চোল শিল্প ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে চোল স্থাপত্য, রাজরাজেশ্বর মন্দির, গঙ্গাইকোণ্ড চোলপুরম, মন্দিরের অনুষ্ঠান, জনহিতকর প্রকল্প, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও ধর্মমত সম্পর্কে জানবো।
চোল শিল্প ও সংস্কৃতি
ঐতিহাসিক ঘটনা | চোল শিল্প ও সংস্কৃতি |
বংশ | চোল বংশ |
রাজধানী | তাঞ্জোর |
প্রথম রাজা | বিজয়ালয় |
শ্রেষ্ঠ রাজা | প্রথম রাজেন্দ্র চোল |
শেষ শক্তিশালী রাজা | প্রথম কুলোত্তুঙ্গ |
ভূমিকা :- চোল রাজারা রাজ্য জয়ে ব্যস্ত থাকলেও শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের অনুরাগ কম ছিল না। চোলদের সংস্কৃতি ছিল উদার মনের ও উচ্চ আদর্শের উদাহরণ।
চোল স্থাপত্য
- (১) চোল স্থাপত্য শিল্পের বৈশিষ্ট্য ছিল এর বিরাটত্ব। চোলরা ছোট আকারে কোনো কিছু করা পছন্দ করতেন না। চোল নগরগুলির পরিকল্পনা ছিল বিরাট। নগরের কেন্দ্রে থাকত মন্দির, প্রধানত শিব মন্দির। সেই মন্দিরকে ঘিরে শহর গড়ে উঠত।
- (২) চোল রাজাদের মন্দির স্থাপত্যকে দুই পর্বে ভাগ করা যায়। চোল যুগের আদি পর্বের মন্দিরগুলি ছিল ক্ষুদ্রাকৃতি এবং তাতে পল্লব রীতির প্রভাব স্পষ্ট বুঝা যায়। বিজয়ালয় এই যুগে চোলেশ্বর মন্দির, প্রথম পরান্তক করঙ্গনাথের মন্দির তৈরি করেন। এই মন্দিরগুলির স্তম্ভযুক্ত মণ্ডপ ও বিমানের গঠনে পল্লব স্থাপত্যের ছাপ সুস্পষ্ট।
- (৩) চোল রাজাদের পরবর্তী যুগের মন্দির পল্লব প্রভাব মুক্ত হয়ে দ্রাবিড় স্থাপত্যের উজ্জ্বল নিদর্শনে পরিণত হয়। প্রথম রাজরাজ চোল -এর তৈরি তাঞ্জোরের রাজরাজেশ্বর মন্দির এবং তাঁর পুত্র রাজেন্দ্র চোলের তৈরি গঙ্গাইকোণ্ড চোলপুরমের মন্দির অতি বিখ্যাত।
- (৪) চোল রাজাদের সম্পদের প্রমাণ হিসেবে মন্দিরগুলির বিরাট আয়তন, বিশাল আকৃতি গোপুরম আমাদের বিস্মিত করে। তাঞ্জোরের রাজরাজেশ্বর মন্দিরকে প্রাচীন ভারত -এর বৃহত্তম, উচ্চতম এবং সর্বাপেক্ষা উচ্চাকাঙ্খা-সম্পন্ন ধর্মীয় মন্দির বলে অভিহিত করা হয়। রাজেন্দ্রের পর চোল স্থাপত্য তার গৌরব ও মহত্ব হারায়।
- (৫) গঙ্গাইকোণ্ড চোলপুরমের মন্দিরটিও বিরাট এবং রাজরাজেশ্বর মন্দিরের মতই আড়ম্বরপূর্ণ। সুব্রহ্মণ্য ও দ্বার সমুদ্র মন্দিরগুলি এই তুলনায় কম বিরাট, কিন্তু সুষমাময়। প্রতি মন্দিরের ‘গোপুরম বা সিংহদরজাগুলি হল আকাশছোয়া এবং সমগ্র গঠনে অলঙ্কার-বহুল ভাস্কর্য।
চোল যুগে নির্মিত রাজরাজেশ্বর মন্দির
রাজরাজেশ্বর মন্দির ৫০০×২৫০ ফুট প্রাচীরের ভেতর এক প্রাঙ্গণে স্থাপিত। এই মন্দিরের বিমান ১৪ তলা, ২০০ ফুট উঁচু এবং প্রায় আকাশছোয়া। মন্দিরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সঙ্গতি এবং ছন্দ রেখেই বিমানটি তৈরি হয়েছে। মন্দিরটি ১০০৩-১০১০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়।
