ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয় শিল্পোদ্যোগ প্রসঙ্গে প্রতিবন্ধকতা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ভারতীয় শিল্পের উদ্যোগ, বস্ত্র শিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ভারী শিল্প, কয়লা উত্তোলন শিল্প, চা শিল্প, রাসায়নিক শিল্প, ও স্বদেশী আন্দোলনের সময় গড়ে ওঠা শিল্প সম্পর্কে জানবো।
ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয় শিল্পোদ্যোগ
ঐতিহাসিক ঘটনা | ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয় শিল্পোদ্যোগ |
প্রথম কাপড়ে কল | ১৮৫৩ খ্রি |
এম্প্রেস মিল | ১৮৮৭ খ্রি |
টিসকো প্রতিষ্ঠা | ১৯০৭ খ্রি |
বেঙ্গল কেমিক্যাল | প্রফুল্লচন্দ্র রায় |
স্বদেশী জাহাজ কোম্পানি | চিদাম্বরম পিল্লাই |
ভূমিকা :- ব্রিটিশ শিল্পপতি ও ভারত-এর ইংরেজ বণিকরা ভারতীয় মালিকানায় এদেশে আধুনিক শিল্প গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিল না। তারা মনে করত যে, ভারতে দেশীয় উদ্যোগে আধুনিক শিল্পের বিকাশ ঘটলে ভারতের বাজার ও কাঁচামাল তাদের হাতছাড়া হবে। এজন্য তারা নানা উপায়ে ভারতীয় উদ্যোগে এদেশে শিল্পের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত।
ভারতীয় উদ্যোগে শিল্প-বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের উদ্যোগে শিল্পের যতটা বিকাশ সম্ভব হয়েছিল, ততটা ভারতীয় পুঁজিপতিদের উদ্যোগে সম্ভব হয় নি। এর কারণগুলি হল –
(১) প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া
ভারতীয়দের উদ্যোগে শিল্পের বিকাশকালে সরকার বিদেশি শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতার হাত থেকে ভারতীয় উদ্যোগকে রক্ষার কোনো চেষ্টা না করে বরং বিলাতি পণ্যের ওপর আমদানি শুল্কের হার কমিয়ে দেয়। ফলে সস্তা বিদেশি পণ্যের সঙ্গে ভারতীয় শিল্পপতিদের শিল্পপণ্য প্রতিযোগিতায় পিছু হঠে।
(২) লাইসেন্স প্রাপ্তির সমস্যা
ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় শিল্পগুলিকে লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে টালবাহানা করত।
(৩) ব্যাংক ঋণের সমস্যা
ভারতীয় শিল্পপতিরা যাতে ব্যাংক থেকে ঋণ না পায়, তার চেষ্টা করা হত এবং তাদের ঋণ দেওয়া হলেও সেই ঋণের সুদের হার ছিল খুব বেশি।
(৪) শুল্কের বিপুল বোঝা
ম্যাঞ্চেস্টার থেকে আমদানি করা সুতিবস্ত্রের ওপর নামমাত্র শুল্ক চাপিয়ে এবং ভারতীয় সুতিবস্ত্রের ওপর বিপুল পরিমাণ উৎপাদন শুল্ক চাপিয়ে ভারতীয় বস্ত্রশিল্পকে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
(৫) পরিবহণের ক্ষেত্রে সমস্যা
রেলে ভারতীয়দের মালপত্র পরিবহণে বেশি মাসুল ধার্য করে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের ণক্ষেত্রে অসুবিধার সৃষ্টি করা হয়। তথাপি ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে যে শিল্পোদ্যোগ শুরু হয়, তাতে ব্রিটিশ পুঁজির প্রাধান্য থাকলেও ভারতীয় পুঁজি একেবারে পিছিয়ে ছিল না।
ভারতীয় উদ্যোগে শিল্প বিকাশের প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে অমিয় বাগচীর অভিমত
ড. অমিয় বাগচী বলেছেন যে, “বিদেশি ঔপনিবেশিক শাসননীতিই ভারতীয় শিল্পপতিদের উদ্যোগে শিল্প বিকাশের পথে সবচেয়ে বড়ো বাধা ছিল।”
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ভারতীয় শিল্পোদ্যোগ
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় উদ্যোগে এদেশে বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ও অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন –
(ক) বস্ত্রশিল্প
