প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার হায়ারোগ্লিফিক লিপি -র প্রতীক, শব্দটির উৎপত্তি, পবিত্র লিপি, লিপিতে ব্যঞ্জনধ্বনির অস্তিত্ব, উচ্চারণ, প্রকাশিত শব্দ, শ্রুতির ঐতিহ্য, লিখন পদ্ধতির নিয়ন্ত্রক, লিপি লেখার দিক, চিত্রের ব্যবহার, নির্ধারক চিহ্নের ব্যবহার, লিপির পাঠোদ্ধার ও লিপির বিবর্তন সম্পর্কে জানবো।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার হায়ারোগ্লিফিক লিপি প্রসঙ্গে হায়ারোগ্লিফিক লিপির প্রতীক, হায়ারোগ্লিফিক শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ, পবিত্র হায়ারোগ্লিফিক লিপি, হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে প্রকাশিত শব্দ, হায়ারোগ্লিফিক লিপির লিখন পদ্ধতির নিয়ন্ত্রক, হায়ারোগ্লিফিক লিপির লেখা শুরু, হায়ারোগ্লিফিক লিপি লেখার দিক, হায়ারোগ্লিফিক লিপি বোঝার উপায়, হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে চিত্রের ব্যবহার, হায়ারোগ্লিফিক লিপির উদ্ভব, হায়ারোগ্লিফিক লিপির শেষ লেখা, হায়ারোগ্লিফিক লিপির শেষ বা সমাপ্তি, হায়ারোগ্লিফিক লিপির আবিষ্কার, হায়ারোগ্লিফিক লিপির পাঠোদ্ধার ও হায়ারোগ্লিফিক লিপির বিবর্তন।
মিশরীয় সভ্যতার হায়ারোগ্লিফিক লিপি
লিপির ধরণ | ভাবলিপি |
সময়কাল | খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দ – ৪০০ খ্রিস্টাব্দ |
লেখার দিক | ডান দিক থেকে বাম দিকে |
ভূমিকা :- মিশরীয় সভ্যতা -র অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল লিপি বা অক্ষর আবিষ্কার। নগর সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মিশরীয় লিখন পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। প্রথম দিকে তারা ছবি একে মনের ভাব প্রকাশ করত। এই লিখন পদ্ধতিই চিত্রলিপি বা হায়ারোগ্লিপিক লিপি নামে পরিচিত।
মিশরে প্রচলিত লিপি
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় তিন ধরনের লিপি প্রচলিত ছিল – হায়ারোগ্লিফিক বামিশরীয় চিত্রলিপি, হায়রাটিক এবং ডেমোটিক। তিনটি লিপির নামই গ্রিকদের দেওয়া।
হায়ারোগ্লিফিক লিপির প্রতীক
এই হায়ারোগ্লিফিক লিপির প্রতীককে বলা হয় “হায়ারোগ্লিফ”।
হায়ারোগ্লিফিক শব্দের উৎপত্তি
গ্রিক ‘হায়ারোগ্লুফিকোস’ থেকে ল্যাটিন ‘হায়ারোগ্লিফিকাস’ হয়ে ফরাসি ‘হায়রোগ্লিফিক’ থেকে ইংরেজি ‘হায়ারোগ্লিফিক’ শব্দটি এসেছে। গ্রিক উপসর্গ ‘হায়ারোস’ অর্থ ‘পবিত্র’, আর ‘গ্লুফি’ অর্থ ‘খোদাই করে লেখা’।
পবিত্র লিপি হায়ারোগ্লিফিক লিপি
হায়ারোগ্লিফ” শব্দের অর্থ ‘উৎকীর্ণ পবিত্র চিহ্ন’। গ্রিকদের মিশর অধিকার কালে ধারণা হয় যে, পুরোহিতরা লিপিকরের দায়িত্ব পালন করেন এবং মন্দিরের গায়ে এই লিপি খোদাই করা আছে বলে এই লিপি নিশ্চয়ই ধর্মীয়ভাবে কোনো পবিত্র লিপি।
ব্যঞ্জনধ্বনির অস্তিত্ব
উদ্ভবের কাল থেকে বিলুপ্তি পর্যন্ত হায়ারোগ্লিফিক ছিল শব্দলিপি ও অক্ষরলিপি নির্ভর। অক্ষরলিপি হিসেবে ছিল প্রায় ২৪টি একক ব্যঞ্জনধ্বনি এবং তার সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু ঊহ্য কোনো এক স্বরধ্বনি। যেহেতু স্বরধ্বনির আলাদা অস্তিত্ব ছিল না, তাই তার চিহ্নও ছিল ঊহ্য।
ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ
ব্যঞ্জনধ্বনি যে কোনো স্বরধ্বনি সহযোগে উচ্চারিত হতে পারত, যেমন – ল্যাটিন ব্যঞ্জনধ্বনি m দিয়ে উদাহরণ দিলে ma, me, mi, mu ইত্যাদি।