চোল যুগে নির্মিত গঙ্গাইকোণ্ড চোলপুরম
রাজেন্দ্র চোলের গঙ্গাইকোণ্ড চোলপুরমের মন্দির ৩৪০×১০০ ফুট প্রাচীরের মধ্যে অবস্থিত। এর মণ্ডপটির আয়তন ১৭৫×৯৫ ফুট। এই মন্দিরের বিমানও বিরাট উঁচু এবং মণ্ডপের সঙ্গে এক অলিন্দ দ্বারা যুক্ত। মণ্ডপের ছাদ সমতল; ১৫০টি অলঙ্কৃত স্তম্ভের ওপর ছাদটি ধরা আছে। এই মণ্ডপের মধ্যেই পরবর্তীকালের হাজার থামের দ্রাবিড় মণ্ডপের সূচনা দেখা যায়। এই মন্দিরের বিমান ১৬০ ফুট উঁচু।
দুই বিমানের পার্থক্য
মহাকাব্য ও গীতি কবিতার যে পার্থক্য রাজরাজেশ্বর মন্দিরের বিমান ও রাজেন্দ্রের মন্দিরের বিমানে সেই পার্থক্য। রাজরাজেশ্বর মন্দিরের বিশালতা, বিরাটত্ব মহাকাব্যের মতই, আর রাজেন্দ্রের মন্দিরের বিমানের ধাকা কমনীয় ঢেউ তোলা রেখাগুলি গীতি কবিতার ছন্দ। একটি হল শক্তি, অপরটি সৌন্দর্যের প্রতীক। তবে রাজেন্দ্রের মন্দিরে অলঙ্করণের বাহুল্য লক্ষণীয়।
চোল মন্দিরের অনুষ্ঠান
ভারতের চোল মন্দিরগুলি ছিল নগরের লোকের সামাজিক মেলামেশা, উৎসব, আনন্দ ও ভ্রমণের স্থান। এগুলিতে যেমন একদিকে সাধু-সন্ন্যাসীরা ধ্যানে ও পুজোয় রত থাকতেন, তেমন নৃত্য, কথকতা, অভিনয় প্রভৃতি মন্দির প্রাঙ্গনেই হত।
চোল রাজাদের জনহিতকর প্রকল্প
- (১) চোল স্থাপত্য, বিরাট আকৃতির নদী বাঁধ, সেচ বাঁধ, জলাধার, রাস্তা তৈরি দ্বারা জনহিতকর কাজে বিকশিত হয়। রাজেন্দ্র চোল বিখ্যাত চোলগঙ্গম হ্রদ খোদাই করেন যেটি ছিল ১৬ মাইল লম্বা।
- (২) এই হ্রদের থেকে যে খাল বের হয়েছিল তাতে জল নিয়ন্ত্রণের পাথরের নালী বা ফ্লুইস ছিল। কাবেরীর স্রোতকে বড় পাথরের চাঁই দিয়ে বেঁধে স্রোত ঘুরিয়ে দেওয়া হয়।
চোল চিত্রকলা
তাঞ্জোরের মন্দিরের গায়ে চোল চিত্রকলার নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। অজন্তা চিত্রের মত চোল চিত্রকলার মান ছিল খুবই উন্নত।
চোল ভাস্কর্য
- (১) চোল ভাস্কর্যও খুব উঁচুমানের ছিল। পাথর কেটে দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণে অপরূপ দেহভঙ্গিমা চোল শিল্পীরা বিকশিত করেন। চোল যুগের ব্রোঞ্জের তৈরি নটরাজ মূর্তি অতিশয় বিখ্যাত। চোল ভাস্কর্যে বলিষ্ঠতার সঙ্গে কমনীয়তার মিশ্রণ দেখার মত।
- (২) পরিচ্ছদ ও অলঙ্কার দেহের ভার না বাড়িয়ে কমনীয়তা বাড়িয়েছে। চোল ধাতু মূর্তিগুলিতে যে অপরূপ শিল্পগুণ দেখা যায় তার তুলনা নেই। বাসাম বলেছেন, পৃথিবীর কোথাও এত সুন্দর ধাতু মূর্তি দেখা যায় না। এগুলি আয়তনে বড়, কিন্তু সৌন্দর্যে অপরূপ। সম্ভবত এই মূর্তিগুলি শোভাযাত্রা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হত।
