হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থা

হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে রাজ্য পরিদর্শন কার্য, মন্ত্রীপরিষদ, অমাত্য, মন্ত্রী ও কর্মচারী, সাম্রাজ্যের বিভাজন, রাজস্ব নীতি, রাজস্বের ব্যয়, সামরিক সংগঠন ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে জানবো।

হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থা

ঐতিহাসিক ঘটনাহর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থা
রাজাহর্ষবর্ধন
রাজধানীথানেশ্বর, কনৌজ
বংশপুষ্যভূতি বংশ
উপাধিশিলাদিত্য
হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থা

ভূমিকা :- প্রাচীন ভারতীয় রাজতন্ত্রে রাজাই সর্বশক্তির আধার হিসেবে কাজ করতেন। সুতরাং রাজার যোগ্যতার ওপর শাসন ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করত। হর্ষবর্ধন এই কথা ভালভাবে বুঝতেন।

রাজ্য পরিদর্শন কার্য

তিনি প্রায় সারাদিন রাজকার্যে ব্যস্ত থাকতেন। রাজকর্মচারীদের ওপর অন্ধভাবে নির্ভর না করে তিনি নিজে তাদের কাজের তদারকি করতেন। হিউয়েন সাঙ -এর মতে, হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রজাদের সঙ্গে গণ সংযোগ রাখা ও তাদের অভাব-অভিযোগ জানবার জন্য সর্বদা রাজ্যে ভ্রমণ করা। হর্ষবর্ধন কেবলমাত্র শহর অঞ্চলে ভ্রমণ করতেন না, তিনি গ্ৰামাঞ্চলেও ঘুরতেন। বর্ষাকালে এই রাজকীয় অনুসংযান বন্ধ থাকত।

হর্ষবর্ধনের শাসন সম্পর্কে রোমিলা থাপারের মন্তব্য

রোমিলা থাপারের মতে, তিনি নিজেকে রাজকীয় পরিদর্শক হিসেবে মনে করতেন, লোকের অভাব-অভিযোগের প্রতিকার করতেন এবং দরিদ্রদের দান-ধ্যান করতেন। তিনি সারাদিনকে তিন ভাগে ভাগ করে, তিন রকম রাজকার্য করতেন।

হর্ষবর্ধনের মন্ত্রী পরিষদ

মন্ত্রীপরিষদ রাজাকে শাসনকার্যে সহায়তা করত। রাজ্যে যুদ্ধ, বিদ্রোহ বা অন্য কোনো সঙ্কটজনক পরিস্থিতি দেখা দিলে মন্ত্রীপরিষদ রাজাকে অবিরাম পরামর্শ ও সাহায্য করত।

হর্ষবর্ধনের অমাত্য

রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর মন্ত্রী ও অমাত্যরাই হর্ষবর্ধনকে সিংহাসনে বসতে অনুরোধ জানায়। এছাড়া হর্ষচরিত ও মধুবন লিপি থেকে জানা যায় যে, বহু উচ্চপদস্থ অমাত্য হর্ষবর্ধনকে শাসন কার্যে সহায়তা করতেন। কুমারমাত্যরা ছিলেন শিক্ষানবীশ মন্ত্রী ও কর্মচারী। এঁরা সম্রাটের খুব বিশ্বাসভাজন ছিলেন।

হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থায় কর্মচারী

শাসন ব্যবস্থায় ছিলেন উপারিক, মহাসামন্ত, বিষয়পতি প্রভৃতি কর্মচারী। বিষয়পতিরা ছিলেন জেলার অধিকর্তা। মহাসামন্তরা ছিলেন সামন্ত কর্মচারী। পুষ্টকৃত, করনিক প্রভৃতি অন্যান্য কর্মচারীরাও ছিল। গ্রামের শাসনকর্তার নাম ছিল গ্রামীক।

হর্ষবর্ধনের কর্মচারীদের বেতন

হর্ষবর্ধন তাঁর কর্মচারীদের নগদ বেতনের পরিবর্তে জমি দিতেন। নিম্নবর্গের কর্মচারীদের কখনও কখনও নগদ বেতন দেওয়া হত।

হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের বিভাজন

সম্রাট হর্ষবর্ধন তার সাম্রাজ্যকে কয়েকটি ভুক্তি বা প্রদেশে ভাগ করেন। ভুক্তিগুলিকে বিষয় বা জেলায় ভাগ করা হত। কতকগুলি গ্রাম নিয়ে বিষয় গড়া হত। প্রাদেশিক শাসনকর্তার উপাধি ছিল লোকপাল।

হর্ষবর্ধনের রাজস্ব নীতি

  • (১) হর্ষবর্ধনের আমলে প্রধান রাজস্ব ভূমি থেকে সংগৃহীত হত। এছাড়া বাণিজ্য ও খনি শুল্কও ছিল সরকারী আয়ের প্রধান উপায়। রাজস্ব ছিল তিন প্রকার, যথা ভাগ, হিরণ্য ও বলি। ভূমিকরকে ভাগ বলা হত। ফসলের ১/৬ ছিল ভাগ বা ভূমিকর।
  • (২) বণিকরা যে শুল্ক দিত তার নাম ছিল হিরণ্য। কখনও কখনও কৃষকরা নগদ টাকায় রাজস্ব দিলে তাকে হিরণ্য বলা হত। বলি ছিল বাড়তি কর। সাধারণত জরুরী অবস্থায় বাড়তি ব্যয় নির্বাহের জন্য বলি আদায় করা হত।
  • (৩) মধুবন লিপি থেকে জানা যায় যে, বণিকরা যে জিনিষ বিক্রি করত তার ওপর শুল্ক আদায় করা হত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃষকরা ফসল বা নগদ খাজনার বদলে শ্রম দান করত।

হর্ষবর্ধনের রাজস্বের ব্যয়

হিউয়েন সাঙের মতে, হর্ষবর্ধন তাঁর আদায়ীকৃত রাজস্বকে চার ভাগে ভাগ করে খরচ করতেন। যথা –

  • (১) রাজ্য শাসন ও ধর্মীয় উপাসনা বাবদ খরচ,
  • (২) রাজকর্মচারীদের বেতন ও ভরণ-পোষণ খরচ,
  • (৩) বুদ্ধিজীবি ও গুণীদের বৃত্তি,
  • (৪) বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দান।
  • (৫) এছাড়া রাস্তাঘাট তৈরি, খাল খনন, বিধবাদের বৃত্তি, অসহায় লোকেদের ভরণ-পোষণ প্রভৃতি খাতে অর্থব্যয় হত।

হর্ষবর্ধনের সামরিক সংগঠন

  • (১) হর্ষবর্ধনের সামরিক সংগঠন সম্পর্কে জানা যায় যে, পদাতিক, হস্তী ও অশ্বারোহী নিয়ে তাঁর বাহিনী গঠিত হয়েছিল। হিউয়েন সাঙের মতে, ৬৯ হাজার হাতি ও এক লক্ষ অশ্ব নিয়ে তাঁর বাহিনী গঠন করা হয়। সম্ভবত সংখ্যাটি অতিরঞ্জিত। তিনি তাঁর রণ-অশ্বগুলি সিন্ধু, কম্বোজ, পারস্য থেকে সংগ্রহ করতেন।
  • (২) বাছাই সেনাদের থেকে রাজকীয় রক্ষীদল গঠন করা হত। সেনাপতি ও অন্যান্য উচ্চ সামরিক কর্মচারীরা বংশানুক্রমে পদ অধিকার করত। তাদের ভরণপোষণের জন্য ভূমি বন্দোবস্ত করা হত। নগর ও গ্রামকে রক্ষার জন্য দুর্গ ও প্রাকার তৈরি করা হত। মহাবলাধিকৃত ছিলেন পদাতিক বাহিনীর প্রধান।

হর্ষবর্ধনের বিচার ব্যবস্থা

সম্রাট হর্ষবর্ধনের বিচারব্যবস্থা খুব ন্যায়পরায়ন ছিল। কোনো অবিচার হলে তিনি নিজে তার প্রতিকার করতেন। লোকে যাতে শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করতে পারে এদিকে তিনি নজর নিতেন। ফৌজদারী আইন ছিল বেশ কঠোর। অপরাধীদের কঠোর সাজা দেওয়া হত। অঙ্গচ্ছেদ, অরণ্যে নির্বাসন, জরিমানা এবং প্রয়োজন হলে প্রাণদণ্ড দেওয়া হত। অনেক সময় অপরাধীকে ধরার জন্য দৈব পরীক্ষার আশ্রয় নেওয়া হত। গুপ্ত যুগ অপেক্ষা ফৌজদারী আইনের কঠোরতা হর্ষবর্ধনের যুগে দেখা যায়।