দ্বি ব্যঞ্জনধ্বনি
প্রায় ৮০টির মতো দ্বি ব্যঞ্জনধ্বনি এবং তার সঙ্গে বিভিন্ন অবস্থানে ঊহ্য থাকা যে কোনো স্বরধ্বনির অস্তিত্ব ছিল। যেমন দ্বি ব্যঞ্জনধ্বনি tm দিয়ে উদাহরণ দিলে তার সাথে স্বরধ্বনি থাকতে পারে tama, tuma, tame, tima ইত্যাদি। দ্বিব্যঞ্জনধ্বনির জন্য ছিল একটিমাত্র চিহ্ন।
শব্দের শুরু
সাধারণভাবে প্রতিটি মিশরীয় শব্দের শুরু হয় ব্যঞ্জনধ্বনি দিয়ে। অবশ্য কিছু শব্দের শুরুতে স্বরধ্বনি আছে, যেমন – Amon, Osiris ইত্যাদি। তাছাড়া কিছু ক্রিয়াপদের শব্দের শুরুতেও স্বরধ্বনি থাকে।
হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে প্রকাশিত শব্দ
হায়ারোগ্লিফিক লিপির মাধ্যমে স্বরধ্বনি ঊহ্য রেখে শুধু ব্যঞ্জনধ্বনি দিয়ে প্রকাশিত হত এক একটি শব্দ।
শ্রুতির ঐতিহ্য অনুসারে হায়ারোগ্লিফিক লিপি
শ্রুতির ঐতিহ্য অনুসারে মানুষ বুঝে নিত কোথায় কোন স্বরধ্বনি বসিয়ে নিয়ে অর্থ বুঝতে হবে। যেমন – নেফারতিতির নাম লেখার সময় হায়ারোগ্লিফিকে লেখা হত nfrtt । শ্রুতির ঐতিহ্য অনুসারে মিশরীয়রা স্বরধ্বনি বসিয়ে নিয়ে বুঝত Nefertiti।
ত্রি ব্যঞ্জনধ্বনি
কিছু কিছু ত্রি ব্যঞ্জনধ্বনি বিশিষ্ট চিহ্নও ছিল। বড় বড় শব্দের ক্ষেত্রে এই সব চিহ্ন ব্যবহার করা হত।
হায়ারোগ্লিফিক লিপির লিখন পদ্ধতির নিয়ন্ত্রক
মিশরীয় লিপিকররাই মূলত লিখনপদ্ধতির নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তারা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী অক্ষর সাজাতেন, তবে তারা ঐতিহ্যের ধারা ঠিকই মানতেন।
হায়ারোগ্লিফিক লিপি লেখা শুরু
লিপিকররা ঠিক করত লিপি কোথায় লেখা হচ্ছে তার প্রেক্ষিতে লিপিমালা ডান দিক থেকে না বাম দিক থেকে শুরু হবে।
হায়ারোগ্লিফিক লিপি লেখার শুরুর দিক
এই হায়ারোগ্লিফিক লিপি কখনও ডান থেকে বামে, কখনও বাম থেকে ডানে, আবার কখনও বা উপর থেকে নিচে লেখা হত।
হায়ারোগ্লিফিক লিপি লেখার হলাবর্ত পদ্ধতি
এই লিপি লেখার আর একটি পদ্ধতি হল হলাবর্ত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে কৃষক যেমন করে জমিতে লাঙল দেন, তেমন করে ডান থেকে বামে, আবার বাম থেকে ডানে লেখা হত।
হায়ারোগ্লিফিক লিপি বোঝার উপায়
মানুষ অথবা প্রাণীবাচক চিত্রের মুখ যেদিকে আছে অথবা হাত পা যেদিকে মুখ করে আছে, সেই দিকটিই হল লিপি পঠনের শুরু তা যেদিক থেকে যেদিকেই যাক।
হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে চিত্রের ব্যবহার
এই হায়ারোগ্লিফিক লিপি ছিল চিত্রে ভরপুর। অবস্থান বুঝে এই সব চিত্রে আবার অলঙ্করণও থাকত। অবশ্য চিত্রগুলি হত বাস্তবধর্মী।
হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে নির্ধারক চিহ্নের ব্যবহার
প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় সমস্বর শব্দের সংখ্যা অনেক বেশি। যেমন – মিশরীয় ভাষায় শুধু SS চিহ্নে লিখিত শব্দটির অর্থ “লিপিকর” এবং “দলিল” দুটোই বোঝায়। লিপিকর আর দলিল কিভাবে বোঝাবে, তা ঠিক করে নির্ধারক চিহ্ন। SS-এর সাথে যখন একজন ‘মানুষের ছবি’ থাকে তখন তা ‘লিপিকর’ বোঝায়, আর SS-এর সাথে ‘লেখার ফলক’ বা ‘লেখার পাতা’ থাকলে তখন বোঝায় ‘দলিল’।
হায়ারোগ্লিফিক লিপির সংখ্যাবাচক চিহ্ন
মিশরীয় লিখন পদ্ধতি চিত্রলিপি ও ভাবলিপির স্তর পেরিয়ে শব্দ ও অক্ষরলিপিতে পরিণত হলেও সংখ্যাবাচক চিহ্নের ক্ষেত্রে তা ভাবলিপির স্তরেই থেকে যায়। এরকম অবস্থা এখনও রোমক সংখ্যাচিহ্নে দেখা যায় – I, II, III, IV, V ইত্যাদি।
