সুলতান ইলতুৎমিসের কৃতিত্ব প্রসঙ্গে সমস্যাসংকুল উত্তরাধিকার, শাসন সংগঠন, ইক্তা প্রবর্তন, চল্লিশ চক্র, দিল্লীর আন্তর্জাতিক মর্যাদা, ইসলামীয় সংস্কৃতির বিকাশ, সুলতানি সাম্রাজ্যের ঐক্য রক্ষা, সামরিক দক্ষতা ও মুদ্রা প্রচলন সম্পর্কে জানবো।
সুলতান ইলতুৎমিসের কৃতিত্ব
বিষয় | ইলতুৎমিসের কৃতিত্ব |
সুলতান | ইলতুৎমিস |
বংশ | দাস বংশ |
রাজত্ব | ১২১০-১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ |
পূর্বসূরি | কুতুবউদ্দিন আইবক |
উত্তরসূরি | রুকনউদ্দিন ফিরোজ |
ভূমিকা :- তুর্কী ভাষায় ‘ইলতুৎমিস’ কথাটির অর্থ হল “সাম্রাজ্যের পালন কর্তা”। সুলতান সামসুদ্দিন ইলতুৎমিস এই অর্থে সার্থকনামা ছিলেন। ডাঃ আর পি. ত্রিপাঠী মন্তব্য করেছেন যে, “ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে তার আমল থেকে শুরু হয়।”
সমস্যাসংকুল উত্তরাধিকার
- (১) ইলতুৎমিস যখন সিংহাসনে বসেন তখন নানাবিধ সমস্যার চাপে এই শিশু সুলতানি ভারাক্রান্ত ছিল। কুতবউদ্দিন আইবক কেবলমাত্র একটি সামরিক সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। তিনি কোনো শাসন সংগঠন বা রাজস্ব সংগঠন করেন নি।
- (২) কুতুবউদ্দিনের আমলে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্নতাবাদ বর্তমান ছিল। গজনীর সঙ্গে দিল্লীর সাংবিধানিক সম্পর্কও কুতরউদ্দিন পাকাপাকিভাবে স্থির করতে পারেননি। সকল কিছুই ছিল অনিশ্চিত ও গোলযোগপূর্ণ।
শাসন সংগঠন
- (১) ডঃ নিজামীর মতে, “হিন্দুস্থানে শিথিল ও বিচ্ছিন্ন ঘুরীর বিজিত রাজ্যগুলিকে ইলতুৎমিস একটি সুগঠিত ও সুদৃঢ় রাষ্ট্রে পরিণত করেন।” ইলতুৎমিস গজনী ও ঘুরের আধিপত্য হতে দিল্লী সুলতানিকে মুক্ত করে স্বাধীন দিল্লী সুলতানির প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর কোনো বর্হিভারতীয় শক্তি দিল্লীর ওপর আধিপত্য দাবী করতে সাহস করেনি।
- (২) ইলতুৎমিস যখন সিংহাসনে বসেন তখন কোনো রাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য বা শাসনতান্ত্রিক ঐতিহ্য বা শাসনতান্ত্রিক উত্তরাধিকার তিনি পাননি। কুতুবউদ্দিন আইবক নিছক একটি সামরিক রাজতন্ত্র স্থাপন করেছিলেন। প্রকৃত শাসনযন্ত্র তিনি গঠন করেননি।
- (৩) ইলতুৎমিসকেই আপন প্রতিভাবলে দিল্লী সুলতানি শাসনের ছক তৈরি করতে হয়। তিনি তুর্কী ও অ-তুর্কী বা তাজিকদের সাহায্য নিয়ে সুলতানি প্রশাসন যন্ত্র গড়েন। সরকারি উচ্চপদগুলিতে তিনি তুর্কী ও তাজিকদের নিয়োগ করেন। হিন্দু সামন্ত রাজাদের শাসিত রাজ্যে তিনি স্বায়ত্ত্বশাসন দান করেন।
ইক্তা প্রবর্তন
ইক্তা প্রথা দ্বারা সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন জেলায় ভাগ করেন। ইক্তাদারদের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে কেন্দ্রীয় সুলতানির আধিপত্য বিস্তার করেন এবং রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন। ইক্তাদারদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। মোট কথা ইলতুৎমিসের আমলে দিল্লী সুলতানির প্রকৃত কাঠামো ও আধিপত্য (Form and content) গড়ে ওঠে।