উদারনৈতিক স্বৈরতন্ত্র

হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থাকে একটি উদারনৈতিক স্বৈরতন্ত্র বলা যেতে পারে। এই শাসন ব্যবস্থার সাফল্য হর্ষবর্ধনের ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতার উপরেই বেশীর ভাগ নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এই বিশাল সাম্রাজ্যে তাঁর একার পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব ছিল না। ফলে কর্মচারীদের যোগ্যতার ওপর তার প্রশাসনের যোগ্যতা নির্ভর করত। তবে সাধারণ লোকেরা শান্তিপ্রিয় স্বভাবের বলে আইন-শৃঙ্খলা মোটামুটি বজায় থাকত।

হর্ষবর্ধনের শাসনের দুর্বল দিক

যদিও হিউয়েন সাঙ হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ও আইন-শৃঙ্খলার প্রশংসা করেছেন, তবুও দেশে চোর-ডাকাতের সংখ্যা খুব বেড়ে গিয়েছিল। হিউয়েন সাঙ নিজে তস্করের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। এই কারণে ফৌজদারী আইন এত কঠোর ছিল।

বাণিজ্যিক বিকাশ ব্যাহত

  • (১) মৌর্য বা গুপ্ত যুগে কৃষির সঙ্গে বাণিজ্যের যে বহুমুখী প্রসার ঘটেছিল হর্ষবর্ধনের যুগে তার বিকাশ তেমনভাবে সম্ভব হয়নি। তাঁর সাম্রাজ্যের খণ্ড চরিত্রের জন্য সর্বভারতীয় বাণিজ্য এই সাম্রাজ্যের মাধ্যমে গড়ে উঠতে পারেনি। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারত তার অধিকারের বাইরে থাকায়, গাঙ্গেয় উপত্যকার সঙ্গে সংযোগ ব্যাহত হয়েছিল।
  • (২) উত্তর ভারতের সেরা সম্পদশালী অঞ্চলটি হর্ষের অধিকারে থাকায় এবং গাঙ্গেয় উপত্যকার জমির ফলন বেশী হওয়ায় লোকে মোটামুটি সুখে-শান্তিতে ছিল। হর্ষের যুগে নগরজীবন ও নতুন নগর তেমন কিছু স্থাপিত হয়নি। তখনও পর্যন্ত তাম্রলিপ্ত ছিল পূর্ব ভারতের শ্রেষ্ঠ বন্দর।

উপসংহার :- হর্ষবর্ধন ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও ধর্মপ্রাণ শাসক। ই-সিং, হিউয়েন সাঙ প্রমুখ চীনা পর্যটক তাঁর সাহিত্যপ্রিয়তার প্রশংসা করেছেন। তিনি উড়িষ্যা জয় করার পর বৌদ্ধপণ্ডিত জয়সেনকে ৮০টি গ্রাম দান করেন। তিনি ছিলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় -এর পৃষ্ঠপোষক। তাঁর দরবারের বিখ্যাত লেখক বাণভট্ট সভাকবি ছিলেন। বৌদ্ধ ধর্ম-এর প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত অনুরাগ থাকলেও অন্য ধর্মের প্রতি তিনি সহিষ্ণুতা দেখাতেন।

(FAQ) হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. হর্ষবর্ধন কখন সিংহাসনে আরোহণ করেন?

৬০৬ খ্রিস্টাব্দে।

২. কে কখন হর্ষসম্বৎ প্রচলন করেন?

হর্ষবর্ধন ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে।

৩. হর্ষবর্ধনের রাজধানী কোথায় ছিল?

থানেশ্বর ও কনৌজ।

৪. সকলোত্তরপথনাথ কে ছিলেন?

হর্ষবর্ধন।

Leave a Comment