হায়ারোগ্লিফিক লিপির উদ্ভব
মিশরীয় ফ্যারাও মেনেসের রাজত্বকালে হায়ারোগ্লিফিক লিপির সৃষ্টি হয় বলে মনে করা হয়। সুমেরীয় সভ্যতার আবিষ্কৃত লিখন পদ্ধতির পরই হায়ারোগ্লিফিক লিপির সূচনা হয় বলে মনে করা হয়।
হায়ারোগ্লিফিক লিপির সর্বশেষ লেখা
চিত্রলিপি না হলেও মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক লিপি চিত্ররূপময়। এই লিপিতে সর্বশেষ ৩৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ফিলিতে অবস্থিত দেবী আইসিসের মন্দিরের গায়ে লেখা হয়।
হায়ারোগ্লিফিক লিপির শেষ বা সমাপ্তি
হায়ারোগ্লিফিক লিপি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উৎকীর্ণ অবস্থায় পাওয়া গেছে। ষষ্ঠ শতকে আইসিসের মন্দির বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে মিশরীয় লিপির দ্বীপশিখা নিভে যায়।
রোসেটা কৃষ্ণশিলাপট
১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্স -এর সম্রাট নেপোলিয়ন মিশর আক্রমণ করে এবং তার সৈন্যরা বিখ্যাত রোসেটা কৃষ্ণশিলাপট উদ্ধার করেন। এটি আসলে একটি শিলালিপি। এতে একই সাথে তিনটি স্তর ও তিন স্তরে তিন লিপি আছে। প্রথম স্তরে মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক লিপি, দ্বিতীয় স্তরে হায়রাটিক লিপি এবং তৃতীয় স্তরে গ্রিক লিপি। কিন্তু লেখার ভাষা ছিল দুটি – মিশরীয় আর গ্রিক ভাষা।
রোসেটা কৃষ্ণশিলাপট উৎকীর্ণ
মিশর -এর টলেমি রাজবংশের রাজা পঞ্চম টলেমি এপিফানেস -এর এক ফরমান মিশরীয় পুরোহিতদের তত্ত্বাবধানে রোসেটা কৃষ্ণশিলাপটে উৎকীর্ণ হয় (১৯৬ খ্রিস্টপূর্ব)।
হায়ারোগ্লিফিক লিপির পাঠোদ্ধার
ফ্রান্স -এর জাঁ ফ্রাঁসোয়া শাঁপোলিয়ঁ এবং ইংল্যান্ড -এর পদার্থবিদ টমাস ইয়ং হায়ারোগ্লিফিক লিপির পাঠোদ্ধার করেন।
হায়ারোগ্লিফিক লিপির বিবর্তন
হায়ারোগ্লিফিক লিপি বিবর্তিত হয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০ অব্দে তা হায়রাটিক লিপির রূপ পরিগ্রহ করে এবং খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে তা ডেমোটিক লিপির রূপ পরিগ্রহ করে।
(১) হায়রাটিক লিপি
হায়ারোগ্লিফিক লিপি বেশ কঠিন ছিল বলে খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০ অব্দের দিকে হায়ারোগ্লিফিক বিবর্তিত হয়ে জন্ম হয় হায়রাটিক লিপির।
(২) ডেমোটিক লিপি
হায়ারোগ্লিফিক লিপির বিবর্তনের সর্বশেষ রূপ ডেমোটিক লিপি। চিত্র নির্ভর হায়ারোগ্লিফিক লিপি ধীরে ধীরে টানা হাতের লেখার মতো রূপ ধারণ করে। এমনকি হায়রাটিক লিপির চেয়েও দ্রুত লেখা যেতোএই লিপি দিয়ে।
উপসংহার :- প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিক লিপির আবিষ্কার শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও ব্যবসা বাণিজ্যর ক্ষেত্রে মানব সভ্যতাকে পৌঁছে দেয় উন্নতির উচ্চ শিখরে। শুধু তাই নয়, ৪টি হায়ারোগ্লিফিক লিপি যোগ হয়ে ২৬টি ইংরেজি বর্ণমালা সম্পন্ন হয়েছিল।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “হায়ারোগ্লিফিক লিপি” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) হায়ারোগ্লিফিক লিপি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার।
ফরাসি।
পবিত্র খোদাই করা লিপি।
মিশরের প্রচলিত চিত্র লিপির নাম হায়ারোগ্লিফিক লিপি।
উৎকীর্ণ পবিত্র চিহ্ন।