চল্লিশ চক্র
তিনি ৪০ জন বাছাই করা ক্রীতদাসকে শাসনকার্যের বিশেষ দায়িত্ব দেন। এদের সমিতির নাম ছিল চেহালগানি বা চল্লিশী বা চল্লিশ চক্র।
দিল্লীর আন্তর্জাতিক মর্যাদা
- (১) ইলতুৎমিস উপলব্ধি করেন যে, স্বাধীন সুলতানির রাজধানী হিসেবে দিল্লীর কোনো মর্যাদা ইসলামীয় জগতে নেই। দিল্লীর তুলনায় লাহোরের নাম ছিল বেশী পরিচিত। দিল্লী ছিল তখনও পর্যন্ত সুলতানি সাম্রাজ্যের একটি সামরিক কেন্দ্র। রাজধানী হিসেবে এই নগরের পরিচিতি ছিল না।
- (২) ইলতুৎমিস দিল্লীকে প্রাসাদে, মসজিদে, মিনারে, খানকায় সুসজ্জিত করে এর খ্যাতি বৃদ্ধি করেন। তিনি কুতুবমিনারের নির্মাণ কার্য সমাপ্ত করেন। ইসলামীয় জগতের বিখ্যাত জ্ঞানী, গুণীদের এনে দিল্লীতে বসবাস করান। তাদের প্রভাবে দিল্লীর নাম ইসলামীয় দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
- (৩) “হজরত-ই-দিল্লী” – দিল্লী নগরীর মহিমা বিদেশে উপলব্ধি করা হয়। এর পর থেকে একাদিক্রমে দিল্লীর উন্নতি মধ্যযুগে ঘটতে থাকে। মধ্য এশিয়ার মোঙ্গল আক্রমণের ফলে খারাজম ও আজম অঞ্চল থেকে বহু জ্ঞানী ও গুণী লোক দিল্লীতে চলে আসেন।
ইসলামীয় সংস্কৃতির বিকাশ
বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত জ্ঞানী গুণীদের ইলতুৎমিস দিল্লীতে বাসস্থান ও বৃত্তিদান করায় এই সকল জ্ঞানী-গুণীরা দিল্লীতে স্থায়ীভাবে বাস করেন। এর ফলে দিল্লীতে ইসলামীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।
সুলতানি সাম্রাজ্যের ঐক্য রক্ষা
শিশু সুলতানির চারা গাছটিকে রক্ষার জন্য ইলতুৎমিস বিশেষ বুদ্ধিমত্তা ও কূটনীতি জ্ঞান দেখান। তিনি চেঙ্গিজের আক্রমণ থেকে কূটকৌশলে সুলতানিকে রক্ষা করেন। বাংলায় খলজি, বিদ্রোহ ও রাজপুত বিদ্রোহ দমন করে তিনি সুলতানি সাম্রাজ্যের সীমাকে অক্ষুন্ন রাখেন।
সামরিক দক্ষতা
ইলতুৎমিস সামরিক নেতা হিসেবে বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দেন। মহম্মদ ঘুরী খোক্কর যুদ্ধে ব্যাপৃত হলে ইলতুৎমিস তার সামরিক প্রতিভার দ্বারা মহম্মদকে চমকিত করেন। এই বিজয়ের পুরস্কার হিসেবে কুবউদ্দিন তাকে দাসত্বের হাত থেকে মুক্তিপত্র দেন। তাজউদ্দিন ইলদুজ ও নাসিরুদ্দিন কুবাচা এবং রাজপুত রাজাদের বিরুদ্ধেও তিনি তাঁর সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেন।
জ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকতা
মধ্য এশিয়া থেকে আগত পন্ডিতদের মধ্যে তাঁর দরবারে ছিলেন ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দিন-সিরাজ, ফকর-উল-মুলক ইসামি, নিজান-উল-মুলক জুনাইদি প্রমুখ।
মুদ্রা প্রচলন
তিনি রূপার তঙ্কা ও তামার জিতল মুদ্রার প্রবর্তন করেন। নেলসন রাইটের (Nelson Wright) মতে, “দিল্লীর মুদ্রা ব্যবস্থার ইতিহাসে ইলতুৎমিসের রাজত্বকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগ ছিল।” ইলতুৎমিসের “তঙ্কা” ও “জিতলের ভিত্তিতেই সুলতানি যুগের মুদ্রাগুলি তৈরি করা হয়।
ইক্তাদার