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ভারতীয়দের উদ্যোগে এদেশে বস্ত্রশিল্পে সর্বাপেক্ষা উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। রেলপথের সম্প্রসারণ, চিনে সুতিবস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি, স্বদেশি আন্দোলন-এর প্রভাব প্রভৃতি ঘটনা ভারতে বস্ত্রশিল্পের অগ্রগতিতে সহায়তা করে। বোম্বাইকে কেন্দ্র করে বস্ত্রশিল্পের প্রসার ঘটে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) বিভিন্ন কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠা
১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে পারসি শিল্পপতি কাউয়াসজি নানাভাই দাভর বোম্বাইয়ে সর্বপ্রথম একটি কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে রণছোড়লাল ছোপটলাল আমেদাবাদে একটি কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর একে একে শোলাপুর, নাগপুর, সুরাট, কানপুর প্রভৃতি স্থানে সুতিবস্ত্রের কল স্থাপিত হয়। ভারতের বিশিষ্ট শিল্পপতি জামশেদজি টাটা-র উদ্যোগে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে ‘এম্প্রেস মিল’ স্থাপিত হয়।
(২) পরিসংখ্যান
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বোম্বাইয়ে অন্তত ১০টি কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতে মোট ৫৬টি সুতিবস্ত্রের কল ছিল। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০৬। এই সময় এই কলগুলিতে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লক্ষ ১৬ হাজার। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বস্ত্র রপ্তানিতে ভারত ছিল ব্রিটেনের পরেই অর্থাৎ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে। অধ্যাপক মরিশ ডি. মরিশ বলেন যে, ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বোম্বাইয়ে ৮৫টি এবং আমেদাবাদে ৪৯টি কাপড়ের কল স্থাপিত হয়।
(খ) ইঞ্জিনিয়ারিং ও ভারী শিল্প
ভারতে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ভারী শিল্পোদ্যোগ সম্পর্কে সরকারের তীব্র অনীহা থাকলেও এসব ক্ষেত্রে ভারতীয় পুঁজিপতিরা কিছু মূলধন বিনিয়োগ করে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) প্রথমদিকের উদ্যোগ
কিশোরীলাল মুখোপাধ্যায় ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে হাওড়ার শিবপুরে একটি লোহার কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ছোটোখাটো কিছু যন্ত্রপাতি তৈরি হত। ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন ও বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে যৌথভাবে ‘মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করে রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। নওয়াল কিশোর নামে জনৈক ব্যবসায়ী লক্ষ্ণৌয়ে ‘লক্ষ্ণৌ আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
(২) টাটার উদ্যোগ
লৌহ ও ইস্পাত শিল্পে যুগান্তর আনেন পারসি শিল্পপতি জামশেদজি টাটা। তিনি আকরিক লৌহ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। এই সময় ভূবিদ্যার বাঙালি অধ্যাপক প্রমথনাথ বসু ময়ূরভঞ্জের গোরুমহিষানী অঞ্চলে লৌহখনির আবিষ্কার (১৯০৩-০৪) করেন এবং এরই ভিত্তিতে জামশেদজি টাটাকে লৌহ-ইস্পাত কারখানা স্থাপনে রাজি করান। জামশেদজি টাটা ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে জামশেদপুরে টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি’ (TISCO) প্রতিষ্ঠা করেন। এই কারখানায় ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে উন্নত মানের লৌহপিণ্ড এবং ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিশুদ্ধ ইস্পাতের উৎপাদন শুরু হয়।
(৩) জাহাজনির্মাণ
স্বদেশি আন্দোলনের সময় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজের জাতীয়তাবাদী নেতা চিদাম্বরম পিল্লাই স্বদেশি জাহাজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-এর সময় পর্যন্ত জাহাজ ও সমুদ্র পরিবহণের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল শতকরা পাঁচ ভাগ।
