায় সন্ধি স্বাক্ষর করেন।

আহমদ নগর ও মোঘল বাহিনীর সন্ধির শর্ত

দুই পক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত সন্ধির শর্ত অনুসারে,

  • (১) মুঘলের প্রাপ্য স্থানগুলি ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
  • (২) আহমদ নগরের নিজ রাজ্য একাংশ মুঘলকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই অঞ্চল থেকে মুঘল ১৪ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব পায়।
  • (৩) আহমদ নগর সম্রাটকে ১২ লক্ষ টাকা জরিমানা দেয়।
  • (৪) বিজাপুর ও গোলকুন্ডা যথাক্রমে ১৮ লক্ষ ও ২০ লক্ষ টাকা নজরানা মুঘলকে দেয়।

জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে খুররমের বিদ্রোহ

ইতিমধ্যে যুবরাজ খুররম পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি দক্ষিণে এসে জাহাঙ্গীরের আধিপত্য খর্ব করার চেষ্টা করেন। মালিক অম্বর তাকে সহায়তা না দিয়ে নিরপেক্ষ থাকেন।

খুররমের বাংলায় পলায়ন

সম্রাট জাহাঙ্গীর সেনাপতি মহাব্বত খান ও যুবরাজ পারভেজকে দক্ষিণে খুররমকে দমনের জন্য পাঠান। মহাব্বত খাঁর আক্রমণে হতাশ হয়ে খুররম বাংলায় চলে যান।

জাহাঙ্গীরের দাক্ষিণাত্য নীতির ফল

জাহাঙ্গীরের দক্ষিণ নীতি বিশেষ সফল হয় নি। কারণ তিনি আহমদ নগরের নিজাম শাহী শাসনকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারেন নি। মালিক অম্বরের বুদ্ধিকৌশল মুঘল সেনাপতিদের বিভ্রান্ত করে।

উপসংহার :- জাহাঙ্গীর দক্ষিণে রাজ্য বিস্তারে ইচ্ছুক না হওয়ায় আহমদ নগর তাকে বিব্রত করে। মালিক অম্বর গোলকুণ্ডার সঙ্গে জোট গড়ে মুঘলকে ব্যতিব্যস্ত করেন।

(FAQ) জাহাঙ্গীরের দাক্ষিণাত্য নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. জাহাঙ্গীরের সময় আহম্মদ নগরের উজীর বা মন্ত্রী কে ছিলেন?

মালিক অম্বর।

২. দাক্ষিণাত্য অভিযানের পর জাহাঙ্গীর যুবরাজ খুররমকে কি উপাধি প্রদান করেন?

শাহজাহান।

৩. জাহাঙ্গীর সর্বপ্রথম কার নেতৃত্বে আহমদ নগরে অভিযান পাঠান?

খান-ই-খানান।

৪. মুঘলদের দাক্ষিণাত্য অভিযানের সময় জাহাঙ্গীর কোন যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন?

মেবার যুদ্ধে।

Leave a Comment