- (৩) মূর্তিগুলির গঠনে আবেগ, আধ্যাত্ম ভাব পরিস্ফুটিত হয়েছে। মূর্তিগুলি তামা, পিতল, অষ্ট ধাতুতে তৈরি। বিষ্ণু, লক্ষ্মী, শিব, পার্বতী, বুদ্ধ মূর্তি ধাতু গালিয়ে তৈরি করা হয়। চোল নটরাজ মূর্তি ভারতের লোকের অতি পরিচিত।
- (৪) কুমারস্বামীর মতে, “সারনাথের গৌতম বুদ্ধ মূর্তি হওয়ার প্রতীক, চোল নটরাজ হয়ে উঠার প্রতীক” অর্থাৎ সদা পরিবর্তনশীল বিশ্বের পরে নৃত্য চঞ্চল নটরাজ কাল-কালান্ত সীমা অতিক্রম করে অসীমের পথের যাত্রী হয়েছেন।
চোল যুগে ধর্মমত
চোল সম্রাটরা শৈব ধর্মাবলম্বী হলেও বৈষ্ণব ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্ম অবলম্বীদের প্রতি যথোচিত সমাদর দেখাতেন। রাজরাজ শৈব হলেও বিষ্ণু ও বৌদ্ধ মন্দিরে দানকার্য করেন। একমাত্র চোল সম্রাট কুলোত্তুঙ্গ বৈষ্ণব ধর্মগুরু রামানুজকে রাজ্য হতে বহিষ্কার করেন। সাধারণত বৈষ্ণব আলভার ও শৈব নয়নারগণ অবাধে ধর্ম প্রচার করতেন।
চোল ধর্মগুরু রামানুজ
- (১) পল্লব ধর্মগুরু শঙ্কর ছিলেন অদ্বৈতবাদের প্রবর্তক, চোল ধর্মগুরু রামানুজ ছিলেন বিশিষ্ট দ্বৈতবাদের প্রবর্তক। তিনি বৈষ্ণব ধর্মগুরুদের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শঙ্কর জ্ঞানকেই মুক্তির উপায় মনে করতেন। রামানুজ মনে করতেন যে, জ্ঞান হল অন্যতম ও কঠিন পথ।
- (২) নির্জলা ভক্তি ও ঈশ্বরের কাছে আত্মনিবেদন দ্বারা মুক্তি পাওয়া যায়। তিনি ভক্তিবাদের সঙ্গে বেদান্ত দর্শনের সমন্বয় করেন। এজন্য তাঁর মতবাদকে বিশিষ্টা দ্বৈতবাদ বলা হয়। রামানুজের ঈশ্বর ছিলেন প্রেম, করুণা, ক্ষমার আধার। তাঁর করুণাই মানুষকে ইহলোকে ও পরলোকে করে পরম সুখী ও পবিত্র।
- (৩) রামানুজ সমগ্র ভারত পরিক্রমা করেন এবং তাঁর প্রভাবে উত্তর ভারতে ভক্তি ধর্ম বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। রামানুজ জাতিভেদের বিরোধিতা করেন নি। তবে তিনি শূদ্রের মন্দির প্রবেশের অধিকার স্বীকার করতেন, যদিও তা তিনি কার্যে পরিণত করতে পারেননি।
উপসংহার :- চোল যুগে শৈব ধর্ম সাহিত্যের বিশেষ অগ্রগতি ঘটে। পেরিয়া পুরাণম নামে শৈব দর্শনের ওপর এক বিখ্যাত গ্রন্থ রচিত হয়। বহু বৈষ্ণব ভক্তিসঙ্গীত ও সাহিত্য চোল যুগে রচিত হয়। এছাড়া জীবক চিন্তামণি, কলিঙ্গ থুপারনি প্রভৃতি সাহিত্য গ্রন্থ চোল যুগে রচিত হয়।
(FAQ) চোল শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
তাঞ্জোর।
বিজয়ালয়।
প্রথম রাজেন্দ্র চোল।
প্রথম রাজরাজ চোল।
প্রথম রাজেন্দ্র চোল।