(গ) কয়লা উত্তোলন শিল্প
- (১) ভারতীয় পুঁজিপতিদের উদ্যোগে কয়লা উত্তোলন শিল্পেরও প্রসার ঘটে। কয়েকজন ভারতীয় পুঁজিপতি বেশ কয়েকটি কয়লাখনির মালিক ছিলেন। ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে দ্বারকানাথ ঠাকুরের ‘কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ কয়লাখনির কাজে মূলধন বিনিয়োগ করে।
- (২) ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের একটি সরকারি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ভারতীয় মালিকানায় পশ্চিম বর্ধমান জেলার রানিগঞ্জ, আসানসোল, বরাকর, অন্ডাল প্রভৃতি স্থানে ৪০টি এবং ছোটোনাগপুর ও মানভূম জেলায় ৬২টি ছোটো ছোটো কয়লাখনি ছিল।
- (৩) ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এইসব ছোটো ছোটো কয়লাখনি নিয়ে ইন্ডিয়ান মাইনিং ফেডারেশন গঠিত হয়। ভারতের বিখ্যাত পারসি শিল্পপতি জামশেদজি টাটা কয়লার অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। তাঁর উদ্যোগে ঝরিয়ায় উন্নত মানের কয়লার সন্ধান পাওয়া যায়।
(ঘ) চা, রাসায়নিক ও অন্যান্য শিল্প
চা, অভ্র এবং রাসায়নিক শিল্পেও ভারতীয়দের সক্রিয় উদ্যোগ ছিল। যেমন –
(১) চা শিল্প
দ্বারকানাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, মির্জা ইস্পাহানি প্রমুখ ভারতীয় চা শিল্পে কিছু মূলধন বিনিয়োগ করেন। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে জয়চাঁদ সান্যাল ‘জলপাইগুড়ি টি কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
(২) রাসায়নিক শিল্প
বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ওষুধ ও রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কাস প্রতিষ্ঠা করেন।
(৩) অভ্র শিল্প
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের একটি সরকারি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, হাজারিবাগ জেলার কোডারমা অঞ্চলের ৩১১টি অস্ত্রখনির মধ্যে ৬৯টি ভারতীয় মালিকানাধীনে ছিল এবং এগুলির মধ্যে ৪৬টি খনির মালিক ছিলেন বাঁকুড়া–বিষ্ণুপুর-এর বিখ্যাত সাহানা পরিবার। দ্বারকানাথ ঠাকুর নীল কারখানা ও চিনির কলের মালিক ছিলেন।
(ঙ) স্বদেশি আন্দোলনের সময় শিল্প
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন ভারত সরকারের অধীনে একটি পৃথক বাণিজ্য ও শিল্প বিভাগ গঠন করেন। এর ফলে ভারতীয় শিল্পক্ষেত্রে নতুন উদ্যম দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, স্বদেশি আন্দোলনের সময় (১৯০৫-১৯১১ খ্রি.) দেশীয় উদ্যোগে তাঁতবস্ত্র, সুতিকল, গেঞ্জি, সাবান, চিনি, লবণ, ওষুধ, তেল, চিরুনি, দেশলাই, চামড়াজাত সামগ্রী প্রভৃতি উৎপাদনের জন্য বেশ কিছু কারখানা গড়ে উঠতে থাকে। এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে ভারতীয় উদ্যোগে কাগজ, কাচ, সিমেন্ট, ধাতব দ্রব্য ও রাসায়নিক শিল্পের বিকাশ হতে থাকে।
উপসংহার :- উনিশ শতকের শেষদিকে ভারতে শিল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের পর ভারতীয় উদ্যোগে শিল্পের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। বোম্বাই ছিল ভারতীয় বিনিয়োগের প্রাণকেন্দ্র।
(FAQ) ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয় শিল্পোদ্যোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে পারসি শিল্পপতি কাউয়াসজি নানাভাই দাভর বোম্বাইয়ে।
জামশেদজি টাটা ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে জামশেদপুরে।
মাদ্রাজের জাতীয়তাবাদী নেতা চিদাম্বরম পিল্লাই ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।