তিনি ইক্তা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। ইক্তা প্রথার সাহায্যে তিনি রাজপুত সামন্ততান্ত্রিক শাসন ও তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদকে দমন করেন। ইক্তাদাররা ছিলেন কেন্দ্রের কর্মচারী মাত্র।
ধর্মীয় নীতি
- (১) ইলতুৎমিস ব্যক্তিগতভাবে ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তিনি সুফী সন্তদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। গোঁড়া উলেমারা তাকে দার-উল-ইসলাম অর্থাৎ ইসলামের রাজত্ব স্থাপনের জন্য পরামর্শ দিলেও, তিনি তার রাষ্ট্রনীতি নিজেই স্থির করতেন।
- (২) তার রাজত্বকালে অ-মুসলিমদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য কোনো চেষ্টা করা হয়নি। তিনি রাজপুত রাজাদের প্রতি জেহাদ ঘোষণা করেন নি। কোনো কোনো লেখক তাকে ধর্মীয় গোঁড়ামির অভিযোগে দায়ী করেন। এই মত একদা ইংরাজ ঐতিহাসিকরা প্রচার করতেন।
- (৩) তাঁর কন্যা রাজিয়াকে সিংহাসনে তার উত্তরাধিকারী স্থির করার সময় তিনি উলেমাদের পরামর্শ নেন নি। বিখ্যাত সুফী সন্ত শেখ কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকি প্রমুখকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন।
ইলতুৎমিসের ত্রুটি
একথা বলা দরকার যে, ইলতুৎমিসের নীতিতে কয়েকটি ত্রুটি ছিল। যেমন –
- (১) তাঁর রাজস্ব নীতি ছিল দুর্বল।
- (২) তিনি সুলতানের সঙ্গে তুর্কী অভিজাতদের সাংবিধানিক সম্পর্ক সঠিক ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে পারেন নি। যেহেতু তিনি তুর্কী অভিজাতদের মধ্য থেকে তাদের দ্বারা নির্বাচিত হন এজন্যে অভিজাতরা নিজেদের সুলতানের সমকক্ষ ভাবত।
- (৩) ইলতুৎমিস প্রশাসনে কেবলমাত্র তুর্কী ও তাজিকদের নিয়োগ করেন। এর ফলে শাসনযন্ত্রের তুর্কীকরণ ঘটে। কিন্তু এর ভারতীয়করণের জন্য তিনি চেষ্টা করেন নি। এজন্য দিল্লী সুলতানি জনগণ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বরণীর অভিমত
জিয়াউদ্দিন বরণী বলেছেন যে, ইলতুৎমিস মানী ও বয়স্ক তুর্কী সেনাপতিদের সামনে সিংহাসনে বসতে অস্বস্তি বোধ করতেন। এই দুর্বলতার ফল ভাল হয়নি। যদিও ইলতুৎমিস তার কন্যা রাজিয়াকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে সিংহাসনের অধিকারকে দৃঢ় করার চেষ্টা করেন, তা পরে সফল হয় নি।
ঈশ্বরীপ্রসাদের অভিমত
ডঃ ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে বলা যায় যে, “ইলতুৎমিস নিঃসন্দেহে দাস রাজবংশের প্রকৃত স্থাপয়িতা ছিলেন।”
উপসংহার :- ইলতুৎমিস একটি ভেঙে পড়া সামরিক দখলদারিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে স্থায়িত্ব দেন। তিনি ইক্তা ব্যবস্থা, সেনা সংগঠন, মুদ্রা সংস্কার করেন এবং গজনীর আধিপত্য থেকে দিল্লী সুলতানির স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেন। এই কারণে তাকে দিল্লী সুলতানীর প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।
(FAQ) সুলতান ইলতুৎমিসের কৃতিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ইলতুৎমিস।
ইলতুৎমিস।
কন্যা রাজিয়াকে।
ইলতুৎমিস।